জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বর্তমান চেয়ারম্যানের পদত্যাগ ঘিরে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, চেয়ারম্যানের পদত্যাগ কেন্দ্র করে অস্থিরতার কারণে নিয়মিত রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে অর্থবছরের শেষে ঘাটতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর এনবিআরকে রাজস্ব আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আদায়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ ও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। ১২ মাসে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে প্রতি মাসে ৪০ হাজার কোটি এবং প্রতিদিন আদায় করতে হবে প্রায় ১ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এনবিআর সূত্র জানায়, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় গত জুলাইয়ে স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট, আমদানি শুল্ক ও আয়কর আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জানা গেছে, জুলাই মাসে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও আদায় হয়নি।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাজস্ব বোর্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে তা নিরসনে বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দ্রুত সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। রাজস্ব আদায় প্রতিদিনের কাজ। একদিন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে না পারলে রাজস্ব আদায় ব্যাহত হয়। প্রতি অর্থবছরই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকছে। চলমান অস্থিরতার কারণে রাজস্ব ঘাটতি আরও বাড়বে।
সোমবার চেয়ারম্যানকে পদত্যাগ করতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হলেও গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত পদত্যাগের কথা শোনা যায়নি। আরও কঠোর কর্মসূচি হিসেবে যৌথভাবে বাংলাদেশ ইন্সপেক্টর অব ট্যাক্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম আকাশ এবং বাংলাদেশ কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সভাপতি মো. মজিবুর রহমান নতুন কর্মসূচি দেন। সারা দেশে ভ্যাট কমিশনারেট, কাস্টম হাউস ও কর অঞ্চলে লাগাতার কর্মবিরতির ঘোষণা করেছেন তারা। চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দেবেন বলে জানা গেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসেই দেশব্যাপী কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এতে শিক্ষার্থীসহ বহু মানুষ হতাহত হন। এরই মধ্যে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে। দেশব্যাপী স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে শুরু করলেও অচলবস্থা কাটছে না এনবিআরে। বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বর্তমান চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে বরখাস্ত ও শাস্তির দাবিতে গত ৬ আগস্ট থেকে এনবিআরের বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন। চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করে আইনের আওতায় এনে একগুচ্ছ দাবি বাস্তবায়নের কথাও বলেন তারা।
দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘প্রশাসন ক্যাডার থেকে কোনো কর্মকর্তা প্রেষণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পদায়ন করা যাবে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে অবিলম্বে পদ থেকে বরখাস্ত করে আয়কর/কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট ক্যাডার থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিতে হবে। অবিলম্বে চেয়ারম্যানের অনুসারী এবং প্রিয়পাত্র প্রথম সচিব (কর প্রশাসন) মো. শাহিদুজ্জামানকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করে কর ক্যাডারের কর্মকর্তা পদায়ন করতে হবে। দুই বছর পর পর বদলি বাণিজ্য বন্ধ করে আয়কর আইন-২০২৩-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং আয়কর আদায়ের স্বার্থে অতীতের মতো রাজস্ব-বান্ধব এবং প্রযোজ্যতা সাপেক্ষে বদলি করতে হবে। অবৈধ নিয়োগ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। কর্মচারীদের পদায়ন কর্মচারীদের জন্য প্রণীত জ্যেষ্ঠতা বিধিমালা ও আইন অনুযায়ী করতে হবে। আয়কর অনুবিভাগের ১০তম-২০তম গ্রেডের সব শূন্য পদে পদোন্নতি দিতে হবে এবং সব পদ পদোন্নতিযোগ্য হতে হবে, কোনো পদ ব্লক রাখা যাবে না। কর্মচারীদের নিজ নিজ অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে পরামর্শ করে কর্মচারীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, অন্যথায় কোনো সিদ্ধান্ত মানা হবে না। সর্বশেষে আয়কর অনুবিভাগের সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের সিদ্ধান্ত শুধু আয়কর বিভাগের কর্মকর্তা/কর্মচারীরা নেবে।’
আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমাবেশে বিভিন্ন বক্তৃতায় হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, ‘শুল্ক ও আবগারি ক্যাডার থেকে ২ বছরের জন্য ও আয়কর ক্যাডার থেকে ২ বছরের জন্য মেম্বারদের থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিতে হবে। বাইরের ক্যাডারের কর্মকর্তারা আমাদের কষ্ট বুঝতে চান না। তাদের ইচ্ছেমতো করে আমাদের চালাতে চান, সেটা কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখতে হবে। আমাদের প্রমোশন হওয়ার কথা ছিল। সিরিয়াল মোতাবেক, অতীতেও হয়েছে। বর্তমান চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন লোকের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ইচ্ছেমতো যাকে তাকে সামান্য অজুহাতে সিরিয়াল ভঙ্গ করে নিজের পছন্দমতো করে পদোন্নতি ও বদলি করা হয়েছে। সময়মতো পদোন্নতি দেওয়া হয়নি, ডিপিসি করা হচ্ছে না, পদোন্নতির পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে না, নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।’
তারা আরও বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডার থেকে কোনো কর্মকর্তা প্রেষণে এনবিআরে পদায়ন করা যাবে না। দুই বছর পর পর বদলি-বাণিজ্য বন্ধ করে আয়কর আইন-২০২৩-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং আয়কর আদায়ের স্বার্থে অতীতের মতো রাজস্ব-বান্ধব এবং প্রযোজ্যতা সাপেক্ষে বদলি করতে হবে। অবৈধ নিয়োগ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। সব কর্মচারীর পদায়ন কর্মচারীদের জন্য প্রণীত জ্যেষ্ঠতা বিধিমালা ও আইন অনুযায়ী করতে হবে।’
এনবিআরের ভ্যাট নীতি সদস্য হোসেন আহমেদ বলেন, ‘আমাদেরকে পুতুল বানিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি ন্যায়সংগত কথা বলতে গেলে খারাপ ব্যবহার করা হয়। কথা বলতে দেওয়া হয়নি। এনবিআর ধ্বংস করেছে। এসব করে রাজস্ব আদায়ের স্বাভাবিক ধারা নষ্ট করা হয়েছে।’
এনবিআরের সদ্য সাবেক সদস্য ড. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘স্বৈরাচারী সরকারের দোসর এই এনবিআর চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সরকারের পদলেহন করেছে। অথচ টাকা পাচারকারী, ব্যাংক লুটপাটের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’