অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি চট করে কমবে না। এটা ঘোড়ার মতো নয় যে মাথা নিচু করে দৌড় দেবে, তারপরে ছুটে চলবে। কিছুদিন সময় লাগবে। তবে যুগ যুগ লাগবে না। আমরা যত দ্রুত সম্ভব যৌক্তিক সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনব। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে।’
খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা হবে বলে জানান তিনি।
বুধবার (১৪ আগস্ট) সচিবালয়ে মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত এক পর্যালোচনা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন অর্থ উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, মূলস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে দ্রুত এটি কমে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কাউকে ধরা বা মারা- এসব এজেন্ডা নেই। একটাই এজেন্ডা, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা, যাতে সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব হয়। সে লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি, মন্তব্য করেন ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এটি এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, মূল্যস্ফীতির ওপর বিদেশি বিনিয়োগ নির্ভর করে। যারা এ দেশে বিনিয়োগ করবেন, তারা মূল্যস্ফীতির সূচক দেখেন। কারণ এখানে মুনাফার ব্যাপার আছে। সুতরাং ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে সেটা দেশি হোক আর বিদেশি হোক, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সে জন্য এটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে কৃষিপণ্য উৎপাদনের ওপর বেশি নজর দেওয়া হবে। বিভিন্ন কারণে বাজারে সরবরাহের ব্যাঘাত ঘটে। আমরা কারণগুলো শনাক্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলেছি সংশ্লিষ্টদের।’
সিন্ডিকেটের কারণে বাজার অস্থির হয়। তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবেন-এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘সিন্ডিকেটের বিষয়টি আমাদের নজরে আনা হয়েছে।’
ছাগলকাণ্ডের মতিউর রহমানসহ সাম্প্রতিক সময়ে যেসব দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো ধামাচাপা পড়ে যাবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, না না, ধামাচাপা পড়বে না। এগুলোর কার্যক্রম যথারীতি চলমান থাকবে। তিনি বলেন, কাউকে শাস্তি দিতে হলে সঠিক তথ্য-প্রমাণ লাগবে। তা না হলে আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার করা কঠিন হয়ে পড়বে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে- একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উৎপাদন বাড়াতে কৃষি উপকরণসহ যা কিছু দরকার, সেগুলোর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরবরাহব্যবস্থা যাতে কিছুতেই ব্যাহত না হয়, সে বিষয়ে নজর রাখার কথা বলা হয়েছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ‘যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন হলে আমি আশা করছি শিগগিরই জিনিসপত্রের দাম কমে আসবে। মানুষ স্বস্তি পাবে। তাই বলে কালই দাম কমে যাবে, তা ঠিক নয়। এর জন্য একটু সময় লাগবে। আমরা বাস্তবায়নকে বেশি প্রাধান্য দেব।’
উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরবরাহব্যবস্থা ঠিক করা হবে, সমন্বয় করা হবে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির। সবকিছুই উন্মুক্ত থাকবে। কিছুই গোপন করা হবে না, আগে যেটা করা হতো। তবে অর্থের অপচয় রোধ করতে হবে। পাশাপাশি অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বৈঠকে উপস্থিত সবাইকে ভয়ভীতিমুক্ত হয়ে কথা বলার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, তোয়াজ করার দরকার নেই। এমনকি তিনি এও বলেছেন, উপদেষ্টা ভালো মানুষ, এসব কথাও বলার দরকার নেই।
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে গভর্নর যা বললেন: বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সরবরাহ ঠিক রেখে উৎপাদনের চাকা সচল রাখা। এটা নিশ্চিত করতে পারলে বাজারে দামের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আরেকটি বিষয়ে কাজ করতে হবে। সেটা হলো চাঁদাবাজি বন্ধ এবং চাহিদার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এসব বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি এবং সংশ্লিষ্টদের কাজ করতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। আরও পর্যালোচনা করা হবে, নতুন কিছু করা যায় কি না।’
গভর্নর আহসান মনসুর বলেন, আগামী পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নেমে আসবে। রিজার্ভসংকট রাতারাতি যাবে না- এর হিসাব করতে হবে। আমদানিতে কোথায় কতটুকু ডলার দেওয়া যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গেও আলাপ করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ব্যাংকিং কমিশন গঠনবিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে নতুন গভর্নর বলেন, এ বিষয়ে আলোচনা হয়নি।
বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, অর্থসচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার, বাণিজ্যসচিব মো. সেলিম উদ্দিন, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা, খাদ্যসচিব ইসমাইল হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান ও নুরুন নাহার উপস্থিত ছিলেন।