অতীতের রেকর্ড ভেঙে মাছ উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য দেখাচ্ছে যশোর। বর্তমানে জেলার চাহিদার চেয়ে দুই গুণের বেশি মাছ উৎপাদন হচ্ছে। এসব মাছ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হচ্ছে। খুলনা বিভাগে উৎপাদিত প্রায় ১০ হাজার টন মাছ প্রতি বছর ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এতে রাজস্ব আয় হচ্ছে প্রায় ৪ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে শুধুমাত্র যশোরে উৎপাদিত মাছ রপ্তানি থেকে আয় করা হচ্ছে ১৫০ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে যশোরে ৭২ হাজার ১৫৫ দশমিক ১৭ হেক্টর জলায়তনে মাছ উৎপাদনে ক্রমবর্ধমান সাফল্যে জাতীয় অর্থনীতিসহ পুষ্টি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খুলনা বিভাগে মাছ উৎপাদনে ফের প্রথম স্থান অধিকার করেছে যশোর জেলা। কয়েক বছর ধরে গৌরবময় এ অর্জন অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেলায় মাছ উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার টন। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাছ উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৪১ হাজার ১০৭ টন। এ ছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ লাখ ৩১ হাজার ১৪৩ টন ও ২০২০-২১ অর্থবছরে মাছ উৎপাদন হয় ২ লাখ ২৭ হাজার ৩ টন। জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় বছরে মাছ উৎপাদন হয় ৭ লাখ ১৮ হাজার ৪০৫ টন। এর মধ্যে চিংড়ি রয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ২১৮ টন। এ বিভাগে মাছ উৎপাদনে পিছিয়ে রয়েছে মেহেরপুর জেলা। সেখানে উৎপাদন হয় মাত্র ৮ হাজার ৮৭৫ টন। বাগেরহাটে ১ লাখ ২১ হাজার ৩৭৩ টন, চুয়াডাঙ্গায় ১৬ হাজার ৯৫৪ টন, ঝিনাইদহে ৩৮ হাজার ৮৭৬ টন, খুলনায় ১ লাখ ১০ হাজার ৯৫ টন, কুষ্টিয়ায় ৩২ হাজার ২০২ টন, মাগুরায় ১৩ হাজার ৮৪৫ টন, নড়াইলে ১৪ হাজার ২৬৬ টন ও সাতক্ষীরায় মাছ উৎপাদন হয় ১ লাখ ৩১ হাজার ৮৭১ টন।
খুলনা বিভাগে মাছ উৎপাদনে যশোর জেলা স্বয়ংসম্পূর্ণ। জেলায় ২২ প্রজাতির মাছ চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রুই মাছ উৎপাদন হয়। গত বছর রুই মাছ উৎপাদন হয় ১ লাখ ৬০ হাজার ৭৬৫ টন। পাঙাশ মাছ হয়েছে ১১ হাজার ৬৩৬ টন, তেলাপিয়া ১৭ হাজার ৯০৫ টন, কই ২ হাজার ৭৭৮ টন, শিং-মাগুর ৫ হাজার ৯৩৪ দশমিক ২ টন, গুলশা-পাবদা ১৭ হাজার ৭১৩ টন, গলদা চিংড়ি ৯ হাজার ৫৬০ টন, বাগদা চিংড়ি ৩৫৪ টন, অন্যান্য চিংড়ি ৮৯ দশমিক ৫ টন ও অন্যান্য জাতের মাছ উৎপাদন হয় ১৪ হাজার ৯৭২ দশমিক ৮৮ টন।
জেলার অন্যতম মৎস্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আফিল এ্যাকোয়া ফিস। ২ হাজার বিঘা জমির ওপর ৮টি ইউনিট চালু রয়েছে তাদের। যেখানে প্রতিদিন ১০ টন মাছ ও মাছের পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে। এখানে ২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে।
আফিল গ্রুপের পরিচালক মাহবুব আলম লাভলু জানান, শার্শা উপজেলার মান্দারতলার জলাবদ্ধ এলাকায় মৎস্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে গড়ে তোলা হয় এ্যাকোয়া ফিস ফার্ম। এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে আফিল এ্যাকোয়া ফিসে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে বিলুপ্ত প্রায় দেশীয় বিপুল মাছ উৎপাদন করা হচ্ছে। যেখানে মাছের গুণগতমান সঠিক রাখা হয়েছে। এতে করে একদিকে যেমন এলাকার মানুষ জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে, তেমনি মানুষের কর্মসংস্থান করা হয়েছে।
ঝিকরগাছা উপজেলার রঘুনাথনগর গ্রামের মৎস্য চাষি ফারুক আহমেদ জানান, তিনি ৩২ বছর ধরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদন করে আসছেন। ৫২ বিঘা জমির ওপর তার মৎস্য ঘের রয়েছে। যেখানে বছরে মাছ উৎপাদন হচ্ছে কোটি টাকার। এর মধ্যে পাবদা মাছ বছরে রপ্তানি করেন ৪০ টন। বর্তমানে তার ঘেরে পাবদা, টেংরা, রুই ও ভেটকি মাছ চাষ হচ্ছে।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সুব্রত মণ্ডল জানান, যশোর মৎস্য চাষে অনেক আগে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এখানকার মাটি ও পানি মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত। যে কারণে ভালোমানের মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে।
জেলা মৎস্য অফিসের সহকারী পরিচালক মাহবুবুর রহমান জানান, বছরে বেনাপোল দিয়ে মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে প্রায় ৬০ লাখ কেজি। যার রপ্তানি মূল্য ১৫০ কোটি ডলার।
প্রশাসনিক দূরদর্শিতা ও মাছচাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে জেলায় অতিরিক্ত মাছ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত রাখতে যশোরে স্থাপন করা হয়েছে মাছের পোনার আধুনিক বিক্রয় কেন্দ্র। এ ছাড়া দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ বৃদ্ধি, রুই মাছের জাত উন্নয়ন, বাঁওরের রুই জাতীয় মাছের ব্রান্ডিংকরণ, রুইজাতীয় মাছের গুণগতমানের রেণু উৎপাদন নিশ্চিত করা, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোর জন্য মৎস্য হ্যাচারিতে পানির রিসাইক্লিং পদ্ধতি সম্প্রসারণ, নিরাপদ মৎস্য খাদ্য ও নিরাপদ মাছ উৎপাদন নিশ্চিত করা, রোগ শনাক্তকরণ এবং বিষাক্ততা পরীক্ষণ ল্যাব স্থাপন করাসহ ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য সম্প্রসারণকর্মীর অভাব দূরীকরণে উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে যশোরের মাছ চাষিদের সার্বিক উন্নয়নে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরকার মোহাম্মদ রফিকুল আলম জানান, গত তিন বছরে জেলায় চাহিদার তুলনায় ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৫ টন মাছ বেশি উৎপাদন হয়েছে। মাছ উৎপাদনে খুলনা বিভাগের মধ্যে যশোর প্রথম স্থানে রয়েছে। প্রতি বছর এ জেলায় মাছ উৎপাদন বাড়ছে।