কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলায় শতাধিক হাঁসের হ্যাচারি বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ বাচ্চা মারা যাওয়ার হার বেড়ে গেছে। তুষপদ্ধতিতে ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং ডিমের দাম বেড়েছে। স্থানীয় কৃষকরা জানান, ব্যবসা চালিয়ে যেতে সমস্যা হচ্ছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস বলেছে, পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে এবং বাচ্চার মৃত্যুর কারণ খুঁজতে ঢাকায় নমুনা পাঠানো হবে।
হাওর অঞ্চলে দুই দশকের বেশি সময় ধরে এই ব্যবসায় জড়িত আছেন অনেক কৃষক। ছোট-বড় ও মাঝারি এসব হ্যাচারিতে কাজ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অনেক তরুণ বেকার যুবকের। তাছাড়া দামিহা ইউনিয়নটি হাঁসের বাচ্চার গ্রাম হিসেবেই বেশি পরিচিত।
তুষপদ্ধতিতে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটাতে মাত্র এক মাস সময় লাগে। প্রথমে ডিমগুলোকে রোদে দিতে হয়। এক দিন রোদ লাগানোর পর সেগুলো সিলিন্ডারে বসানো হয়। ওই সিলিন্ডার তৈরি করা হয় বাঁশের তৈরি ধাড়ি (ছাঁচ) দিয়ে। তার পর ধাড়ির ভেতরে ধানের তুষ দিয়ে পরিপূর্ণ করা হয়। একটি সিলিন্ডারে ১ হাজার ডিম রাখা যায়। সিলিন্ডারের পাশে একটি স্থানে তাপ দেওয়া হয়। তিন ঘণ্টা পর পর ডিমগুলো নড়াচড়া করতে হয়।
এভাবে ২০ থেকে ২৫ দিন তাপ দেওয়ার পর ডিমগুলো একটি চটে বিছিয়ে রাখা হয়। পরে ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। ১ হাজার ডিম থেকে ৭০০ বাচ্চা হয়। ভালো ডিম হলে বাচ্চার পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। প্রতিটি ডিম ১০ থেকে ১২ টাকা দরে কেনেন খামারিরা। এক দিনের হাঁসের বাচ্চার দাম হয় সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ টাকা। বাচ্চার চাহিদা অনুযায়ী মূল্য ওঠানামা করে। এ ছাড়া ডিমের দামের ওপর বাচ্চার দাম অনেক সময় কমবেশি হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানোর কারণে তাড়াইলের হাঁসের বাচ্চার চাহিদা রয়েছে সারা দেশে।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাহেলা গ্রামের ক্ষুদ্র হ্যাচারিগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন অনেকে। এর মধ্যে বেশির ভাগ হ্যাচারিতে বাচ্চা মারা যাওয়ার কারণে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। বন্ধ হওয়া হ্যাচারির কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাঁসের বাচ্চার চাহিদা রয়েছে, তবে সম্প্রতি বিভিন্ন কারণে ব্যবসায়ীরা হ্যাচারি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমানে ডিমও চড়া মূল্যে খামারিদের কাছ থেকে কিনতে হয়। ডিম বেশি দাম দিয়ে কিনলেও পরিশ্রমের তুলনায় প্রতিটি বাচ্চার মূল্য কম।
তাড়াইল উপজেলার ৫ নম্বর দামিহা ইউনিয়নের রাহেলা ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আলাল উদ্দিন ব্যাপারীর ছেলে মো. মোতাহার ১৭ বছর ধরে হাঁসের হ্যাচারি চালাচ্ছেন। তিনি বর্তমানে চারটি হ্যাচারি থেকে ৩ লাখ বাচ্চা উৎপাদন করেন। তিনি তুষ ও হারিকেনের তাপে বাচ্চা উৎপাদন করেন। সারা বছরই তিনি হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন করেন। মোতাহারকে দেখে রাহেলা গ্রামের অনেক কৃষক ওই ব্যবসায় উৎসাহী হয়েছেন। কর্মসংস্থান করেছেন আরও ছয়জন বেকার যুবকের।
রাহেলা ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আব্দুস সাত্তারের ছেলে মো. রাসেল, জসিমের ছেলে মো. তানভীর, আব্দুস সাত্তারের ছেলে মো. মেহেদী হাসান, হেকিমের দুই ছেলে মোকাররম ও মোতাহার, মো. শাহেদের ছেলে শহীদ বর্তমানে মোতাহারের হ্যাচারিতে কর্মরত রয়েছেন। এদের মধ্যে তিনজন স্থানীয় মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি হ্যাচারিতে কাজ করছেন। হ্যাচারির হাঁসের বাচ্চা ৫৫ শতাংশ মারা যায় জন্মের তিন দিনের মধ্যে। বাচ্চা পশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও ডাক্তার বলতে পারেননি কেন বাচ্চাগুলো মারা যাচ্ছে।
মোতাহারের আপন চাচাতো ভাই লোকমানেরও হাঁসের হ্যাচারি রয়েছে। ছোট ভাইকে দেখে তিনিও ২০০৯ সাল থেকে এই ব্যবসায় নামেন। তবে ব্যবসার এত বছরেও কখনো এমনভাবে বাচ্চা মারা যায়নি। লোকমানের বাবা গিয়াস উদ্দিন ব্যাপারী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার ছেলে প্রতি মাসে ১ লাখ বাচ্চা উৎপাদন করত। এখন এর অর্ধেক বাচ্চা উৎপাদন হয়। তার পরও সেগুলোর তিন ভাগের দুই ভাগই মারা যাচ্ছে। এ বছর আমার ছেলে ব্যবসায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
একই গ্রামের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউসুফ আলী খানের ছেলে মো. ইদ্রিস খানেরও হাঁসের হ্যাচারি রয়েছে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই বছরটা শুধু বাচ্চা মারা যাচ্ছে। তিন দিন হলেই অর্ধেকের বেশি বাচ্চা মারা যায়। জুলাই মাসে ১০ হাজার বাচ্চার মধ্যে মাত্র ১ হাজার বাচ্চা বেঁচে ছিল। ২০১২ সাল থেকে খামার দিয়েছি, এই পর্যন্ত এভাবে কখনো বাচ্চা মারা যায়নি।’ উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে কোনো কর্মকর্তা খোঁজ না নেওয়ার অভিযোগও করেন তিনি।
তাড়াইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. নূরজাহান বেগম সোনিয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত ২২ আগস্ট আমরা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে হ্যাচারি মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। সেখানে যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করতে গিয়েছি। তারা সন্দেহ করছেন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাচ্চাগুলো মারা যাচ্ছে। আসলে বাচ্চাগুলো ভাইরাসের জন্য মারা যাচ্ছে না, সেটা আমরা তাদের বুঝিয়ে বলেছি।
ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হওয়ার পর ৫০টি বাচ্চার জন্য আলাদা আলাদা পানির পাত্র দিতে হয়। যেখানে ১০ হাজার বাচ্চার মধ্যে শুধু মাত্র একটা বা দুটা পানির পাত্র দেওয়া হয়। পানি না পেলে বাচ্চাগুলো বেঁচে থাকবে কীভাবে? যখন গরম পড়ে তখন পানির অপ্রতুলতার কারণে বা গরমের কারণে মারা যায়। তবে এখন যেগুলো মারা যাচ্ছে প্রয়োজনে সেগুলো ঢাকায় ল্যাবে পাঠিয়ে পরীক্ষা করা হবে। দামিহা ইউনিয়নের প্রায় দেড় শতাধিক হাঁসের খামার রয়েছে।
অনেকেই সিজনাল ব্যবসায়ী, তারা সিজনে ব্যবসা করেন। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী এই হ্যাচারির বাচ্চা উৎপাদনে দিনরাত কাজ করেন। এর মধ্যে যারা ক্ষুদ্র পরিসরে হ্যাচারি দেন, তারা সিজনাল ব্যবসা করেন। তবে যারা সারা বছর হাঁসের হ্যাচারি চালান, তারা গরমকালে বিপাকে পড়েন। এ বিষয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে হাঁসের হ্যাচারি ব্যবসায়ীদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. সুভাষ চন্দ্র পণ্ডিত খবরের কাগজকে বলেন, ‘সম্প্রতি হাঁসের হ্যাচারিতে বাচ্চা মারা যাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে আমি জেনেছি। ইতোমধ্যে হ্যাচারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরেজমিন গিয়ে দেখা করা হয়েছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন। হ্যাচারির মালিকদের কিছুটা অবহেলা আছে। ওখানে কোনো রোগ বা ভাইরাস নেই। বাচ্চাগুলো ডিম থেকে ফোটার পর যেখানে ৫০০ বাচ্চা রাখার জায়গা সেখানে ৫ হাজার বাচ্চা রাখা হয়। দ্রুত বিক্রি করে দেবে, সেজন্য তারা আলাদাভাবে কোনো যত্ন নেয় না।
বাচ্চাগুলো ঠিকভাবে খাবার পানি পায় না। ফলে অনেকটা দুর্বল হয়ে অথবা গরমে মারা যাচ্ছে। অনেকটা অবহেলার কারণে হ্যাচারির বাচ্চাগুলো মারা যাচ্ছে। তবুও আমি তাদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য তাড়াইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছি।'