যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের প্রচারের একটি অন্যতম অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে মার্কিন অর্থনীতি। এই বিতর্কের মূল প্রশ্নটি হলো, ‘কার সময়ে মার্কিন অর্থনীতি ভালো ছিল, জো বাইডেন নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্পের?’
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস দাবি করেছেন, ‘অনেক সূচকে আমাদের অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী।’
অন্যদিকে রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমাদের দেশের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থনীতি তৈরি করেছি আমরা এবং বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসন এটিকে ধ্বংস করেছে।’
এখন আমরা দুটি প্রেসিডেন্সির অধীনে অর্থনৈতিক সক্ষমতা তুলনা করার কিছু মূল সূচক বিশ্লেষণ করে দেখব যে, কার শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
যদিও কোভিডের প্রভাবের কারণে দুই প্রেসিডেন্টের সময়কালের মধ্যে তুলনা করাটা কঠিন হয়ে পড়েছে, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির কারণে মজুরি নিয়ে রীতিমতো সংগ্রাম করা সত্ত্বেও দুজনের সময়কালেরই কিছু উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সাফল্য রয়েছে।
প্রথমে মার্কিন অর্থনীতিতে সমস্ত পণ্য ও পরিষেবার মূল্য যাকে বলা হয় মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), এই সূচকটি ব্যবহার করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া যাক।
কোভিডের সময় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় জিডিপিতে নাটকীয় পতন ঘটেছে। মহামারির পরে ট্রাম্পের অধীনে অর্থনীতি দৃঢ়ভাবে ফিরে এসেছে এবং অন্য অনেক পশ্চিমা দেশের তুলনায় ভালো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হয়েছে।
বাইডেনের অধীনে এই পুনরুদ্ধার অব্যাহত রয়েছে। সেই সঙ্গে জিডিপির হিসেবে জি৭ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে শক্তিশালী মহামারি পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হয়েছে।
তবে ট্রাম্প নিজে দাবি করলেও তার ৪ বছরের সময়কালে মার্কিন ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থনীতি ছিল না। জানুয়ারি ২০১৭ থেকে জানুয়ারি ২০২১-এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৩০ শতাংশ। এই সময়ের মধ্যেই কোভিড মহামারির ফলে অর্থনৈতিক মন্থরতা এবং একই সঙ্গে মহামারি-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের অধীনে এখনো পর্যন্ত এই হার ২ দশমিক ২০ শতাংশ রয়েছে, যা প্রায় একই। অতীতে এমন কিছু সময় ছিল যখন জিডিপির প্রবৃদ্ধি ট্রাম্প ও বাইডেন দুজনের অধীনের গড় থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল। যেমন ১৯৭০-এর দশকে।
মুদ্রাস্ফীতি
বর্তমানে যে হারে পণ্য ও সেবার দাম বাড়ছে তা নির্বাচনি প্রচারণায় একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইডেনের সময়ে প্রথম দুই বছরে দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এর মধ্যে ২০২২ সালের জুনে মুদ্রাস্ফীতির হার ৯ দশমিক ১০ শতাংশের ওপরে চলে গেছে।
ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘সর্বকালের সবচেয়ে খারাপ মুদ্রাস্ফীতি’ অনুভব করেছে। কিন্তু এটি সত্য নয়। ১৯৮১ সালে মুদ্রাস্ফীতি শেষবার ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্য কয়েকটি সময়ে এটি অনেক বেশি ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি এখন প্রায় ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে ট্রাম্পের ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার সময় যে হার ছিল, এটি সে তুলনায় এখনো বেশি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মুদি পণ্যের দাম ২০২২ সালের আগস্টে শেষ হওয়া বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ বেড়েছে। বাইডেন প্রশাসনের অধীনে এটি ছিল সর্বোচ্চ এবং পরে মূল্য কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। মুদি পণ্যের দাম ২০২৩ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ১ দশমিক ১০ শতাংশ বেড়েছে। সাম্প্রতিক দাম বাড়ার প্রবণতাটি অন্য অনেক পশ্চিমা দেশের সঙ্গে তুলনীয়, যেই দেশগুলো ২০২১ ও ২০২২ সালে উচ্চমুদ্রাস্ফীতির হার অনুভব করেছিল। এর কারণ কোভিডে প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইন সমস্যা এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ দাম বাড়ায় অবদান রেখেছে।
তবে কিছু অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ২০২১ সালে পাস হওয়া বাইডেনের ১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার ‘আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যান’ও মূল্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছিল। কারণ অর্থনীতিতে নগদ অর্থ ঢালার (ইনজেকশন অব ক্যাশ) ফলে দাম আরও বেড়েছে।
কর্মসংস্থান
বাইডেন প্রশাসন বারবার একটি বড় অর্জন হিসেবে চাকরি ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করেছে। কোভিডের কারণে ২০২০ সালে বেশি পরিমাণ মানুষ চাকরি হারানোর আগে, ট্রাম্পের সময়ের প্রথম তিন বছরে প্রায় ৬৭ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বাইডেন প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রায় ১ কোটি মানুষকে চাকরি দেওয়া হয়েছে।
বাইডেন দাবি করেছেন, এটি আমেরিকার ইতিহাসে যেকোনো রাষ্ট্রপতির যেকোনো সময়ে সবচেয়ে দ্রুত চাকরি প্রবৃদ্ধির রেকর্ড।
খবরে বলা হয়, ১৯৩৯ সালে রেকর্ড শুরু হওয়ার পর থেকে চাকরির পরিসংখ্যানগুলো দেখলে বুঝতে পারবেন এটা সঠিক। তবে দেশটি মহামারি লকডাউন থেকে বেরিয়ে আসায় বাইডেন প্রশাসন অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে তীব্র প্রত্যাবর্তন থেকে উপকৃত হয়েছে।
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মার্ক স্ট্রেন বলেছেন, ‘২০২০ সালে ট্রাম্প জিতলে অনেক আরও অনেক কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু বাইডেনের ‘আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যান’ শ্রমবাজার পুনরুদ্ধারের গতি ও বলিষ্ঠতার ওপর একটি বড় প্রভাব ফেলেছে। ২০২১ সালে বাইডেন প্রশাসনের অধীনে পাস করা এই ব্যয় পরিকল্পনাটি মহামারি-পরবর্তী অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করতে সহায়তা করার জন্য নেওয়া হয়েছিল।
এদিকে মহামারির আগে ট্রাম্প প্রশাসন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেকারত্বের হার ঘোষণা করেছিলেন। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো কোভিডে লকডাউন ব্যবস্থার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার বেড়েছিল। ট্রাম্প দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়ার সময় বেকারত্বের হার প্রায় ৭ শতাংশে নেমে এসেছিল। বাইডেন প্রশাসনের অধীনে বেকারত্ব ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৩ দশমিক ৪০ শতাংশে নামে, যা গত ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন হার। তবে শেষ পর্যন্ত এটি ৪ দশমিক ৩০ শতাংশে নেমেছে।
মজুরির ক্ষেত্রে দুই সময়ের পার্থক্য
ট্রাম্পের অধীনে মজুরি বেড়েছে। কিন্তু মহামারির অভিঘাত আসার আগ পর্যন্ত তার পূর্বসূরি বারাক ওবামার সমান হারে মজুরি বেড়েছে।
কোভিড মহামারির শুরুতে শ্রমিকদের বেতন দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে বেতনের এই হঠাৎ বৃদ্ধির কারণ ছিল, কম বেতন পাওয়া শ্রমিকদের বরখাস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকা, যার ফলে কর্মরত ব্যক্তিদের গড় বেতন বৃদ্ধি পেয়েছিল। অন্যদিকে বাইডেনের অধীনে গড় সাপ্তাহিক আয় বেড়েছে, কিন্তু তারা উচ্চমুদ্রাস্ফীতির কারণে দাম বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে লড়াই করেছে।
আর্থিক বাজার
যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার বৃহত্তর অর্থনীতির প্রতিফলন নয়। তবে অনেক আমেরিকানদের বিনিয়োগ রয়েছে এখানে। সে কারণে এটির কর্মক্ষমতা কিছুটা হলেও গুরুত্ব বহন করে।
ডাও জোন্স সূচক হলো মার্কিন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ৩০টি বড় কোম্পানির কর্মক্ষমতা পরিমাপ।
ট্রাম্পের সময়ে এটি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল। তবে বাজারগুলো মহামারিতে খারাপ অবস্থায় পড়ে এবং এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের অধীনে করা লাভের সবটাই হারিয়ে বিপর্যস্ত হয়। তবে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প অফিস ছেড়ে যাওয়ার সময় আর্থিক বাজারগুলো প্রাক-মহামারি স্তরের চেয়েও বেশি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। বাজারগুলো বাইডেনের অধীনে ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা ধাক্কা লেগেছে, তা সত্ত্বেও বাজারগুলো বাইডেন প্রশাসনের অধীনে রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছে।
[বিবিসির প্রতিবেদন থেকে ভাবানুবাদ করেছেন ইসমাঈল হোসাইন সোহেল]