ফেনীতে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় আড়াই হাজারেরও বেশি পোলট্রি ও ডেইরি শিল্পের উদ্যোক্তা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেক খামারির সহায়-সম্পত্তি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্যমতে, এ বন্যায় প্রাণিসম্পদ খাতে ৩৯৬ কোটি ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৪০৩ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এতে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি সব মিলিয়ে ৩০৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে সরকার আর্থিক প্রণোদনার আশ্বাস দিয়েছে।
ফেনী সদর উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের আবদুল কুদ্দুস সৌদি আরব থেকে দেশে এসে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখে ছিলেন। তিনি ধার-দেনা, ব্যাংক ঋণ ও নিজের সঞ্চয় করা ৬০ লাখ টাকা দিয়ে শুরু করেন পোলট্রি ব্যবসা। দুই বছর ভালো চলছিল আয়-রোজগার। কিন্তু হঠাৎ গত ২৩ আগস্ট তার জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ। বন্যায় তার খামারে থাকা ৩ হাজার লেয়ারসহ বয়লার ও সোনালি ৫ হাজার মুরগি কেড়ে নেয়। সহায়-সম্পত্তি সব হারিয়ে এখন তিনি নিঃস্ব।
শুধু আবদুল কুদ্দুসই নন, জেলায় প্রায় আড়াই হাজার খামারি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এই অবস্থায় তারা অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন। নিঃস্ব হয়ে গেছেন লেয়ার, বয়লার ও সোনালি মুরগির পাশাপাশি গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া খামারিরাও। সব হারিয়ে হয়ে পড়েছেন নিঃস্ব।
সোনাগাজীর আমজাদ হোসেন নামে এক খামারি বলেন, ‘বন্যার ১৫ দিন আগে খামারে মুরগি নিয়েছিলাম। কোনো কিছুই সরাতে পারিনি। দেড় হাজার মুরগি, সঙ্গে খাবারসহ সব জিনিসপত্র পানিতে ভেসে গেছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখন যদি স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে অনেকে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারব।’
সদর উপজেলার লেমুয়া ইউনিয়নের আবদুর রাজ্জাক নামে আরেক খামারি বলেন, ‘তিনটি গরু পালন করে কোনোমতে অভাবের সংসার সামলে নিচ্ছিলাম। বন্যায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। পরিবার নিয়ে একটি আশ্রয়কেন্দ্র গিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পারলেও গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি বন্যার পানিতে রেখে যেতে হয়েছে। পানি নামার পর বাড়ি ফিরে এগুলোর আর কিছুই পাইনি।’
জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্যমতে, এবারের বন্যায় প্রাণিসম্পদ খাতে এখন পর্যন্ত ৩৯৬ কোটি ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৪০৩ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। বন্যার পানিতে নিমজ্জিত ছিল ফুলগাজী, পরশুরাম ও ফেনী সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়। জেলার ছয় উপজেলায় ৩৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ৩৮ হাজার ৭৩১টি গরু, ৩৫৯টি মহিষ, ১৫ হাজার ৫৮৮টি ছাগল ও ৭৩৬টি ভেড়া মারা গেছে। এ ছাড়া ২১ লাখ ৬৭ হাজার ৫১০টি মুরগি ও ১ লাখ ৮৯ হাজার ৪৭২টি হাঁস মারা গেছে। মৃত পশুপাখির মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৮ কোটি ৩৬ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩০ টাকা।
সূত্র জানায়, জেলায় ৪২ লাখ ৪৯ হাজার ৯৬৩টি গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। ১ হাজার ৯৯২টি গবাদিপশুর খামারের ১৩ কোটি ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ টাকা এবং ১ হাজার ৬২৩টি হাঁস-মুরগির খামারের ১০ কোটি ৯৭ লাখ ৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ৩ হাজার ৯৫০ টন পশুপাখির দানাদার খাবার বিনষ্ট হয়েছে, যার বাজারমূল্য ২৩ কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। জেলায় ৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার খড়, ৩ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার টাকার পশুপাখির ঘাস বিনষ্ট হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে ২৮৫ একর চারণভূমি।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বন্যায় জেলার প্রাণিসম্পদ খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৯৬ কোটি ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৪০৩ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’