যশোরে নতুন করে সম্ভাবনা দেখাচ্ছে ওলের চাকি আবাদ। কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় চাষিরা ওল ও ওলের চাকি (বীজ) আবাদে ঝুঁকছেন। বিশেষ করে যশোরের মণিরামপুর উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামে ওলের চাকি উৎপাদনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সুফল বয়ে এনেছে। এই গ্রামের অধিকাংশ চাষি ওল চারার আবাদে ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। ওল চাকির চাষাবাদে এলাকায় গড়ে উঠেছে বিশাল এক বাজার। মৌসুম চলাকালে হাটবার ছাড়াও বাজারের আড়তগুলোয় প্রতিদিন চাকি কেনাবেচা হয় লক্ষাধিক টাকার। এক মৌসুমে কোটির টাকার ওপর ওলের চাকি বিক্রি হয় বলে চাষিরা জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে ওল-চাকির বাণিজ্যিক চাষাবাদ ঘিরে গ্রামের অর্থনীতির এখন চাঙ্গাভাব।
যশোরের মণিরামপুর উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামের চাষিরা জানান, এ গ্রামে ১০০ বিঘার ওপর ওলের চাকির আবাদ হয়। খরচ কম, লাভ বেশি হওয়ায় বছরের পর বছর ধরে ফসলটির আবাদ চলে আসছে। প্রতি বছর এখানে প্রায় ৮ হাজার মণ চাকির উৎপাদন ও বিক্রি হয়। বৈশাখ থেকে তিন-চার মাসে চাকির ব্যবসা ঘিরে বাসুদেবপুর বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ওলের চাকির বেচাকেনা থেকে চাষিদের ঘরে এই সময়টায় পর্যাপ্ত সমাগম ঘটে।
তারা আরও জানান, বাসুদেবপুর বাজারের প্রায় ৫০টির মতো আড়ত থেকে প্রতিদিন ওলের চাকি বিক্রি হয়। ফসলটির উৎপাদকদের হাত ধরেই এই বাজার গড়ে উঠেছে। যশোরসহ আশপাশের জেলা থেকে ওলের চাকি নিতে আসেন ক্রেতারা। বাসুদেবপুরে প্রতি মৌসুমে প্রায় কোটি টাকার ওলের চাকি বিক্রি হয়।
চাষি আসলাম হোসেন জানান, একেক বিঘা জমিতে ওলের চাকির ফলন হয় ৭০ থেকে ৮০ মণ। মানভেদে এসব চাকি ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হয়। আড়তগুলোয় কেজি দরে বিক্রি হয় এটি। ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম ওজন হলে এগুলো বাজারে তোলা হয়। পূর্ণাঙ্গভাবে বড় করে তরকারির হাট-বাজারে বিক্রির জন্য কৃষকরা কিনে নিয়ে যান। বৈশাখ মাস থেকে জমিতে ওলের বীজ বপন করতে হয়। ওলের পূর্ণতা পেতে পুরো ছয় মাস সময় লাগে। সেই হিসাবে চলতি মাসেই বাজারে খাবার উপযোগী ওল উঠতে শুরু করবে।
কৃষক আবু আব্দুল্লাহ জানান, বাসুদেবপুর ছাড়াও আশপাশের গ্রামেও এখন ওলের চাকির চাষাবাদ হচ্ছে। লাভজনক হওয়ায় নিজের ছাড়াও বাড়তি জমি লিজ নিয়ে অনেকে এটির চাষাবাদ করেন। তিনি জানান, বিঘাপ্রতি আবাদে ৭০ থেকে ৮০ মণ ফল আসে। এক্ষেত্রে আবাদ খরচ হয় ৪০-৪৫ হাজার টাকা। ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে আড়তে বিক্রি করে পাওয়া যায় ৮০-৮৫ হাজার টাকা। পোকা লাগায় কীটনাশক খরচ নেই। জমির মাটি তৈরি, সেচ, সার ও শ্রমিক বাবদ খরচ হয়।
ওল চাকি ব্যবসায়ী আব্দুর গফফার জানান, কোনো কোনো দিন একেকটি আড়তে ৪ মণ ওলের চাকিও বিক্রি হয়। সকাল সকাল ক্রেতারা ওলের চাকি কিনতে চলে আসেন। আড়তে স্তূপ জমা করে রাখা থেকে পছন্দমতো আকৃতির চাকি তারা কিনে বাড়ি ফিরে যান। যশোরের বাইরে থেকেও ক্রেতারা আসেন। এটির ব্যবসা মূলত সিজনাল। বৈশাখ থেকে তিন মাস পর্যন্ত চলে।
তিনি আরও জানান, কৃষকদের বিপুল পরিমাণ ওলের চাকির আবাদ ঘিরে বাসুদেবপুর গ্রামে ৫০টির মতো আড়ত গড়ে উঠেছে। এসব আড়তে বাসুদেবপুরের জমিতে উৎপাদিত ওলের চাকি এনে বিক্রি হয়। আড়তগুলোয় গড়ে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ মণ ওলের চাকি বিক্রি হয়। যশোরে ওলের চাকি আবাদ ঘিরে নতুন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
মণিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঋতুরাজ সরকার জানান, কৃষি অর্থনীতিতে ওলের চাকি উৎপাদনে বাসুদেবপুর গ্রাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নানা সময় আমরা চাকি চাষিদের পরামর্শ দিয়ে থাকি। যশোর অঞ্চলে এটি একটি সম্ভাবনাময় চাষ।
এদিকে যশোর জেলায় ওল চাষও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে মাদরাজি জাতের ওল চাষ বেশি হয়। যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আবু তালহা জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় ওল চাষ হয়েছে ৫৬০ হেক্টর জমিতে। এতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ হাজার ১৬৯ টন। আর গত বছর চাষ হয়েছিল ৫৩০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয় ১৩ হাজার ২৫০ টন।
যশোর সদরের ওল চাষি হাসান গালিব জানান, তিনি চলতি বছর ১০ মণ ওলের চাকি চারা রোপণ করেছেন। এতে ১ হাজার পিস ওল উৎপাদন হবে। ওজন হবে ৩-৫ কেজি। বাজারে দাম পেলে খরচ বাদে প্রায় ১ লাখ টাকা লাভ হবে বলে তিনি আশা করছেন।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক কৃষিবিদ ড. সুশান্ত সরকার জানান, ওল একটি সবজি যা অনেকেই খেতে ভালোবাসেন। ওলে রয়েছে প্রচুর পুষ্টিকর উপাদান। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালোরি, ফ্যাট, প্রোটিন, পটাসিয়াম, দ্রবণীয় ফাইবার পাশাপাশি ভিটামিন বি-৬, ভিটামিন বি-১, রাইবোফ্লাভিন, ফলিক অ্যাসিড, নিয়াসিন ইত্যাদি জাতীয় পুষ্টি রয়েছে। এ ছাড়া ভিটামিন এ, বিটা ক্যারোটিন জাতীয় পুষ্টি পাওয়া যায়, যা শরীরকে রোগ থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে।