ইসলামী ব্যাংকের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের অসত্য ও অপেশাদার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে এস আলম গ্রুপ। গ্রুপের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ‘এস আলম গ্রুপে ইসলামী ব্যাংকের কোনো বিনিয়োগ খেলাপি হয়নি। বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায় ক্ষতি হলেও এস আলম গ্রুপ ব্যাংকের পাওনা যথাযথভাবে পরিশোধ করে এসেছে।’
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকটির নতুন পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভা শেষে ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ সাংবাদিকদের বলেন, ব্যাংকটি ঋণ হিসেবে যত অর্থ বিতরণ করেছে, তার অর্ধেকের বেশি টাকা একাই নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। তিনি আরও বলেছেন, এসব ঋণের পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখন বের করা হচ্ছে।
এস আলমের ঋণের বিপরীতে যেসব সম্পদ বন্ধক দেওয়া আছে, তারও পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। কারণ, এসব সম্পদের দাম বেশি দেখিয়ে ঋণ বের করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা একাই বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ।
উল্লেখ্য, এস আলম গ্রুপ ও এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিরা ব্যাংকটির ৮২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছেন।
এস আলম গ্রুপ গতকাল বিবৃতিতে জানায়, ‘এস আলম গ্রুপে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ব্যাংকটির নবনিযুক্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্য আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তার এ মিথ্যা, মনগড়া আর ভিত্তিহীন বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
প্রকৃতপক্ষে এস আলম গ্রুপ ১৯৮৯ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ সুবিধা গ্রহণ করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। এ দীর্ঘ পথযাত্রায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সুবিধা গ্রহণ করে আমাদের গ্রুপের যেমন অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তেমনি ব্যাংকও আমাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করেছে। আজ পর্যন্ত আমাদের কোনো বিনিয়োগ খেলাপি হয়নি। বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায় ক্ষতি হলেও আমরা ব্যাংকের পাওনা যথাযথভাবে পরিশোধ করে এসেছি।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান কোনো পরিসংখ্যান না দিয়ে বিভিন্ন স্বনামধন্য গ্রুপের বিনিয়োগ আমাদের গ্রুপের নামে চালিয়ে দিয়েছেন; যা অত্যন্ত অন্যায় এবং ব্যাংকের বিনিয়োগ আদায়কে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। আমরা দেখেছি নাবিল গ্রুপ, রংধনু গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ, এননটেক্স গ্রুপ এবং আরও কিছু কোম্পানি এবং ব্যক্তির নামে গৃহীত বিনিয়োগ আমাদের বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে এসব গ্রুপ ও ব্যক্তির সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে আমাদের ব্যবসায়িক লেনদেন আছে এবং এর বাইরে আমাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু আছে বলে কোনোভাবেই প্রমাণ হয়নি; যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। একটি বৃহৎ ব্যবসায়িক গ্রুপ হিসেবে অনেক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এবং গ্রুপের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়িক লেনদেন পরিচালিত হয়ে থাকে।
লেনদেন পরিচালিত হওয়া মানে তা আমাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, এটা কোনোভাবে হতে পারে না। আলোচিত নাবিল গ্রুপের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়িক লেনদেন আছে সত্য, কিন্তু বিভিন্ন কোম্পানির নামে গৃহীত বিনিয়োগের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এসব কোম্পানির সঙ্গে আমাদের ভিন্ন কোনো লেনদেনও নেই।
আমরা আরও লক্ষ করেছি যে, নাবিল গ্রুপের কর্ণধার আমিনুল ইসলামের বাবার কোম্পানির নামে গৃহীত বিনিয়োগও আমাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বলে দেখানো হয়েছে। আমরা আশঙ্কা করছি যে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের এহেন অপেশাদার আচরণের ফলে প্রকৃত বিনিয়োগ গ্রহীতাদের বিনিয়োগ ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে দায়মুক্তি দেওয়ার ষড়যন্ত্র এবং আমাদের ব্যবসায়িক সুনাম এবং ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হলে একটি পক্ষ আমাদের ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিয়ে ঢালাওভাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে আসছে। এর আগ থেকে কয়েকটি মিডিয়া ধারাবাহিকভাবে আমাদের গ্রুপ এবং ব্যবসা নিয়ে নেতিবাচক প্রচার চালিয়ে আসছিল, যার ধারাবাহিকতা আমরা লক্ষ করছি। ওই সব মিডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আমাদের গ্রুপে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি বিশেষ নিরীক্ষা চালানো হয়েছিল; যাতে আমাদের গ্রুপের প্রকৃত বিনিয়োগ উঠে এসেছিল।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের অনুরোধ যেন সঠিকভাবে বিনিয়োগের পরিসংখ্যান জাতির সামনে পেশ করা হয়। অন্যথায় আমরা আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হব।’
গত ২২ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েক ধাপে সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
গতকালই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে প্রথম বৈঠক করেন তিনি। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ২০২২ সাল থেকে ব্যাংকে তারল্যসংকট শুরু হয়। এরপর থেকে পরিস্থিতি খারাপ হয় এবং ব্যাংকটির গ্রাহক, শেয়ারধারী ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা রাখতে পারছেন না। এখন ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ে তিনটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা ব্যাংকের ঋণ, বিনিয়োগ ও মানবসম্পদের ওপর নিরীক্ষা করবে। আগে ভালো নিরীক্ষা হয়নি।
ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘হল-মার্ক কেলেঙ্কারিরর পর সোনালী ব্যাংকের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। হল-মার্কের ঘটনা আলোচনায় আসার পরও সোনালী ব্যাংকে আমানত বেড়েছিল। ইসলামী ব্যাংকের সমস্যাটি অনেক বড়। এ জন্য আমরা দায়িত্ব নিয়েই পথনকশা প্রণয়ন করেছি।
প্রতিদিন ব্যাংকে উপস্থিত থেকে তদারকির চেষ্টা করে যাচ্ছি। চলতি বছর পুরোটাই হবে গ্রাহকের আস্থা ফেরানোর বছর। আগামী বছরজুড়েও গ্রাহকের আস্থা ফেরানোর কাজ চলবে। পরের দুই বছর, অর্থাৎ ২০২৬-২৭ সাল হবে ঘুরে দাঁড়ানোর বছর। ২০২৮-৩০ সাল হবে এগিয়ে যাওয়ার বছর।’