কোটা সংস্কার আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কারে হাত দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। অন্যান্য সেক্টরের মতো দেশের শেয়ারবাজারেও সংস্কারের ছোঁয়া লেগেছে। পুঁজিবাজারের উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ।
শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষপদে রদবদল করা হয়েছে। পাশাপাশি শেয়ারবাজারের বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতি অনুসন্ধান করতে সমন্বিত ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন এবং শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং আস্থা ফেরাতে সময়োপযোগী নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন করা হলে শেয়ারবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা দ্রুত ফেরার পাশাপাশি অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতি কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত এক মাসে শেয়ারবাজার সংস্কারের যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো হলো-
শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পাঁচ দিন পর ১০ আগস্ট রাতে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম পদত্যাগ করেন।
বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের পদত্যাগের পর গত ১২ আগস্ট দুজন কমিশনার পদত্যাগ করেন। তারা হলেন অধ্যাপক ড. শামসুদ্দিন আহমেদ ও ড. রুমানা ইসলাম।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০ দিনের মাথায় ১৮ আগস্ট বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে বিশিষ্ট ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি পরের দিন ১৯ আগস্ট বিএসইসিতে যোগদান করেন।
বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যানের যোগদানের এক দিন পর অর্থাৎ ২০ আগস্ট সন্ধ্যায় দুই স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যানসহ সব স্বতন্ত্র পরিচালকের পদত্যাগের বিষয়ে মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর ২১ ও ২২ আগস্ট ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই-সিএসই) চেয়ারম্যানসহ স্বতন্ত্র পরিচালকরা ধারাবাহিতভাবে পদত্যাগ করেন।
২০ আগস্ট ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের শেয়ার কারসাজি অনুসন্ধানে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন বিএসইসির পরিচালক মো. আবুল কালাম, অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মাদ রাকিবুর রহমান এবং উপপরিচালক মোহাম্মাদ আসিফ ইকবাল।
দেশের উভয় শেয়ারবাজারের সব কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে গত ২১ আগস্ট দুটি পরিদর্শন কমিটি গঠন করে বিএসইসি। ডিএসইর পরিদর্শন কমিটির নেতৃত্ব দেন বিএসইসির পরিচালক আবুল কালাম। সিএসসির কমিটির নেতৃত্ব দেবেন বিএসইসির পরিচালক ফখরুল ইসলাম মজুমদার।
শেয়ারবাজারে অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির অভিযোগে গত ২১ আগস্ট শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট ১১ ব্যক্তির বেনিফিসিয়াল ওনার্স অ্যাকাউন্ট (বিও অ্যাকাউন্ট) জব্দ করা হয়। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ ও সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিডিবিএল) নির্দেশ দেয় বিএসইসি। জব্দ হওয়া বিও অ্যাকাউন্টধারীরা হলেন ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি মো. ছায়েদুর রহমান, তার স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম, বিতর্কিত বিনিয়োগকারী সমবায় অধিদপ্তরের উপনিয়ন্ত্রক মো. আবুল খায়ের ওরফে হিরু, তার স্ত্রী ব্রোকার হাউস মোনার্ক হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সাদিয়া হাসান, তার বাবা আবুল কালাম মাতবর, তার বোন কনিকা আফরোজ, তার ভাই সাজেদ মাতবর, মোনার্ক হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান জাবেদ এ মতিন, সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান সিডব্লিউটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিজা চৌধুরী, সদ্য পদত্যাগ করা বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এবং তার ছেলে জুহায়ের শাহরিয়ার ইসলাম।
পুঁজিবাজারের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেস প্রাইভেট লিমিটেডের প্রধান দুই কর্ণধার চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও হাসান তাহের ইমামের বিও অ্যাকাউন্ট গত ২২ আগস্ট জব্দ করা হয়। ডিএসই ও সিএসইর সদস্য প্রতিষ্ঠান মাল্টি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড সার্ভিসেসের অনিয়ম তদন্তসংক্রান্ত বিএসইসির কমিটির কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রেস প্রাইভেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একই সঙ্গে ব্রোকার হাউসটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও পরিচালক জালাল একরামুল কবীরের সব বিও হিসাবও স্থগিত করা হয়।
বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে খন্দকার রাশেদ মাকসুদের যোগদানের তিন দিন পর অর্থাৎ ২২ আগস্ট সংস্থাটির শীর্ষ পদে রদবদল করা হয়। এ রদবদলে বিএসইসির দুই কমিশনারের পাশাপাশি নির্বাহী পরিচালকদের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করা হয়েছে।
বিএসইসি কমিশনারের শূন্য পদে গত ২৮ আগস্ট সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. আলী আকবরকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরের দিন ২৯ আগস্ট তিনি বিএসইসিতে যোগদান করেন। এ ছাড়া গত ৩ সেপ্টেম্বর বিএসইসি কমিশনারের আরেক শূন্য পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ফারজানা লালারুখকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরের দিন ৪ সেপ্টেম্বর তিনি বিএসইসিতে কাজে যোগদান করেন। আগামী চার বছর তারা কমিশনার পদে দায়িত্ব পালন করবেন।
গত ২৭ আগস্ট শেয়ারের দাম বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে পুরোনো সার্কিট ব্রেকারসংক্রান্ত নির্দেশনা (২০২১ সালের ১৭ জুন) পুনর্বহাল করা হয়, ২৮ আগস্ট থেকে যা কার্যকর হয়েছে। এর ফলে শেয়ারের বাজারমূল্য ভেদে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারবে। একইভাবে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারবে। তবে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড (বেক্সিমকো) এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ওপর ফ্লোর প্রাইস অব্যাহত থাকায় সার্কিট ব্রেকার কার্যকর হবে না।
গত ২৮ আগস্ট বিএসইসির ‘দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম’-এর শুভেচ্ছাদূত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নিয়োগ বাতিল করা হয়। সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে শেয়ার কারসাজির অভিযোগ রয়েছে।
গত ২৮ আগস্ট শেয়ারবাজারে যেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিধি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘোষিত ডিভিডেন্ড দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেয় বিএসইসি। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন কোম্পানি ডিভিডেন্ড ঘোষণা করার পরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লভ্যাংশ পাঠায় না। আর এই ধারা দীর্ঘদিন ধরে চলছে আসছে। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা এই বিষয়ে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছেও অভিযোগ দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শেয়ারবাজারে অবশিষ্ট ছয়টি কোম্পানির মধ্যে চারটি শেয়ারদরের সর্বনিম্ন স্তর বা সীমা (ফ্লোর প্রাইস) গত ২৮ আগস্ট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ২৯ আগস্ট থেকে তা কার্যকর হয়েছে। কোম্পানি চারটি হলো খুলনা পাওয়ার, বিএসআরএম, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও শাহজীবাজার পাওয়ার। তবে বেক্সিমকো ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ওপর ফ্লোর প্রাইস বহাল রয়েছে।
মশিউর সিকিউরিটিজে তদন্ত ও পরিচালকদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
মশিউর সিকিউরিটিজের (ট্রেক নং-১৩৪) বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তে সমন্বিত গ্রাহক হিসেবে প্রায় ৬৯ কোটি টাকার ঘাটতি পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ আগস্ট অধিকতর তদন্তের স্বার্থে বিএসইসি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। একই সঙ্গে ব্রোকারেজ হাউসটির কর্তাব্যক্তিরা যেন বিদেশ পালিয়ে যেতে না পারেন, সে লক্ষ্যে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) চিঠি দেয় বিএসইসি।
শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে গত ১ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। গঠিত কমিটির সদস্যরা হলেন যুক্তরাষ্ট্রের টেরা রিসোর্সেস ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং কনসালট্যান্ট জিয়া ইউ আহমেদ, ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর স্পেশালিস্ট ইয়াওয়ার সাইদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মো. শফিকুর রহমান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মো. জিশান হায়দার ও বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম। গঠিত সমন্বিত তদন্ত কমিটি শেয়ারবাজারের বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করবে।
বিএসইসি গত ১ সেপ্টেম্বর ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদে সাতজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করে। ডিএসইর নতুন স্বতন্ত্র পরিচালকরা হলেন মালদ্বীপ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান কে এ এম মাজেদুর রহমান, আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ডিরেক্টর জেনারেল প্রফেসর মেজর জেনারেল (অব.) ডক্টর মো. কামরুজ্জামান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. নাহিদ হোসেন, বাংলাদেশ আর্মির ৪৬ ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মফিজুল ইসলাম রাশেদ, সেন্টার অন ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিকের (সিরডাপ) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মো. হেলালউদ্দিন, মেটলাইফ বাংলাদেশের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার সৈয়দ হাম্মাদুল করীম এবং বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার ও ডিজাস্টার রিকভারি সাইট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, চিফ ইনফরমেশন সিকিউরিটি অফিসার (সিআইএসও) বাংলাদেশ ব্যাংক (লিয়েন) মো. ইসহাক মিয়া।