আমানত ও ঋণের সুদের হারের ব্যবধান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশে। গত দুই দশকের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ। ২০২৩ সালের জুনে এই ব্যবধান ছিল দুই দশমিক ৯৩ শতাংশ।
গত বছরের জুলাই থেকে সুদের হার বাড়তে থাকে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের ওপর ৯ শতাংশ সুদের বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে ৬ মাসের মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল (স্মার্ট) চালু করে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার ধীরে ধীরে বাজারভিত্তিক করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শের সামঞ্জস্য রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নীতি চালু করে। পরে সুদহার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করতে গত মে মাসে ‘স্মার্ট’ নীতি বাতিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, গত এক বছরে আমানত ও ঋণের ওপর সুদ বেড়েছে। তবে আমানতের সুদের হার বৃদ্ধির তুলনায় ঋণের ওপর সুদের হার বাড়ার পরিমাণ বেশি ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত জুনে আমানতের ওপর গড় সুদের হার ১ দশমিক ১১ শতাংশ বেড়ে ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশে দাঁড়ায়। এক বছর আগে তা ছিল ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের জুনে ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ থেকে গত জুনে ঋণের ওপর গড় সুদের হার ৪ দশমিক ২১ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশে দাঁড়ায়। এতে ব্যাংকগুলোর দেওয়া ঋণ ও আমানতের সুদের হারের মধ্যে পার্থক্য বেড়ে হয় ৬ শতাংশের বেশি। সর্বশেষ ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে এমনটি হয়েছিল। ২০০৩ সালের শেষে ঋণ ও আমানতের সুদের মধ্যে পার্থক্য ছিল ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। এ কারণে আমানত ও ঋণের সুদের পার্থক্য গত অর্থবছরের শেষ মাসে দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘এটা অস্বাভাবিক। অনেক বেশি। সুদের হারের এই ব্যবধান প্রমাণ করে ব্যাংকগুলো শেষ পর্যন্ত লাভবান হচ্ছে।’ সুদের হারের ব্যবধান ৩ থেকে ৪ শতাংশ বা বড়জোর ৫ শতাংশের মধ্যে থাকা উচিত বলে মনে করেন তারা।
তাদের মতে, ‘আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সুদের হারে পার্থক্য পাঁচ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।’ সুদের হার বাড়ার সুবিধা সঞ্চয়কারীদের অবশ্যই পেতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে না। অন্যদিকে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় ঋণগ্রহীতারা ঋণ নেওয়া থেকে বিরত থাকায় বাজারভিত্তিক সুদের হার থেকে তারাও সুবিধা পাচ্ছেন না। তাদের পরামর্শ হচ্ছে সুদের হারের ব্যবধান কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত বাজারকে সংকেত দেওয়া।
কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আর্থিক সমস্যায় পড়া ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ বাড়ায়নি। সেখানকার সঞ্চয়কারীরা তাদের আমানত তুলে নিতে সমস্যায় পড়েছেন। তবে তারা ঋণের সুদহার বাড়িয়েছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘কয়েকটি বিদেশি ব্যাংকের সুদের হার কম হওয়ায় আমানত ও ঋণে এর ব্যবধান বেড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ থাকায় অনেকে এখন টাকা রাখার জন্য ভালো ব্যাংক খুঁজছেন। বেশি সুদের সুফল পেতে ও ঝুঁকি এড়াতে অনেকে এখন সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করছেন।’
সুদের হারের বেশি পার্থক্য আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতা উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করে উল্লেখ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মনজুর বলেন, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সুদের হারে পার্থক্য পাঁচ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো হবে আন্তর্জাতিক চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই ব্যবধান ৪ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশে রাখা। তা না হলে বুঝতে হবে সুদের হারে এই বিশাল ব্যবধান আর্থিক খাতের অদক্ষতাকেই তুলে ধরে। এতে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো সুদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। ব্যাংকগুলোকে সুদের হারে যৌক্তিক পার্থক্য রাখতে হবে।