নানা কারণে আবাসন ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। তার পরও কমছে না এই শিল্পে ব্যবহৃত অন্যতম উপকরণ রডের দাম। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে এখনো প্রতি টন রড গ্রেড ভেদে ৮৯ থেকে ৯২ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। ঢাকার বাইরে আরও বেশি দাম। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, বড় বড় আবাসন কোম্পানি থেকে শুরু করে ব্যক্তিপর্যায়ে অনেকে নির্মাণকাজ করলেও সরকার পরিবর্তনের ফলে উন্নয়নের কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। তাই রডের চাহিদা কমে গেছে। তবে চাহিদা কমলেও কমেনি দাম। ক্রেতারা বলেছেন, বিল্ডিং তৈরিতে অনেক খরচ হয় রডের পেছনে। তাই রডের দাম না কমায় তাদের নির্মাণ খরচ বেড়ে গেছে।
মোহাম্মদপুরের মেসার্স বিক্রমপুর স্টিলের ব্যবস্থাপক রাকিব হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এখনো রডের দাম বেশি। আমরা রহিম স্টিল ৮৯ হাজার টাকা টন (১০০০ কেজি), একেএস ৯২ হাজার টাকা টন ধরে বিক্রি করছি। এ ছাড়া মোহাম্মদী স্টিল ৮৪ হাজার টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।’
দুই বছর আগেও অনেক কম দামে বিক্রি হতো এসব রড। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা দাম কমাতে পারি না। মিল মালিকরা হচ্ছেন প্রধান পার্ট। তারা কমালে আমরাও কম দামে বিক্রি করতে পারব। আমরা সামান্য লাভ করি। ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করি। বেশি দাম হলে আমাদেরও খারাপ লাগে। কারণ বিক্রি কমে যায়। দাম কমলে চাহিদা বাড়ে।’ অন্যান্য রড বিক্রেতাদেরও একই কথা। সরকার পরিবর্তন হলেও কমেনি রডের দাম।
আদাবর থানার মেসার্স মদিনা স্টিল করপোরেশনের বিক্রয় ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান বলেন, কয়েক মাস আগেও রডের টন ৯৬ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সে তুলনায় কমেছে। কিছুদিন থেকে রহিম স্টিল ৮৮ হাজার ৫০০ টাকা টন, আনোয়ার ইস্পাত ৮৯ হাজার ৫০০ টাকা ও বিএসআরএম রড ৯২ হাজার টাকা টন বিক্রি করা হচ্ছে। দাম কমার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমাদের করার কিছু নেই। মিলগেট থেকে রেট দেওয়া হয়। সেখান থেকে সামান্য কিছু বেশি দামে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করা হয়। কাজেই দাম কমাতে হলে মিল থেকেই কমাতে হবে।’
এদিকে ঢাকার বাইরে আরও বেশি দামে এসব রড বিক্রি হচ্ছে বলে খুচরা বিক্রেতারা জানান। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুর হাটের মেজবা জানান, ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে বহু দূর পথ। তাই এসব এলাকায় একটু দাম বেশি হওয়া স্বাভাবিক। একেএস রড বিক্রি হচ্ছে ৯২ হাজার ৫০০ টাকা টন। নওগাঁর নয়ন জানান, ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ট্রাক ভাড়া বেশি। তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।
এক ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘দুই বছর থেকে চেষ্টা করছি একটা ফ্ল্যাট কেনার। কিন্তু দাম কমে না। কেনাও হয় না। সম্প্রতি সরকার পরিবর্তন হলে মনে করেছিলাম ফ্ল্যাটের দাম কমবে। কিন্তু কমেনি। কারণ রডের দাম কমে না। কাজেই স্বপ্নের ফ্ল্যাট বাস্তবে দেখা মিলছে না।’
গত জুলাই ও আগস্ট মাসে সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতায় আবাসন খাতেও মারাত্মক প্রভাব পড়ে। সরবরাহ বিঘ্ন ঘটায় এ সময় রডসহ নির্মাণসামগ্রীর দামও বাড়ে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আবাসন মালিকদের সংগঠন রিহ্যাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে গত দুই মাসে আবাসন খাতের কাজ বন্ধ ছিল। রডসহ নির্মাণসামগ্রী পরিবহন করা যায়নি। শ্রমিকরা ভয়ে ঢাকা ছেড়ে এলাকায় চলে যান। এ জন্যই কাজের গতি বেশ কমে গেছে। দেশের পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ায় ফ্ল্যাটের চাহিদাও কমে গেছে। তবে আশা করি সবকিছু ঠিকঠাক চললে ডিসেম্বরে আবাসন মেলা করা হবে। ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। তবে চাহিদা কমলেও রডের দাম কমেনি। এটা কমার দরকার ছিল।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, দেশে স্বয়ংক্রিয় ইস্পাত কারখানা আছে ৩০টি। সনাতন পদ্ধতির কারখানা আছে ১০০টির মতো। বছরে এসব মিলে রডের উৎপাদন সক্ষমতা (প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি) রয়েছে ৯০ লাখ টন। বছরে দেশে রডের চাহিদা আছে ৫৫-৬০ লাখ টন। এ হিসাবে মাসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টন রড দরকার হয়। রড তৈরির কাঁচামাল হলো পুরোনো লোহার টুকরো। এই কাঁচামাল সরাসরি আমদানি করে প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করেন উৎপাদকরা। বাকি প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ আসে জাহাজ ভাঙা শিল্প এবং লোকাল ভাঙারি বর্জ্য থেকে। কিন্তু সরকার আমদানি করা রডের কাঁচামালে বেশি কর-শুল্ক ধার্য করায় উৎপাদন খরচ বাড়ছে, যার প্রভাব ভোক্তাদের ঘাড়ে পড়ছে।
শাহরিয়ার স্টিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম মাসাদুর রহমান মাসুদ খবরের কাগজকে বলেন, অনেক ঠিকাদারও আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনে ছিলেন। কিন্তু ৫ আগস্টে সরকার পরিবর্তনে তাদের অনেকে ফেরারি হয়ে গেছেন। অনেক ঠিকাদার আত্মগোপনে। এ জন্য সরকারি কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে রডের চাহিদা কমে গেছে।
তাহলে রডের দাম কমছে না কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সরকার তথা এনবিআর থেকে এ খাতে বিভিন্ন ধরনের অযাচিত কর ও শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। আবার ডলারের দামও ৩৫-৪০ শতাংশ বেড়েছে। তাই ডলারের দাম ও শুল্কহার কমানো না হলে কমবে না রডের দাম। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে বিলেটের দাম কমলে কিছুটা কমতে পারে। যেমন কিছুদিন থেকে টনে ৫ হাজার টাকা কমে বর্তমানে ৮৫-৯০ হাজার টাকায় নেমেছে। কিন্তু এতে করে স্থানীয় বাজারে রডের দামে তেমন প্রভাব ফেলেনি।