দেশে কৃষি খাতে চাহিদার শতকরা ৯০ ভাগ বালাইনাশক আমদানিনির্ভর। বাকি ১০ ভাগের কাঁচামাল আমদানি করে বাংলাদেশে উৎপাদন করা হলেও একটি শর্তের কারণে সংকটে রয়েছে কৃষিভিত্তিক দেশীয় এ শিল্প।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে কৃষি খাতে বালাইনাশকের বাজার প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে অধিকাংশই আমদানি করে চাহিদা পূরণ করতে হয়। এ কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। তবে যেসব দেশীয় কোম্পানি বালাইনাশকের আমদানি নির্ভরতা কমাতে কাজ করছে, তাদের শর্ত দিয়ে আটকে ফেলা হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বছরের পর বছর ধরে সুবিধা দিতে আমদানি উৎসাহিত করছে একটি প্রভাবশালী চক্র।
জানা গেছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রায় ৭৫০টির মতো বালাইনাশক কোম্পানিকে আমদানির জন্য প্রায় ১২,০০০ ব্র্যান্ড অনুমোদন দিয়ে রেখেছে। এই অনুমোদন প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘ ও সময় সাপেক্ষ। বালাইনাশকগুলোর রাসায়নিক পরীক্ষা ও ফসল-সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে সন্তোষজনক মাঠ পরীক্ষার মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়া হয়।
একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডকে একটি নির্দিষ্ট সোর্স কোম্পানি হতে আমদানির জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়, যা ওই বালাইনাশকের রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেটে উল্লেখ করা থাকে। মূলত এই কোম্পানিগুলো (সোর্স কোম্পানি) চায়না ও ভারতের। বালাইনাশক আইন আনুযায়ী অনুমোদিত এসব সোর্স ছাড়া অন্য কোনো সোর্স থেকে আমদানি করা হলে তা হবে অবৈধ।
বালাইনাশক শিল্পের আমদানি তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, আনুমানিক সাড়ে ৭ হাজার দেশীয় কোম্পানির মধ্যে বেশির ভাগ কোম্পানি রেজিস্টার্ড সোর্স ব্যতীত অন্য অনুমোদনহীন কোম্পানি থেকে বছরের পর বছর ধরে নিয়মিত পণ্য আমদানি করে আসছে। যদিও সরকারকে নির্দিষ্ট ফি (২৩০০০ টাকা প্রতিটি চালানে) জমা দিয়ে সোর্স পরিবর্তনের জন্য সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা তা করছেন না।
একটি নির্দিষ্ট সিন্ডিকেট এই নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, অবৈধ সোর্স থেকে বালাইনাশক আমদানি করে প্রান্তিক ও কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করছে। এতে করে, একদিকে যেমন সরকার একটি বড় রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অপরদিকে এই নিম্নমানের বালাইনাশক ব্যবহার করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক।
গত জুলাই মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নজরদারি জোরদার করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অনুমোদনহীন সোর্স থেকে আমদানি করা প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার বালাইনাশক আটক করে। পরবর্তী সময়ে কৃষি উৎপাদন ও সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য এসব পণ্য একটি প্যানাল্টি ও মুচলেকা প্রদানের মাধ্যমে বন্দর থেকে খালাসের অনুমতি দেওয়া হয়।
জানা গেছে, বেশ কিছু কোম্পানি অসাধু ব্যক্তি ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জনের জন্য বছরের পর বছর ধরে নিম্নমানের বালাইনাশক আমদানি করে আসছেন। বালাইনাশক শিল্পে সোর্স উন্মুক্ত করার দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন চলছে। কিন্তু এই অসাধু সিন্ডিকেট সোর্স উন্মুক্ত করার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সংকটে ফেলেছে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে। সেই সঙ্গে বেশি লাভের জন্য তারা অবৈধ সোর্স থেকে দীর্ঘদিন ধরে বালাইনাশক আমদানি করে আসছে।
এই অবৈধ সোর্স থেকে আমদানি করা পণ্য কখনো কখনো এতই নিম্নমানের হয় যে, নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্যকরী উপাদান (অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট) থাকার কথা থাকলেও তা থাকে প্রায় শূন্য। অর্থাৎ, বেশি লাভের জন্য একদিকে যেমন রাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে, অপরদিকে তেমনি ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক।
জানা গেছে, গত বছরের (২০২৩) আমদানিতে রেজিস্টার্ড ব্র্যান্ড- প্রাইমেট ৫জি (রেজি এপি- ৬৬৮০), মানিক ২০ এসপি (রেজি এপি-২০৫৭), সুরেট ২০ ইসি (রেজি এপি- ৬২২), কোঠান ৫০ ডাব্লিউ জি (রেজি এপি- ৪৯১৬), মিমট্যাপ ৫০ এসপি (রেজি এপি- ৭৭০), আশাজেব ৮০ ডাব্লিউ পি (রেজি এপি- ১৫৯৪), আশামিল ৭২ ডাব্লিউ পি (রেজি এপি- ১০৩০), ফোরেক্স ১৮ ডাব্লিউ পি (রেজি এপি- ৩৯৬৫), আরোক্সন ২০ এস এল (রেজি এপি- ২৯৫৫)– এই ৯টি পণ্য মোট ২৮টি এলসির মাধ্যমে অননুমোদিত সোর্স থেকে আমদানি করা হয়। এই ধরনের পণ্য ব্যবহার করে ঝিনাইদহের এক কৃষক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিনি বাণিজ্যিক লিচু উৎপাদনকারী। সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ইতোমধ্যে ওই কৃষককে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছে।