তিন দফা দাবিতে সপ্তাহখানেক আগে ধর্মঘটের ডাক দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রাইম মুভার ট্রেইলার, কংক্রিট মিক্সচার, ফ্ল্যাটবেড ও ডাম্প ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন। পণ্যবাহী পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে তিন মাসের ব্যবধানে আবারও কনটেইনার জটের কবলে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর।
চট্টগ্রাম বন্দরে ৫৩ হাজার ৫১৮ টিইইউএস কনটেইনার রাখার ধারণক্ষমতা রয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টিইইউএস কনটেইনার থাকে।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি খারাপ থাকায় আগস্ট মাসের মাঝামাঝিতে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারের সংখ্যা পৌঁছে দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ৪৮০ টিইইউএসে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ও ডেলিভারি বাড়লে সেপ্টেম্বর মাসে বন্দরের ইয়ার্ডে জাহাজের সংখ্যা গড়ে ৩৬ হাজার টিইইউএস কনটেইনারে নেমে আসে। গত ২১ অক্টোবর ভোর ৬টা থেকে পণ্যবাহী শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে পণ্য আনা-নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ৩৬ ঘণ্টা পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন কারখানা, ডিপো ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে শুরু করে পণ্যবাহী কনটেইনার। বাড়তে থাকে কনটেইনারের স্তূপ। বর্তমানে বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে ৪২ হাজার ৬৮৩ টিইইউএস কনটেইনার জমেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, ধর্মঘটের আগে গত ২০ অক্টোবর বন্দরের ইয়ার্ডে কনটেইনার ছিল ৩৫ হাজার ১৮৫ টিইইউএস কনটেইনার। গত ২১ অক্টোবর ভোর ৬টা থেকে শুরু হয় শ্রমিকদের ধর্মঘট। সেদিন বন্দর ইয়ার্ডে ৩৬ হাজার ২৯৫ টিইইউএস কনটেইনার ছিল। ধর্মঘটের কারণে একটি কনটেইনারও ডেলিভারি না হওয়ায় গত ২২ অক্টোবরও একই পরিমাণ কনটেইনার ছিল বন্দরে। গত ২২ অক্টোবর সন্ধ্যায় ধর্মঘট তুলে নিলে ২৩ অক্টোবর কনটেইনার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ৭২৫ টিইইউএসে।
এরপর বাড়তে থাকে কনটেইনারের সারি। গত ২৪ অক্টোবর ৩৮ হাজার ১৬৮ টিইইউএস, ২৫ অক্টোবর ৩৯ হাজার ৫৮৯ টিইইউএস, ২৬ অক্টোবর ৩৯ হাজার ৩৮৭ টিইইউএস, ২৭ অক্টোবর ৪০ হাজার ৮৭৬ টিইইউএস ও বর্তমানে বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে ২৮ অক্টোবর ৪২ হাজার ৬৮৩ টিইইউএস কনটেইনার রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘ধর্মঘটের কারণে বন্দরের ইয়ার্ডে কনটেইনারের সারি কিছুটা বেড়েছে। ধর্মঘট তুলে নেওয়ায় যান চলাচল স্বাভাবিক আছে। কনটেইনার হ্যান্ডলিং, শিপমেন্টসহ অন্যান্য কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার টিইইউএস কনটেইনার ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি যথাসময়ে জাহাজ পণ্য নিয়ে বন্দর ছেড়ে যাচ্ছে।’
চট্টগ্রাম কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইমাম মাহমুদ বিলু বলেন, ‘শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে কাজের গতি অনেকটাই নষ্ট হয়েছিল। এই কারণে কনটেইনার জট তৈরি হয়েছে। এখন সবকিছু স্বাভাবিক আছে। শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে বন্দরে বৈঠক হয়েছে। তাদের দাবি মালিকপক্ষ মেনে নিয়েছে বলে জানতে পেরেছি। বর্তমানে কাজের গতিও ভালো। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে কনটেইনার সংখ্যা আরও কমে আসবে।’
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোটস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেছেন, ‘ধর্মঘট বা অন্য কর্মসূচির ডাক দিলে কাজের ব্যাঘাত ঘটে। এটি মোটেও কাম্য নয়। এতে করে শিপমেন্ট বাতিল, রপ্তানিকারকরা বিদেশি ক্রেতা হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব বিষয়ের স্থায়ী সমাধান করা উচিত।’
বিজিএমইএ প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কনটেইনারবাহী পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে আমাদের সমস্যা হয়েছিল। কারখানা থেকে পণ্য পাঠাতে সমস্যা হয়েছিল। নানা অজুহাতে ধর্মঘটের ডাক দিলে- এটা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য মঙ্গলজনক না। তাই যত দ্রুত সম্ভব এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান জরুরি।’
শ্রমিক নেতারা যা বলছেন
পণ্য পরিবহন মালিকরা নিয়োগপত্র ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেবেন- এমনটা লিখিতভাবে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রাইম মুভার ট্রেইলার, কংক্রিট মিক্সচার, ফ্ল্যাটবেড ও ডাম্প ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. সেলিম খান। তিনি বলেন, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষ, পরিবহন মালিকপক্ষ, এনএসআইসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে গত সোমবার বন্দর ভবনে বৈঠক হয়। সেখানে মোহাম্মদীয়া এন্টারপ্রাইজ ও আসিফ ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃপক্ষ চালক ও সহকারীদের নিয়োগপত্র দেওয়ার বিষয়টি লিখিতভাবে দিয়েছেন। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবে রূপ নিয়েছে। আমরাও ধর্মঘটের পক্ষে ছিলাম না। কিন্তু বাধ্য হয়ে দিতে হয়েছে। দাবি মেনে নেওয়ার কারণে আমরা আর কোনো কর্মসূচি দেব না। আমাদের শ্রমিকরা ভালো থাকুক, এটাই সবার প্রত্যাশা।’
প্রাইম মুভার ট্রেইলার চালক ও সহকারীদের নিয়োগপত্র, ছবিসহ পরিচয়পত্র ও সরকার ঘোষিত মজুরি দেওয়া ও শ্রমঘণ্টা বাস্তবায়নের দাবিতে গত ২১ অক্টোবর ভোর ৬টা থেকে থেকে মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ধর্মঘট পালন করেছেন কনটেইনার পরিবহনকারী গাড়ি প্রাইম মুভার ট্রেইলার শ্রমিকরা। যদিও বুধবার (২৩ অক্টোবর) পর্যন্ত ধর্মঘট পালনের কথা ছিল শ্রমিকদের। কিন্তু মালিকপক্ষের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসে ১২ ঘণ্টা আগেই ধর্মঘট স্থগিত করেন শ্রমিকরা। তবে ধর্মঘটের কারণে বেসরকারি ডিপোগুলো থেকে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দরে নেওয়া সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দর থেকে ডিপো বা কারখানায় নেওয়ায় সমস্যা তৈরি হয়। বিপাকে পড়েন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।