‘মরিয়ম খেজুর। এক দাম ১৩০০ টাকা কেজি। এর চেয়ে কম দাম হবে না। তবে সরকার আগামী রমজান উপলক্ষে খেজুরের শুল্ক কমিয়েছে। দাম কিছুটা কমতে পারে। তার জন্য কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। নতুন খেজুর এলে কম দামের খেজুর মিলবে।’ এভাবেই দামের ব্যাপারে কারওয়ান বাজারের খেজুর বিক্রেতা অমিত হাসান অভিমত ব্যক্ত করেন। অন্য বাজারের বিক্রেতাদেরও একই বক্তব্য। সরকার শুল্ক কমিয়েছে। তাই গত বছরের তুলনায় আগামী রমজানে কিছুটা কমতে পারে দাম। বৃহস্পতিবার বিভিন্ন বাজারে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
বিলাসী পণ্য হিসেবে গণ্য করে গত অর্থবছরে সরকার খেজুর আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করে। এর ফলে দাম অনেক বেড়ে যায়। ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকার খেজুর ২২০০ থেকে ২৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। এ নিয়ে দেশে হইচই পড়ে যায়। আমদানি অনেক কমে যায়।
আসন্ন রমজানে ভোক্তা যাতে সাশ্রয়ী দামে খেজুর খেতে পারে, সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গত ২১ নভেম্বর খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমিয়েছে। পাশাপাশি রোজার ইফতারির অন্যতম অনুষঙ্গ এই পণ্যটির অগ্রিম কর পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে। সরকারে নির্দেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর এ-সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে।
এনবিআর জানিয়েছে, খেজুর একটি আমদানিনির্ভর ফল। যা সব শ্রেণির মানুষের ইফতারের অপরিহার্য উপাদান। পবিত্র রমজান মাসে খেজুরকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য আমদানির ওপর বিদ্যমান কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে অর্থাৎ মোট করভার ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৮ দশমিক ৭০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে কেজিতে ৬০ থেকে ১০০ টাকা কমতে পারে। এতে খেজুরের সরবরাহ বাড়বে। মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে বলে এনবিআর মনে করে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার উচ্চ শুল্ক আরোপ করায় গত রমজানে ব্যাপক বেড়ে যায় খেজুরের দাম। ফলে সাধারণ ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চয়ে যায়। কারওয়ান বাজারের খেজুর বিক্রেতা বিক্রমপুর ফল বিতানের বিক্রয়কর্মী অমিত হাসান খবরের কাগজকে বলেন, গত রমজানে অনেক বেশি ছিল খেজুরের দাম। সে তুলনায় এবার কেজিতে ২০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। বর্তমানে মরিয়ম খেজুর ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা কেজি, আজুয়া ১০৫০ টাকা, তিউনেশিয়া, বরই ও দাবাস খেজুর ৫০০-৫৫০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। তবে একেবারে কম দামের হচ্ছে জাহিদি খেজুর ১৮০-২৮০ টাকা কেজি। এটা খুব বিক্রি হয় না। কারণ নিম্ন আয়ের মানুষ রমজান ছাড়া অন্য সময়ে খেজুর খায় না।
দামের ব্যাপারে একই তথ্য জানান, এই বাজারের আল্লাহর দান ফল বিতানের স্বত্বাধিকারী পারভেজ হোসেন। তিনি বলেন, গত রমজানের পর থেকে কেজিতে ২০০-৪০০ টাকা কমেছে দাম। সরকার শুল্ক কমিয়েছে। আমদানি হলে আরও দাম কমবে। এটা আশা করা যায়। কম দরের ৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা কেজির খেজুর রয়েছে। জাহিদি ছাড়া ৫০০ টাকার কমে কোনো খেজুর বাজারে নেই। জাহিদি খেজুর কম বিক্রি হয়। কারণ যারা কম আয় করেন, তারা রমজান ছাড়া এটা খায় না।
এদিকে টাউন হল বাজার, হাতিরপুল, মিরপুরসহ বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে একই চিত্র। ৫০০ টাকার কমে কোনো খেজুর মেলে না। জাহিদি খেজুর কোথাও পাওয়া গেলে বিক্রি কম বলে জানান খুচরা বিক্রেতারা। তারা আরও বলেন, গত রমজান থেকে দাম বেশি। তাই অন্য বছরের চেয়ে বিক্রিও কমে গেছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে জানানো হয়েছে, বছরে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা ৯০ হাজার টন থেকে ১ লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসে লাগে ৫০ হাজার টন। অন্যান্য মাসে ৬ হাজার টন করে লাগে।
এসব খেজুর ইরাক, ইরান, তিউনেশিয়া, আলজেরিয়া, সৌদি আরব, আরব আমিরাত থেকে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে সস্তা খেজুর আনা হয় ইরাক থেকে। আর দামি খেজুর সৌদি আরব থেকে। সবচেয়ে ভালো কোয়ালিটি খেজুর হচ্ছে মরিয়ম ও আজুয়া। এ জন্য দামও বেশি।
সরকার ইফতারির প্রথম এই আইটেম বিলাসী পণ্য হিসেবে বাজারে ঘোষণা দিয়ে বেশি শুল্ক আরোপ করে। এ জন্য গত রমজানের আগেই বেড়ে যায় অনেক দাম। এ নিয়ে হইচই পড়ায় অন্তর্বর্তী সরকার আলু, পেঁয়াজ, চালের পর খেজুরেও শুল্ক কমিয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, উচ্চ শুল্ক আরোপ ও ডলার সংকটের কারণে এটি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অনেকেই আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। রমজান মাসে খেজুরের যে চাহিদা তার অর্ধেকও গত বছরে এলসি খোলা হয়নি। সম্প্রতি সরকার শুল্ক কমিয়েছে। এটা খুব বেশি না। তবে কমাতে কিছুটা সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
আমদানিকারকরা বলেছেন, গত বারের বাজেটে খেজুরকে বিলাসবহুল আইটেম হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। এর ফলে প্রতি কেজি খেজুরে সবমিলে প্রায় ৬৫ শতাংশ বাড়তি কর দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ অন্যান্য বছরে যে খুজর ১০০ টাকায় পাওয়া যেত সেটা কিনতে ১৬৫ টাকা লাগছে। এই বাড়তি শুল্কের প্রভাবে কার্টুনে ১০০০-১২০০ টাকা বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে হঠাৎ করে সিডি, ভ্যাট, আরডি, এআইটি, এটি মিলে প্রায় ৬৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া আগে প্রতি কার্টুনে (১০০০ কেজি) ১ হাজার ডলার অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু দিতে হলেও বর্তমানে ২ হাজার ৫০০-৪ হাজার ডলার দিতে হচ্ছে। এসব কারণে আগে যেখানে এক কেজি প্যাকেট খেজুরে ১০ টাকা দিতে হতো বর্তমানে লাগছে ১৭৬ টাকা। আর প্রতি কেজি বস্তা খেজুরে আগে ৫ টাকা দিতে হলেও বর্তমানে ৭০ টাকা দিতে হচ্ছে। এভাবে উচ্চ শুল্ক আরোপের কারণে অনেকেই খেজুর আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে খুচরা বাজারে বেড়েছে দাম।