যশোর সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করা প্রায় ৪০টি কোম্পানি অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। বেশিরভাগ কোম্পানি ইতোমধ্যে লোকসানে চলে গেছে। এ অবস্থায় কোম্পানির ওপর বাড়ছে ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলের চাপ। একই সঙ্গে এসব কোম্পানিতে কর্মরতরা ছাঁটাইয়ের ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। এ অবস্থায় সংকট সমাধানে আন্দোলনে নেমেছে যশোর সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশন। ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে সংবাদ সম্মেলন, বিক্ষোভ ও অর্থ উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি।
ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ শাহজালাল জানান, বিনিয়োগকারীদের ওপর দীর্ঘ ৬ বছর ধরে অযৌক্তিকভাবে ভাড়াসহ নানা বিল চাপানো, হঠাৎ করে বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্নকরণের নোটিশ ইস্যু, সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ ও ইচ্ছামতো বিদ্যুৎ বিল তৈরিসহ নানা সংকট রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যশোর শহরের পূর্বপ্রান্তে নাজির শংকরপুর এলাকায় স্থাপিত যশোর সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে এখন প্রায় ৪০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরা মূলত আইটি ও আইটিসংশ্লিষ্ট ব্যবসা, সফটওয়্যার, ডিজিটাল মার্কেটিং, আইএসপি, গ্রাফিক্স, ই-কমার্স, কলসেন্টার এবং দক্ষকর্মী সৃষ্টির কার্যক্রমে যুক্ত। এ ছাড়া কম্পাউন্ডেই রয়েছে একটি ডরমেটরি (যা এখন হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট) এবং ক্যাফেটেরিয়া, একাধিক কনফারেন্স ও মিটিং রুম।
এখানকার কোম্পানি টেকনোসফট গ্লোবাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ শাহজালাল। তিনি পার্কে উদ্যোক্তাদের সংগঠন ‘যশোর সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনর সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘আমরা সফটওয়্যারের নতুন কোনো অর্ডার পাচ্ছি না। যেসব কোম্পানি আমাদের সার্ভিস নেয়, তারাও নিয়মিত পেমেন্ট দিতে পারছে না। কিছুদিন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ অবস্থা বিরাজ করছে। এর পাশাপাশি ৬ বছর ধরে অযৌক্তিক নানা বিল চাপানো ও ইচ্ছামতো বিদ্যুৎ বিল তৈরি আরও বিষিয়ে তুলেছে।’
হাসনাত ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী এএইচএম আরিফুল হাসনাত বলেন, ‘আমরা সফটওয়্যার ও ওয়েবসাইট তৈরি ও বিপণন করি। কিন্তু গত বেশ কিছুদিন ধরে কোনো অর্ডার নেই। এমনকি পাইপলাইনে থাকা অর্ডারগুলোও নিষ্পত্তি হচ্ছে না।’
ইভেন্টটেক নামের প্রতিষ্ঠানটি ই-কমার্সভিত্তিক। বিশেষ করে যশোরের ঐতিহ্য খেজুরের গুড়-পাটালি অনলাইনে বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি সুনাম অর্জন করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা নাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সামনে ভরা মৌসুম। কিন্তু ব্যবসার অবস্থা করুণ।’
যশোর আইটি কোম্পানির ব্যবসা ইন্টারনেট সার্ভিস (আইএসপি) দেওয়া। এর ব্যবস্থাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘তাদের বিজনেস গ্রোথ বন্ধ হয়ে গেছে। ক্রমান্বয়ে গ্রাহক কমছে। ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত।’
এদিকে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে ‘টনিস ক্যাফে’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে পার্কের কর্মীরা খাবার গ্রহণ করেন। নানা সামাজিক ও ব্যবসায়িক অনুষ্ঠান আয়োজনেরও ব্যবস্থা আছে এখানে।
কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে টনিস ক্যাফে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক ইসমাইল আল আজম জানান, ‘তাদের ভাড়া বকেয়া পড়েছে। ওই কারণে গেল টেকসিটি বাংলাদেশ লি. (পার্কটি দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান) তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে টনিস ক্যাফেতে।’
তিনি জানান, ‘সাম্প্রতিক তারা ভর্তুকি দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছিলেন। কিন্তু সামাজিক-ব্যবসায়িক অনুষ্ঠান একেবারেই কমে যাওয়ায় এখন আর চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এখানে প্রায় ১০ জনকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছেন।’
অন্যদিকে টেকসিটির কাছ থেকে বছরখানেক আগে ১২ তলাবিশিষ্ট ডরমেটরিটি চুক্তিতে ইজারা নিয়ে তা ‘হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট’ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘খান প্রোপার্টিস’। তাদেরও ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না বলে জানান এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন সজন। রিসোর্টটির ব্যবসা তলানিতে ঠেকেছে। ব্যবহারযোগ্য ৭৫টি কক্ষের মধ্যে দিনে গড়ে ৪/৫টি বুক হচ্ছে। নাজুক পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতোমধ্যে ২০ জনের বেশি কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে মালিক প্রতি মাসে বিপুল টাকা ভর্তুকি দিচ্ছেন। তবে এভাবে আর কতদিন চালানো সম্ভব তা নিয়ে শঙ্কিত রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ।
ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসান কবীর পার্কের প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থার চরম অবনতির কথা উল্লেখ করে জানান, এরই মধ্যে বেশকিছু কোম্পানি জনবল কমিয়েছে। কিন্তু দক্ষ কর্মী বিদায় করা সম্ভব না। কারণ প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি রয়েছে শুরু থেকেই।
তিনি আরও বলেন, কোম্পানিগুলোর ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলের বোঝা বাড়ছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আরও কোম্পানি ব্যবসা হারিয়ে পার্ক থেকে বিদায় হতে পারে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন।
সার্বিক বিষয়ে যশোর সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক দেখভাল করা সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ হাই-টেক পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিএসএম জাফরউল্লাহের সঙ্গে মুঠোফোনে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।