২০১৫ সালে শুরু করে পাঁচবার সংশোধন করা হয়েছে। তার পরও গত জুনে ৯ বছরে শেষ হয়নি পায়রা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পটি। বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৯৩ শতাংশ। ৭ শতাংশ কাজ করতে এবার সময় বাড়ানো হয়েছে দুই বছর।
প্রকল্পটি ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা দেখতে পরিদর্শন করেন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন। কিন্তু কোনো অনিয়ম খুঁজে পাননি। তবে প্রকল্পের সব কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করার জন্য মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে বলে সুপারিশ করেছেন। প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে আইএমইডি সচিব খবরের কাগজকে বলেন, ‘ইতোপূর্বে অন্য অফিসাররা প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছেন। সর্বশেষ আমি জুলাই মাসে সেখানে মনিটরিংয়ে গিয়েছিলাম। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিআইসি) ও প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি (পিএসসি) সভা করার সুপারিশ করা হয়েছে। নিয়মিতভাবে এই দুই মিটিং করা হলে প্রকল্প সঠিকভাবে শেষ হবে। কারণ এসব মিটিংয়ে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা থাকেন। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, সরকার ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর ১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা খরচ করার জন্য ‘পায়রা বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। প্রকল্পটি প্রথমে তিন বছরের জন্য অর্থাৎ ২০১৮ সালের জুনে শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দেয়। নির্ধারিত তিন বছর পর আরও ছয় বছর বাড়িয়ে গত জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়। তার পরও হয়নি পুরো কাজ। ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনকাজ বাকি থাকায় সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলে সম্প্রতি দুই বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের জুনে শেষ করার জন্য সরকার অনুমোদন দিয়েছে।
ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পটির অর্থ ও কাজ সঠিকভাবে খরচ হচ্ছে কি না তা বিভিন্ন সময়ে মনিটরিং করছে আইএমইডি। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন প্রকল্পটি মনিটরিং করেন।
সার্বিক ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন মনিরুজ্জামান সম্প্রতি খবরের কাগজকে বলেন, ‘অনেকে বলছেন, এত সময় লাগছে কেন? কিন্তু বুঝতে হবে, এখানে বিভিন্ন ব্যাপার জড়িত। তার পরও গত জুন পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ৯৩ শতাংশ। বাকি কাজের মধ্যে প্রায় ৮০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ বাকি রয়েছে। তা বাস্তবায়ন করতেই সময় বাড়ানো হচ্ছে।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডির প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, পায়রা বন্দরের ন্যূনতম অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে সীমিত আকারে বন্দরের কার্যক্রম চালুকরণ এবং একটি পূর্ণাঙ্গ বন্দর গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণে সরকার প্রথমে তিন বছরের জন্য অনুমোদন দেয়। কিন্তু ওই সময়ে কাজের কাজ কিছু হয়নি। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধন প্রস্তাব করা হলে সরকার ২০১৮ সালের ২০ মার্চ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। তাতে খরচ ধরা হয় ৩ হাজার ৩৫০ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এক লাফে খরচ বাড়ে ১৯৭ শতাংশ। সময়ও বাড়ানো হয় দুই বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। গুরুত্ব বুঝে এটিকে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতাভুক্ত করা হয়। সময় ও অর্থ খরচ বাড়লেও কাজের অগ্রগতি ভালো হয়নি। তাই দ্বিতীয়বারের মতো ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর আবারও সংশোধন করা হয়। তখন খরচ ধরা হয় ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। খরচ বেড়েছে ২৮৭ শতাংশ। দুই বছর করে দুবার এবং এক বছর করে দুবার মোট ছয় বছর সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুনে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। তাও পুরো কাজ শেষ হয়নি।
প্রকল্পের প্রধান কাজ ধরা হয় ৬ হাজার ৫৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ। এই ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত আনুমানিক ৩ হাজার ৫০০ পরিবারের পুনর্বাসন ও ৪ হাজার ২০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া। জাতীয় মহাসড়ক এন-৮-এর সঙ্গে পায়রা বন্দরের যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং আউটার বার ও নদীপথে চিহ্নিত বারগুলোর প্রয়োজনীয় ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপথে মালামাল ও কন্টেইনার পরিবহন নিশ্চিত করা।
ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হওয়ায় আইএমইডি থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পটি মনিটরিং করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে ৬ হাজার ৫৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ ধরা হলেও হয়েছে ৫ হাজার ৩৩২ একর। এখনো ৯৪২ একর ভূমি অধিগ্রহণ বিভিন্ন পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন। আর ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৪টি প্যাকেজের আওতায় ৩ হাজার ৪২৩টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে ২ হাজার ৬২৬টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে বিভিন্ন আকারের বাড়ি বরাদ্দ দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আরও প্রায় ২০৮টি বাড়ি নির্মাণ করা প্রয়োজন। ১১৯টি বাড়ি নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৯৩ শতাংশ। সর্বশেষ সংশোধন অনুযায়ী অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে হবে ২০২৬ সালের জুনে।
প্রতিবেদনে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন উল্লেখ করেছেন, অডিটসংক্রান্ত পর্যবেক্ষণে শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১৪টি অডিট আপত্তি হয়েছে। এর মধ্যে আটটির নিষ্পত্তি হয়েছে। তিনটি অডিট আপত্তির নিষ্পত্তির কার্যক্রম চলমান, আরও তিনটি অডিট নিষ্পত্তির সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, পুনর্বাসনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের উদ্দেশ্যে নির্মিত বাড়িগুলো প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পের সব কার্যক্রম যথাসময়ে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। নিয়মিত পিআইসি ও পিএসসি সভা করতে হবে। বর্ধিত মেয়াদের মধ্যে কাজ শেষ করতে কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন অগ্রগতি তিন মাস পরপর আইএমইডিকে অবহিত করতে হবে।