‘শুধু এবার না, আগেও দেখেছি ক্ষমতার পালা বদল হলে কিছু ব্যবসায়ী এবং তার প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ (জব্দ) করা হয়। আমি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করাকে সমর্থন করি না।’
কনভারসেশন উইথ ইআরএফ মেম্বারস অনুষ্ঠানে গতকাল এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু এসব কথা বলেন। অর্থনীতি বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফের উদ্যোগে রাজধানীর বিজয়নগরে সংগঠনের কার্যালয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা।
বেক্সিমকো গ্রুপের কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ঘটনাকে আপনি কীভাবে দেখছেন জানতে চাওয়া হলে ব্যবসায়ীদের নেতা আবদুল আউয়াল বলেন, একজন ব্যবসায়ী দুর্নীতিবাজ হলে তার বিচার হবে। কিন্তু তাই বলে তার প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ করতে হবে? একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তারা বেকার হয়ে যাবেন। তাদের পরিবার কষ্টে পড়বে।
গত রবিবার এক অনুষ্ঠানে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি শুধু আমানতকারীদের টাকা দিতে ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে বিশেষ তারল্য সুবিধা দিয়েছে। এটা ঠিক না। দুর্বল ছয়টি ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা সরাসরি বিশেষ ধার দেওয়া উচিত হবে না। বাংলাদেশে ৬০টি ব্যাংকের প্রয়োজন ছিল না। সরকার পরিবর্তন হলে রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিমা কোম্পানির লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এভাবে লাইসেন্স পাওয়া অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তারা সেবা দেওয়ার জন্য আসেনি। আমানতকারীদের অর্থ লোপাট ছিল তাদের উদ্দেশ্য।’
প্রশ্নোত্তর পর্বে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘দেশের জন্য কিছু অর্থনীতিবিদ এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এরা এখন কথা একটু বেশি বলছেন। এদের মুখ খোলা বন্ধ করতে না পারলে বাংলাদেশের জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে। আমার প্রশ্ন হলো, এসব ব্যক্তি কি সারা জীবনেও একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন? তারা কি একজন মানুষকেও চাকরি দিয়েছেন?’
ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, “বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলাম। কখনো ‘দরবেশ’ হইনি।”
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি বাড়লে অর্থনীতির বহু ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। সার্বিক চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে আমদানি ব্যয়।
মিন্টু বলেন, অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে একনায়কতন্ত্র, স্বেচ্ছাচারী শাসন, দলীয়করণ, দলীয় লোকদের তোষণ-পোষণকে বিগত সরকার রাষ্ট্রীয় রীতিনীতিতে পরিণত করে ফেলেছিল। অন্যদিকে আবার বিগত সরকার জনগণের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের মাধ্যমে নিজেদের কবজায় নিয়ে ধ্বংস বা দুর্বল করে দেয়। ফলে বাজার ব্যবস্থাপনা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়।
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘পৃথিবীতে অন্য কোনো দেশে আইন করে লুটপাটকে বৈধ করা হয়েছে কি না আমার জানা নেই। একইভাবে মেগা প্রজেক্টে হোক কিংবা খেলাপি ঋণ মাফ হোক, ব্যাংক বা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করা হোক, সব আইন-কানুন-নীতিই তখন আত্মস্বার্থ-সন্ধানী দুর্নীতিবাজদের সহায়তায় প্রণীত হয়েছিল। ওই সব আইন-কানুন-রীতি-নীতি বাস্তবায়নে নিয়োগ দেওয়া হতো বড় বড় দুর্নীতিবাজ দলীয় কর্মকর্তাকে।’
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, স্বৈরাচারী শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বারংবার পুনর্নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। এরাই স্বার্থান্বেষী মহল যেমন- প্রশাসনে অনভিজ্ঞ ও অনির্বাচিত রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মিলেমিশে রাজনীতি ও সামষ্টিক অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল।
দেশের ব্যাংক খাতের অন্যতম এই কর্ণধার বলেন, বিগত দশকে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের চরিত্র বদলিয়ে দলীয় সংগঠন হিসেবে কাজ করছে। বিগত কয়েক বছরে স্বৈরাচারী সরকারের ভ্রান্তনীতি অনুসরণ করায় অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে গেছে। বিগত সরকারের মতলব ছিল পূর্বের সরকারের চেয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক সাফল্যকে অতিরজ্ঞিত উপায়ে জাহির করা। এসব ভ্রান্ত নীতির ফলে সমাজে দুর্নীতি, লুটপাট এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কিছু অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করা হয়েছে, যার সঙ্গে ভবিষ্যৎ আয় ও ব্যয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই। বিনিয়োগের নামে বহু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে একমাত্র দুর্নীতি ও লুটপাটের জন্য। এ ধরনের অপরিকল্পিত অতিরিক্ত ব্যয় দেশের মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার বিদেশি ব্যাংক থেকে উচ্চসুদে অনেক স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়েছে। সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এ ধরনের ঋণ দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে বেসরকারি খাতকে বিদেশি ঋণ নিতে উৎসাহিত করার পেছনে একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল স্বল্পমেয়াদে রিজার্ভ বাড়ানো। এসব বাণিজ্যিক ঋণের সুদ বেশি ও স্বল্প মেয়াদে পরিশোধ করতে হয়, যা দেশের আর্থিক লেনদেনের ভারসাম্য নষ্ট করে। এ ধরনের ঋণ নেওয়ার সঙ্গে দুর্নীতি ও অপচয় বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, কায়েমি স্বার্থবাদীদের রক্ষক হিসেবে রাজনৈতিক ও গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা কখনো প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থেই সর্বত্র ‘স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখার পক্ষে যুক্তিতর্ক দাঁড় করায়। সত্যিকার অর্থে সমাজের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য অথবা দারিদ্র্য ও ধনী-গরিবের মধ্যে ব্যবধান কমানোর জন্য প্রথম কাজ হবে রাজনৈতিক সংস্কারে হাত দেওয়া।’