আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক রাখার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, খেজুর, চাল, ডালসহ ছয়টি পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে কোনো মার্জিন লাগবে না। অর্থাৎ এসব পণ্য আনতে শূন্য মার্জিনে (নগদ টাকা ছাড়া) ঋণপত্র বা এলসি খোলা যাবে। একই সঙ্গে পণ্যগুলো আমদানিতে তুলে দেওয়া হয়েছে একক গ্রাহকের সর্বোচ্চ ঋণসীমা।
বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) সন্ধ্যায় সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে মূল্যস্ফীতি নিয়ে এক বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে দেশে কোনো সংকট নেই। মূল্যস্ফীতি কমতে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগবে।’ এই সময়টায় সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান গভর্নর।
এর আগে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা পর্যালোচনা করতে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তা, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি ও অর্থসচিব ড. খায়রুজ্জামান মজুমদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
গভর্নর বলেন, বৈঠকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে। ছয়টি নিত্যপণ্য আমদানিতে কোনো এলসি মার্জিন লাগবে না। এ ছাড়া গ্রাহকের একক সর্বোচ্চ ঋণসীমা সাময়িক সময়ের জন্য তুলে দেওয়া হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের ফলে নিত্যপণ্যের আমদানি আরও সহজ হবে এবং বাজারে সরবরাহ বাড়বে। এই সুযোগ আসন্ন রমজান পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে বলে জানান গভর্নর।
ড. মনসুর বলেন, ‘রমজানে কিছু স্পর্শকাতর পণ্যের মূল্য আমাদের ধরে রাখতে হবে। এর মধ্যে চাল একটি স্পর্শকাতর পণ্য। এর দাম বেড়েছে।’ তবে গতবার যেভাবে বেড়েছে, এবার তার চেয়ে কম বেড়েছে বলে দাবি করেন তিনি। গভর্নর বলেন, চালের বর্তমান যে মূল্য আছে তা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে তুলনামূলক সস্তা। চালের শুল্ক শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ আমদানি করছে না। কিন্তু কেন করছে না? ভারত থেকে চাল আনলে খরচ বেশি পড়ছে। ডিউটি শূন্য আবার আমদানিও হচ্ছে না। এটা দিয়ে নির্দেশ করছে দুটি বিষয়। একটি হচ্ছে চালের বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতি অতটা খারাপ নয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলেছে, এ বছর দেশে চাল আমদানি করতে হবে না।
তিনি বলেন, ‘এখন চালের যে দাম রয়েছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি সর্বোচ্চ নয়। গত বছর এর চেয়ে বেশি দাম উঠেছিল। আমরা অবশ্যই চাই চালের দাম কমুক। কিন্তু কৃষকের কথা অবশ্যই ভাবতে হবে। উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কাজেই চালের দাম যে আগামীতে খুব বেশি কমবে, তা খুব বেশি আশা করা যায় না।’
‘মূল্যস্ফীতি কমতে কয়েক মাস সময় লাগবে’
গভর্নর বলেন, ‘অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি সাময়িকভাবে বেড়েছে। এটা ১০ দশমিক ৮৭ হয়েছে। বাড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর সব দেশেই মুদ্রানীতি কঠোর করার পরও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তারপর ধীরে ধীরে কমে এসেছে। আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতি বেশি হয়েছে বন্যার কারণে। এর ফলে সরবরাহব্যবস্থায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে। আমি মনে করি, বৃদ্ধিটা সাময়িক। আরেকটা ফ্যাক্টর হচ্ছে এতদিন মূল্যস্ফীতিকে কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়েছিল। এখন এটা বাস্তবভিত্তিক করা হয়েছে। ফলে আগের তুলনায় মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেশি দেখাচ্ছে। এই প্রবণতা আরও কয়েক মাস থাকবে।’
তবে ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন গভর্নর। তার কারণ হিসেবে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। জ্বালানি পণ্যের দাম কমছে। এ ছাড়া আমাদের অভ্যন্তরীণ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার এখন স্থিতিশীল রয়েছে।’ এসব কারণে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি কমতে বাধ্য বলে মনে করেন গর্ভনর।
তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের যেটা করতে হবে তা হলো, অভ্যন্তরীণভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এ জন্য মুদ্রানীতি কঠোর করা হয়েছে। আমাদের রেট বাজারভিত্তিক। পলিসি রেট বাড়ানোর কারণে ব্যাংকগুলোর কস্ট অব ফান্ড একটু বেড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কিছুটা কমেছে। অর্থাৎ তারা প্রত্যাশিত মুনাফা করতে পারছে না।’
বৈঠকে সরবরাহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি। গভর্নর জানান, প্রত্যেকটি পণ্যের দাম নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সরবরাহ বাড়াতে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের শুল্ক শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। আরেকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে। নিত্যপণ্যের আমদানিতে যাতে এলসি মার্জিন না নেওয়া হয়। এ বিষয়ে আগামী রবিবার একটি সার্কুলার জারি করে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হবে। এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে আসন্ন রমজান পর্যন্ত।
তিনি বলেন, দেশে অনেক বড় বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের ঋণ গ্রহণের সর্বোচ্চ সীমা (সিঙ্গেল বরোয়ার লিমিট) তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী রোজাকে সামনে রেখে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের আমদানি কার্যক্রম যাতে বিঘ্নিত না হয়, সে জন্য এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতায় বলে, মুদ্রানীতি কঠোর করার পরও মূল্যস্ফীতি কমতে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগে। কাজেই আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। ধৈর্য ধরে পলিসি বাস্তবায়ন করতে হবে। সে সময়টা দিতে হবে।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই। কিন্তু সরকারের উদ্যোগ কী আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে গর্ভনর বলেন, ‘সরকার শুল্ক-কর কমিয়েছে।’ এ সময় অর্থসচিব বলেন, ‘আমরা পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্যতেলসহ অনেক নিত্যপণ্যের ট্যাক্স কমিয়ে দিয়েছি। এ ছাড়া সামাজিক সুরক্ষার আওতায় গরিবদের জন্য আমরা ফ্যামিলি কার্ড বাড়িয়ে দিয়েছি। পাশাপাশি কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সাশ্রয়ী দামে সবজি বিক্রি কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে সাধারণ ভোক্তা-শ্রেণি যাতে উচ্চমূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে রেহাই পায়।’ এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থসচিব বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরবরাহব্যবস্থায় আরও কী করে উন্নতি করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
রিজার্ভের সংকট নেই
গর্ভনর বলেন, ‘আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকট নেই। যে কেউ ঋণপত্র খুলতে পারবে।’ ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে গর্ভনর বলেন, ‘আপনারা যখন ইচ্ছা, যেকোনো সময়ে এলসি খুলতে পারবেন। বাজারে পর্যাপ্ত চাহিদা রয়েছে। আমদানি করেন। বাজারের চাহিদা মেটান।’