ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে তৈরি মানহীন বা নকল প্রসাধনীতে বাজার সয়লাব। এত নিখুঁতভাবে নকল প্রসাধনী বাজারজাত করা হয় যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল ভোক্তার পক্ষে তা আলাদা করা কঠিন। নকল ও মানহীন প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ দেখা দেয়।
শুধু তা-ই নয়, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, কিডনি বিকল হওয়া থেকে ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি রোগও হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নকল প্রসাধনীতে ইচ্ছামতো রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এসব রাসায়নিক বেশি মাত্রায় প্রয়োগের ফলে মানবদেহে ক্যানসার, অ্যালার্জি, ত্বকের প্রদাহ, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। আর শিশুদের জন্য এসব প্রসাধনীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আরও বেশি মারাত্মক।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সমরেশ চন্দ্র হাজরা খবরের কাগজকে বলেন, ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে তৈরি মানহীন প্রসাধনী ব্যবহারে শুধু ক্যানসার হতে পারে তা নয়; এসব থেকে স্নায়ুবিক দুর্বলতা ও কিডনি বিকল হতে পারে। এসব প্রসাধনী মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
দামে কিছুটা সস্তা হওয়ায় সেগুলো দেদারছে কিনছেন সাধারণ মানুষ। নকল ধরতে না পারায় বিত্তশালীরাও এগুলো কিনছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘ভেজাল ও মানহীন প্রসাধনীর অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ায় রোগী মারাও যেতে পারেন। দীর্ঘদিন এসব ব্যবহারে ত্বকের পাশাপাশি কিডনি এবং শরীরে অন্যান্য অংশেও মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
প্রতিদিন আমরা যেসব রোগী পাই তাদের মুখে কালো দাগ, র্যাশ, গোটা, লাল হয়ে যাওয়া, অ্যালার্জি, অত্যধিক ঘাম ঝরে। এ সময় রোগীরা কিছু ক্রিম, লোশনের কথা বলেন। আমরা সেগুলো পরীক্ষা করে দেখেছি মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান থাকে। তবে রোগীদের পক্ষে জানা সম্ভব নয় তারা কী ব্যবহার করছেন।’
এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, বিএসটিআই, ভোক্তা অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান নকল ও মানহীন প্রসাধনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। নকল প্রসাধনী ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের আটকও করা হচ্ছে। নকল পণ্য জব্দ করে কারখানা সিলগালা করে দেওয়া হচ্ছে।
ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি সাবেক সচিব গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, প্রসাধনসামগ্রীতে ভেজালের সঙ্গে জড়িতদের বিএসটিআইয়ের আইন অনুযায়ী মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও বাস্তবে প্রয়োগ কম। নকল প্রসাধনীগুলো সস্তায় পাওয়া যায়। যা কিনে সাধারণ মানুষ যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন; তেমনি নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা জামিনে বেরিয়ে আবারও নকল প্রসাধানীর কারবার করছে।
এর অন্যতম কারণ নকল প্রসাধনী বাজারজাত করতে পারলেই বড় অঙ্কের অর্থ পকেটে আসছে। এসব ব্যক্তির নকল পণ্য বাজারজাত করার নেটওয়ার্কও শক্তিশালী। ফলে উৎপাদিত পণ্যগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাশাপাশি রাজধানীসহ সারা দেশের মার্কেটগুলোতেও সহজে বিক্রি করতে পারছে।
চলতি বছরের (জানুয়ারি-অক্টোবর) বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের অভিযানে ১৭ কোটি ৩৪ হাজার ৩৯২ টাকার নকল ও মানহীন প্রসাধনী জব্দ করা হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে গোপনে নকল প্রসাধনী তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। বিশেষভাবে পুরান ঢাকা এলাকা, আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুরে এসব বেশি হচ্ছে। অভিযানে দেখা গেছে, বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর নকল বেশি হচ্ছে। এসব নকল প্রসাধনীতে ব্যবহার হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক। অনুমোদনহীন ও লেভেলবিহীন অনিরাপদ কাঁচামালের সঙ্গে অ্যাসিড ও অন্যান্য কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি করা হয় ত্বক ফর্সা করার নকল ক্রিম।
সম্প্রতি আশুলিয়ায় গোপনে নকল প্রসাধনী তৈরি করার দায়ে চারজনকে আটক করা হয়। কারখানার বাইরে লাবিবা কসমেটিকস এন্টারপ্রাইজের সাইনবোর্ড দিয়ে নকল প্রসাধনী তৈরির কারবার চালিয়েছে। এখানে অনিরাপদ পরিবেশে অনুমোদহীন স্কিন ক্রিম তৈরি করছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিএসটিআই থেকে লাইসেন্স না নিয়েই অবৈধভাবে বিএসটিআইয়ের লোগো ব্যবহার করে নকল পণ্য বাজারজাত করছিল প্রতিষ্ঠানটি। নকল প্রসাধনী জব্দ করে কারখানাটি সিলগালা করে দেওয়া হয়।
অভিযান সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কারখানায় তাদের কোনো কেমিস্ট ছিল না। কারখানার ভেতর ছোট একটি ‘ল্যাবরেটরি’ বানিয়ে সেখানে কিছু জিনিসপত্র সাজিয়ে রেখেছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে প্রসাধনীর (ক্রিম, শ্যাম্পু, সাবান, লোশন, আফটার শেভ লোশন, পারফিউম) যে চাহিদা রয়েছে, তার ১৫ শতাংশ জোগান দিচ্ছে অনুমোদিত দেশীয় কোম্পানি। ২৫ শতাংশ আমদানি করা পণ্য। বাকি ৬০ শতাংশ প্রসাধনী নকল ও ক্ষতিকারক উপাদান দিয়ে তৈরি হচ্ছে, যার মূল কেন্দ্র পুরান ঢাকা।
এ বিষয়ে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ আবু খালেদ খবরের কাগজকে বলেন, ভেজাল প্রসাধনীগুলো মারাত্মক ক্ষতিকারক উপাদানে তৈরি হয়, যা ব্যবহারে ত্বক পুড়ে (বার্ন) যায়। চামড়া ড্যামেজ হয়ে পড়ে। বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জি হয়। এমনকি চেহারা বিকৃত হয়ে যেতে পারে। এসব প্রসাধনীতে হেভি মেটাল থাকলে তা কিডনি ড্যামেজ করে ফেলতে পারে। এমনকি এসব পণ্য ব্যবহারে পুরোনো রোগগুলো নতুন করে দেখা দিতে পারে।
সম্প্রতি পুরান ঢাকার লালবাগের হায়দার বক্স লেনের একটি বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে চলা একটি কারখানায় অভিযান চালানো হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্বমানের ব্র্যান্ড গার্নিয়ার, লরিয়েল, রেভলন, হেড অ্যান্ড শোল্ডার, লাক্স লোশন, মাস্ক লোশন, অ্যাকুয়া মেরিন লোশন, পেনটিন, নিভিয়া লোশন, ফেড আউট ক্রিম, ডাভ সাবান, ইমপেরিয়াল সাবান, সুগন্ধির মধ্যে হুগো, ফেরারি, পয়জন, রয়েল, হ্যাভক ও কোবরা, অলিভ অয়েল, কিওকারপিন, আমলা, আফটার সেভ লোশন, জনসন, ভ্যাসলিন হেয়ার টনিক, জিলেট ফোম, প্যানটিন প্রো-ভি ও হারবাল এসেনশিয়াল লোশনের নামে ভেজাল প্রসাধনী বিক্রি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
নকল প্রসাধনীতে ১৩ ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের বিশেষজ্ঞরা।
এর মধ্যে প্যারাবেন (মিথাইল প্যারাবেন, বিউটেল প্যারাবেন, প্রপেল প্যারাবেন, ইসোবিউটেল প্যারাবেন, ইথাইল প্যারাবেন ইত্যাদি নামে পাওয়া যায় এই রাসায়নিক), ডাই ইথানল এমিন (ডিইএ), বিএইচএ (বিউটিলেটেড হাইড্রক্সি এনিসল) ওবিএইচটি (বিউটিলেটেড হাইড্রক্সি টলুইন), পলি ইথিলিন গ্লাইকল (পিইজি), সোডিয়াম লোরেল সালফেট এবং সোডিয়াম লরেথ সালফেট উল্লেখযোগ্য।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন প্রসাধন, ডিওডোরেন্ট, বডি স্প্রে এবং পারফিউম উৎপাদনে প্রায় তিন হাজার রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব রাসায়নিক উপাদানগুলো ক্ষতিকরভাবে ব্যবহার করা হলে অ্যালার্জি, মাইগ্রেন ও হাঁপানি সৃষ্টি করতে পারে।
এ ছাড়া ত্বকে চুলকানি, চোখ জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে। এর অধিক ব্যবহারে চোখের ক্ষতি, বিষণ্নতা, শ্বাসনালির ক্ষতি, ডায়রিয়া এবং তীব্র চামড়া জ্বালা হতে পারে। ইমিউন সিস্টেমের ক্ষতি করতে পারে; যা পরবর্তী সময়ে হার্ট, লিভার, ফুসফুস ও মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি করে।’