চলমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মাঝে যখন মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে, তখন তাদের জন্য এক স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে নাটোরের অ্যাংকার ডালের কুমড়ো বড়ি। কম দামে এই কুমড়ো বড়ি বিক্রির মাধ্যমে একদিকে যেমন ভোক্তাদের চাপ কমছে, তেমনি পরিবারগুলোর জন্য এটি হয়ে উঠেছে একটি সহায়ক উপকরণ। এটি তরকারির চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে কুমড়ো বড়ি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এর কদর অনেক বেশি। কুমড়ো বড়ি সাধারণত শীতকালে তৈরি করা হয়। সঠিকভাবে তৈরি ও সংরক্ষণ করলে এটি সারা বছর খাওয়া যায়। জানা গেছে, কুমড়ো বড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত কুমড়োতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেল, শর্করা ও ফাইবার, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এ ছাড়া এটি হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্নায়ুবিক সমস্যা যেমন: সিজোফ্রেনিয়া, হিস্টিরিয়া ইত্যাদি মোকাবিলায় কার্যকরী হতে পারে।
একসময় শীত শুরু হলেই নাটোরের বিভিন্ন গ্রামে কুমড়ো বড়ি তৈরির কাজ শুরু হতো। তবে তা ছিল শুধু ঘরোয়া প্রেক্ষাপটে। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই খাবারটি বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হতে শুরু করেছে। এর ফলে অনেক পরিবার আজকাল জীবিকার জন্য কুমড়ো বড়ি তৈরির কাজকে নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। এতে তারা নিজেদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করেছে। কুমড়ো বড়ি তৈরির এই প্রক্রিয়া ও ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।
নাটোরে কুমড়ো বড়ি তৈরি হয় দুটি প্রধান উপাদান দিয়ে। একধরনের কুমড়ো বড়ি তৈরি হয় মাষকলাই দিয়ে। আর অন্য ধরনের কুমড়ো বড়ি তৈরি হয় অ্যাংকার ডালের সঙ্গে কুমড়ো ও অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে। এর মধ্যে মাষকলাইয়ের কুমড়ো বড়ি বেশি দামী। কারণ এতে ব্যবহৃত উপকরণগুলোও দামী। কিন্তু অ্যাংকার ডালের কুমড়ো বড়ি তৈরি করার জন্য কম দামী উপকরণ প্রয়োজন, যার ফলে এই ধরনের কুমড়ো বড়ির দামও তুলনামূলকভাবে কম। তাই বর্তমানে অ্যাংকার ডালের কুমড়ো বড়ির চাহিদা অনেক বেশি।
সিংড়া উপজেলার কলম ইউনিয়নের পুণ্ডরী গ্রামে সবচেয়ে বেশি কুমড়ো বড়ি তৈরি হয়। এই গ্রামে প্রায় ১৫-১৬টি পরিবার কুমড়ো বড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকে। এখানকার একজন কুমড়ো বড়ির কারিগর আলামিন শাহের স্ত্রী রাশেদা বেগম জানান, তিনি ছোটবেলায় তার বাবার বাড়ি সিরাজগঞ্জের তারাশ উপজেলায় কুমড়ো বড়ি বানানো শিখেছিলেন। বিয়ের পরও তিনি এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এখন তার পুরো পরিবার এই কাজে সম্পৃক্ত। রাশেদা বেগম জানান, এক কেজি অ্যাংকার ডাল ব্যবহার করে প্রায় পৌনে এক কেজি শুকনো কুমড়ো বড়ি তৈরি করা যায়। প্রতিদিন তিনি ২০-৩০ কেজি কুমড়ো বড়ি তৈরি করেন। সপ্তাহে ৩৫০ কেজি কুমড়ো বড়ি বিক্রি করেন, যার মাধ্যমে গড়ে প্রতিদিন ৩০০-৩৫০ টাকা আয় হয়। তার স্বামী ভ্যান চালিয়ে অতিরিক্ত আয় করেন। এতে পরিবারে সংসরার ভালোভাবে চলছে।
অ্যাংকার ডালের কুমড়ো বড়ি এখন নাটোরের বিভিন্ন হাটবাজারসহ বগুড়া, রাজশাহী, পুঠিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলে বিক্রি হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী এসব কুমড়ো বড়ি সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য অন্য জেলা থেকে কিনে নিয়ে যান।
নাটোর সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া এলাকার গৃহিণী মাসৌরা বেগম, ভাটোদাড়া গ্রামের বাসিন্দা জামিল ও করিম জানান, তারা নিয়মিত এই কুমড়ো বড়ি কিনে থাকেন। কারণ এর স্বাদ খুবই ভালো এবং দামও সাশ্রয়ী।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ জানান, জেলায় গত কয়েক বছরে অ্যাংকার ডালের কুমড়ো বড়ি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দাম কম হওয়ায় অনেকে পরিবারের তরকারির চাহিদা মিটছে। দিন দিন কুমড়ো বড়ির উৎপাদন বাড়ছে। এটি গ্রামীণ জনগণের জীবনে নতুন এক দিগন্তের সূচনা করেছে। যেখানে তারা সস্তায় ভালো খাবারের সঙ্গে একটি ভালো উপার্জন করতে পারছেন।