ভোজ্যতেলের পর খাতুনগঞ্জে এবার চড়া হতে শুরু করেছে এলাচের বাজার। মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি এলাচে দাম বেড়েছে ৭০০ টাকা। ডিও স্লিপ-বাণিজ্য ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে পণ্যটির দাম বেড়েছে বলে জানা গেছে।
গত অক্টোবর মাসে খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি এলাচ বিক্রি হয় ৩ হাজার ১০০ টাকায়। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ টাকায়। তবে কোনো কোনো দোকানে ৩ হাজার ৯০০ টাকা চাইতে দেখা গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে খাতুনগঞ্জে আগের কেনা এলাচ দাম বাড়িয়ে বিক্রি হচ্ছে। ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) স্লিপ কেনাবেচার মাধ্যমে চাহিদা বাড়িয়ে এলাচের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হচ্ছে। সরকার এই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না। তাই পাইকারি বাজারটিতে ভোজ্যতেল, এলাচের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে খাতুনগঞ্জে যেসব এলাচ বিক্রি হচ্ছে তা কেজিপ্রতি ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায় কেনা। খাতুনগঞ্জের বাদশা মার্কেট, ইলিয়াস মার্কেট, নবী মার্কেটসহ বিভিন্ন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান মূল পণ্যের বিপরীতে স্লিপ-বাণিজ্য বাড়িয়ে দেওয়ায় পণ্যটির বাজার ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে।
খাতুনগঞ্জে বেশির ভাগ সময় এলাচে কারসাজির প্রমাণ দিয়েছেন এলাচ আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান এবি দাশ অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানির স্বত্বাধিকারী অমর কান্তি দাশ। তিনি ২০২৩ সালে আমদানি করা এলাচের সরবরাহ আদেশ (এসও) বিক্রি করে দাম বাড়িয়েছেন। এই ব্যবসায়ী ২০২৩ সালে প্রতি কেজি ১ হাজার ৪৫০ টাকায় আমদানি করা এলাচ ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত কেজিপ্রতি ১ হাজার ৮৩০ টাকা থেকে দাম বাড়িয়ে ৪ হাজার ৫৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন।
বাড়তি দরে বিক্রি করায় চলতি বছরের ১০ মার্চ ও ৫ জুন দুই দফা শাস্তির আওতায় আনা হয়েছিল এই ব্যবসায়ীকে।বর্তমানেও বাজার অস্থিতিশীল করার পেছনে তার অবদান রয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে এলাচের বাজারের বিষয়ে সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চাইলে অমর কান্তি দাশ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
খাতুনগঞ্জে গত বছরের অক্টোবরে প্রতি কেজি এলাচ ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়, নভেম্বরে ৫০০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ১০০ টাকা ও ডিসেম্বরে ৩০০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। অন্যদিকে চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রতি কেজি এলাচ ৩ হাজার ১০০ টাকা, মে মাসে ৩ হাজার ৯৫০, জুনে ৩ হাজার ৬০০ থেকে ৪ হাজার ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে।
এদিকে গত আগস্টে দাম কমে পণ্যটি ২ হাজার ৭৫০ টাকায় বিক্রি হয়। অক্টোবরে ফের দাম বেড়ে ৩ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। বর্তমানে পণ্যটি কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ৯০০ টাকায়।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও তৈয়্যবিয়া ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সোলায়মান বাদশা খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে খাতুনগঞ্জে ভোজ্যতেল, এলাচ সবকিছুর সরবরাহ পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। এসব পণ্য আগের কেনা। এলাচের দাম এতটা বাড়ার কথা না। যতক্ষণ পর্যন্ত ডিও স্লিপ-বাণিজ্য বন্ধ করা যাবে না, ততক্ষণ এসব পণ্যের দর দফায় দফায় বাড়তে থাকবে। সরকারের উচিত এ বিষয়ে নজর দেওয়া। ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে এলাচের বুকিং রেট বেড়েছে। আমদানিকারকের কেজিপ্রতি এলাচে খরচ পড়ছে ৪ হাজার টাকার বেশি। তাই নতুন করে এলাচের আমদানি কমে গেছে।
কিন্তু বাজারে বর্তমানে শুধু এলাচ নয়, কোনো পণ্যেরই সরবরাহে সংকট নেই। আগের কেনা পণ্য ডিও স্লিপ-বাণিজ্যের মাধ্যমে বারবার হাত বদল করে দাম বাড়ানো হচ্ছে।’
জানা গেছে, গুয়েতেমালা, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের ১০ থেকে ১২টি দেশে এলাচ উৎপাদন হয়। তবে গুয়েতেমালা ও ভারতে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হওয়ায় এ দুটি দেশের ওপর বাজারমূল্য নির্ভর করে।
উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৪ হাজার ৮৪৪ টন এলাচ আমদানি হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি হয় ৪ হাজার ৪৯৩ টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) আমদানি হয়েছে ১ হাজার ১৪ টন এলাচ।
দপ্তরটির উপপরিচালক ড. মো. শাহ আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘গুয়েতেমালা থেকে সবচেয়ে বেশি এলাচ আমদানি হয়। এসব এলাচের মানও খুব ভালো। এলাচের আমদানি ও সরবরাহ ভালো পর্যায়ে রয়েছে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন খবরের কাগজকে বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা আবারও অস্থির করে তুলেছে পণ্যটির বাজার। ডিও স্লিপ-বাণিজ্যের কারণে এমনটা হচ্ছে বলে জানতে পেরেছি। ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে ডিও স্লিপ-বাণিজ্যের মতো এসব জুয়া খেলা বন্ধ করতে হবে। আমরা আশা করব, টাস্কফোর্স টিম, ভোক্তা অধিকারসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’