চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) তিন বছরেও পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়ির ‘ডিজিটাল গেট ফি’ সিস্টেম পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
‘টার্মিনাল অপারেটিং সিস্টেম’ অনলাইন সফটওয়্যারের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের আট প্রবেশমুখে অনলাইনে গেট ফি দেওয়ার পদ্ধতি চালু হয় ২০২১ সালের ১১ জুলাই। এতে প্রতিটি গেটের পাস কাউন্টারে সার্ভিস ডেস্ক চালু করা হয়েছিল। নতুন নিয়মটির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ওই বছর পরিবহন-সংশ্লিষ্টদের দুই মাস সময় বেঁধে দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের ২ আগস্ট বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ থেকে চিঠি ইস্যু করে বলা হয়, ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে অনলাইন ফি পরিশোধ ছাড়া বন্দরের ভেতর কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু সময় গড়িয়ে গেলেও বন্দরের এই প্রকল্পটি থেকে যায় কাগজে-কলমে। বছরের পর বছর পণ্য পরিবহন চালকরা বন্দরের ভেতরে প্রবেশ ফি দিয়ে আসছেন প্রথাগত নিয়মে।
এদিকে উদ্যোগটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় দুর্নীতির সুযোগ পায় বন্দরের গেটে দায়িত্বরত নিরাপত্তারক্ষীরা। বন্দরের আটটি গেটের প্রতিটির প্রবেশ মুখে গেটপাস ইস্যুতে তিনজন করে নিরাপত্তারক্ষী দায়িত্বে নিয়োজিত। তারা আট ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করে। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় ৯জন দায়িত্বে থাকেন। বন্দরের ভেতর প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজার গাড়ি চলাচল করে। বন্দরের ভেতরে গাড়ি প্রবেশে সরকার নির্ধারিত ফি ৫৭ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু নিরাপত্তারক্ষীরা ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত চালকদের কাছ থেকে আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। আর এভাবে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা অন্যায়ভাবে হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা।
তিন বছর পর চলতি বছরের জুলাই মাসে আবারও বন্দরে গাড়ি প্রবেশে ‘ডিজিটাল গেট ফি’ পদ্ধতি নিয়ে নড়েচড়ে বসে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। গত ১ জুলাই বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগে বিষয়টি নিয়ে সভা করেন দপ্তরটির পরিচালক। পদ্ধতি বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই (ট্রায়াল) করতে সেদিন পাঁচটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে নির্বাচন করেন পরিচালক।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ট্রিম ট্রেড লিমিটেড, পারাবার শিপিং, হবিগঞ্জ এগ্রো লিমিটেড, জি শিপিং লাইন্স ও অমর ইন্টারন্যাশনাল। পরবর্তী সময় সেপ্টেম্বর মাসে এফএফ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, মেসার্স সৈকত ট্রেডিং এজেন্সি, সিলভার সিন্ডিকেট, মেসার্স আলাউদ্দিন, মেসার্স কবির এন্টারপ্রাইজসহ আরও ২০ সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে যুক্ত করে অক্টোবর পর্যন্ত ট্রায়ালের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। সময় সাশ্রয় ও কাজে গতি ফেরানোর উদ্যোগটি নিয়ে কাজ করায় বেশ খুশি ব্যবসায়ী, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও পণ্যবাহী পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইমাম মাহমুদ বিলু খবরের কাগজকে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এটা ভালো উদ্যোগ। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফি দিয়ে বন্দরে গাড়ি প্রবেশ করাতে পারলে অনেক সময় বেঁচে যাবে। তবে আমাদের চালকদের অনেকেই সিস্টেমটা বুঝে উঠতে পারেন না, অনেকে আগেভাগে না করে বন্দরের গেটে এসে অনলাইনে টাকা জমা দিতে চান। সবমিলিয়ে সিস্টেমটা এখনো পুরোদমে সচল হয়নি। আমরা মনে করি, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। মাসখানেক প্রশিক্ষণ দিলে সিস্টেমটা পুরোদমে সফল করা সম্ভব হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চলতি নভেম্বর মাসে অনলাইন সিস্টেমটি পুরোদমে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে বন্দরে গাড়ি প্রবেশের জন্য চালকরা অনলাইন এবং ম্যানুয়াল- এই দুটি পদ্ধতিতে ফি জমা দিয়ে থাকেন। তবে বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের উপপরিচালক মেজর মো. আনিস-উজ-জামান বলেন, ‘নতুন সিস্টেমটি পুরোপুরি কার্যকর করতে কিছুটা সময় লাগবে। চালকদের প্রশিক্ষণ ও সিস্টেমের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে আরও কিছু সময় প্রয়োজন। তবে বন্দরের পণ্য খালাসের কাজ দ্রুততার সঙ্গে করতে এবং হয়রানি কমাতে অনলাইন সিস্টেমের বাস্তবায়ন জরুরি।
তবে, নতুন সিস্টেমের একাধিক অভিযোগ উঠেছে। অনলাইনে ফি জমা দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করতে চাওয়া চালকদের অনেক সময় নিরাপত্তারক্ষীরা হয়রানি করছেন।
কাভার্ডভ্যান চালক আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি অনলাইনে ফি জমা দিয়ে টিকিট দেখালে নিরাপত্তারক্ষীরা আবারও ফি জমা দিতে বলেন এবং তার পাসকার্ড ও মোবাইল কেড়ে নেন। তিনি অভিযোগ করেন, নিরাপত্তারক্ষীরা আগে থেকেই অতিরিক্ত টাকা আদায় করতেন, যা এখনো চলছে।
পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব চৌধুরী জাফর আহমেদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে অনলাইন সিস্টেম বাস্তবায়নের জন্য তারা চেষ্টা করছেন, তবে নিরাপত্তারক্ষীদের অপ্রত্যাশিত আচরণ বাধার সৃষ্টি করছে।’ বাংলাদেশ ট্রাকচালক শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজি উল্লাহ জানান, আগে বন্দর গেটে পাসের জন্য নিরাপত্তারক্ষীরা অতিরিক্ত টাকা আদায় করতেন, যা অনলাইন সিস্টেম চালু হলে বন্ধ হবে বলে আশা করছেন।