রাজস্ব খাতের দুর্নীতি কমাতে কঠোর আইন হচ্ছে। পাশাপাশি ফাঁকি বন্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। এর ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আদায় কয়েকগুণ বাড়বে বলে মনে করছেন কর্মকর্তরা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এনবিআর কী করেছে এবং চলতি অর্থবছরের বাকি সময়ে কর্ম পরিকল্পনা কী তা নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনে দুর্নীতি কমানো এবং আইনি প্রয়োগের কথা জানানো হয়েছে।
এ প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছেও ওই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এনবিআর কর দাতার সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি রিটার্ন জমা বাড়াতেও জোর দিয়েছে। ভবিষ্যতে শুধু অন লাইনে রিটার্ন জমার সুযোগ রাখা হবে। চার সিটি করপোরেশন, তফসিলি ব্যাংক ও চারটি মোবাইল অপারেটর এবং ছয়টি বহুজাতিক কোম্পানির সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত অন লাইনে রিটার্ন জমার সংখ্যা ৭ লাখ ছাড়িয়েছে। রাজস্ব সংস্কারে কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তি, চট্টগ্রাম কাস্টমের ঝুঁকিপূর্ণ অতিদাহ্য কনটেইনার নিলামে খালাস, বন্ডের অপব্যবহার বন্ধ করার পাশাপাশি ভোগান্তি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া নয়েছে। সঠিক সব তথ্য-উপাত্ত আইভাস সঙ্গে সংযুক্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ে এই সিস্টেমের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। আইভাসের সঙ্গে এ-চালান ও ই-ইনভয়েসিংয়ের আন্তসংযোগ এবং সিস্টেমের ক্যাপাসিটি বাড়াতে নতুন স্টোরেজে ডেটা মাইগ্রেশন, ই-ভিডিএস সিস্টেমের সমন্বয়বিষয়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিটা শুল্ক স্টেশনে মিথ্যা ঘোষণা বন্ধে জোর দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ব্যবহৃত সফটওয়্যার আরও আধুনিক করা হয়েছে। ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডোর (এনএসডব্লিউ) সঙ্গে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের এপিআই, এনএসডব্লিউ ও আইভাস সিস্টেমে বিন-এর তথ্য সংযোগ, আমদানি-রপ্তানিতে ১৯টি দপ্তরকে একক প্ল্যাটফর্মের অধীনে আনা, ই-আপিল ও অ্যাডভান্স রুলিংয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। ভোমরা, সোনামসজিদ, হিলি ও বুড়িমারী স্থলবন্দরের অকশন মডিউল চালু, ৪৫টি এইচ এস কোডে ভ্যালুয়েশন মডিউল চালু করা হয়েছে। চোরাচালান রোধ এবং ব্যাগেজ ব্যবস্থায় স্বর্ণ আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ব্যাগেজ রুল সংশোধন করার উদ্যোগ, ইএক্সপি ছাড়া পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি নিরসনে ১০০ কেজি বা তার বেশি ওজনের পণ্য চালান বাধ্যতামূলক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় আনা হয়েছে। বন্ডব্যবস্থা সহজ করতে নতুন কাস্টমস আইনের অধীনে ছয়টি বিধিমালা প্রণয়ন, পোশাকশিল্প ব্যতীত অন্যান্য ওয়্যারহাউস লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনার আদেশ জারি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভ্যাট খাতে আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস-ইএফডি বা ভ্যাট যন্ত্র বসানোর পাশাপাশি অন্য আরও আধুনিক পদ্ধতি চালু করার বিষয়টি নিয়েও প্রস্তুতি চলছে। এসবের পাশাপাশি সম্প্রতি প্রকাশিত অর্থনীতির শ্বেতপত্রে রাজস্ব খাতের যে সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়েছে তার সমাধানেও কাজ শুরু করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্বেতপত্রে বিগত সরকারের সময়ে দেওয়া সব ধরনের রাজস্ব অব্যাহতি প্রত্যাহারে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এসব উদ্যোগের পাশাপাশি এনবিআরের তিন গোয়েন্দা শাখার কাজের গতি বাড়িয়ে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে বিগত সরকারের কাছের লোক বলে পরিচিত এক হাজারের বেশি ব্যক্তির রাজস্ব ফাঁকির অনুসন্ধানের কাজ চলছে। এর মধ্যে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা, পুলিশ, সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীসহ বিগত সরকারের সময়ের শতাধিক অতি প্রভাবশালী ব্যক্তিও আছেন বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা যায়, এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর যে অবস্থান থেকে কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজের সুবিধায় নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদানও করছে।
এরই মধ্যে সিআইসি ৩৭৬ জনের বিরুদ্ধে আয়কর ফাঁকি, ভ্যাট গোয়েন্দা ৩০টি ভ্যাট ফাঁকি এবং শুল্ক গোয়েন্দা ৭৩টি মামলা করেছে। ৪৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার পাশাপাশি খুলে দেওয়া হয়েছে খালেদা জিয়া, আবদুল আউয়াল মিন্টুসহ ছয়জনের ব্যাংক হিসাব।
শুল্ক শাখার মামলায় জড়িত রাজস্ব ৪৬ কোটি টাকার বেশি। আদায় হয়েছে ১০.১২ কোটি টাকা। আটক করেছে ৫০ কোটি টাকার বেশি সোনা ও স্বর্ণালংকার। ভ্যাট গোয়েন্দা শতাধিক নিরীক্ষা শেষ করে ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন করেছে ২০০ কোটি টাকার বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনস্বার্থে এনবিআর কাজ করছে। এক্ষেত্রে রাজস্ব ছাড়ও দিয়েছে। বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে রাজস্ব ছাড় দিয়ে ভোজ্যতেল, ডিম, আলু, পেঁয়াজ, চাল ও কীটনাশক আমদানির ওপর শুল্ককর ও ভ্যাট কমানো এবং তুলে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজস্ব আদায়ের তিনটি অনুবিভাগের (আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট) কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জন্য ১৯টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পাশপাশি জনকল্যাণে রাজস্ব ছাড়ের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি,এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হলে রাজস্ব আদায় বাড়বে। ব্যবসায় গতি আসবে। করদাতাবান্ধব পরিবেশ তৈরি হবে।
তিনি আরও বলেন, দুর্নীতি বন্ধে জোর দেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে। সব ধরনের কর ফাঁকি বন্ধ করতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সব পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও যোগ্যতাকে ভিত্তি ধরে পদোন্নতির ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।