আটা, সুজি, ডাল ছাড়া খুচরা বিক্রেতারা টিকে গ্রুপের পুষ্টি সয়াবিন তেল দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, দেড় মাস আগে তেলের দাম বাড়ানোর পর আবার মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এ জন্য মিলমালিকরা সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। কেউ তেলের সঙ্গে অন্য জিনিসও ধরিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে শর্ত দিয়ে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে, যা ভোক্তা আইনের লঙ্ঘন।
এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে ডিম, মুরগি, চালের দাম কমেনি। তবে সবজির দাম কমতির দিকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) কৃষি মার্কেট, কারওয়ান বাজার, নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি দামের অজুহাতে মিলমালিকরা চাপ দিলে সরকার গত ৯ ডিসেম্বর সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৭৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। ওই দিন বাণিজ্য উপদেষ্টা বশির উদ্দিন বলেছিলেন, ‘তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করি বাজারে আর তেলের ঘাটতি হবে না। কিন্তু প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হলেও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। সংকট কাটছে না। বিভিন্ন কোম্পানির পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও এক ও দুই লিটারের তেল সহজে মেলে না। আবার পাওয়া গেলেও আটা, সুজি, ডাল ছাড়া বিক্রি করতে চাচ্ছেন না বিক্রেতারা।’
সয়াবিন তেলের ব্যাপারে মোহাম্মদপুরের ফিউচার হাউজিংয়ের বাসিন্দা ফরহাদুর রহমান অভিযোগ করে খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভাবতে অবাক লাগছে। ডাল ছাড়া তেল দিচ্ছেন না খুচরা বিক্রেতারা।’
তার এমন অভিযোগের সত্যতা জানার জন্য সরেজমিনে গেলে কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের হাজি স্টোরের মো. কামাল গাজী বলেন, ‘এখানে কথা না বলে ডিলারের কাছে যান, তেলের মিলে যান। তাদের কাছে বলেন, আটা, সুজি, ডাল ছাড়া তেল দেওয়া হয় না কেন? আমরা চুনোপুঁটি। তেলের দাম বাড়ানোর পরও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। আবার এক কার্টন তেল দেওয়া হলে পুষ্টি কোম্পানির পাইকারি বিক্রেতারা (ডিলার) এক বস্তা আটা ধরিয়ে দিচ্ছেন। অন্য কোম্পানিও আগে এটা করত। বর্তমানে টিকে গ্রুপের পুষ্টি ব্র্যান্ডের লোকেরা এ কাজ করছেন। আবার তেলের দামও বেশি নিচ্ছেন। পাঁচ লিটারের পুষ্টি তেলের দাম রাখা হচ্ছে ৮৫০ টাকা। যার গায়ে লেখা খুচরা মূল্য ৮৫২ টাকা। এভাবে বেশি দামে কিনে আমরা কী লাভ করব। মিল থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ডিলাররাও বেশি দাম নিচ্ছেন।’
এদিকে কৃষি মার্কেটের মেসার্স পারভেজ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী পারভেজ হোসেনও বলেন, ‘টিকে গ্রুপের পুষ্টি কিছু তেল দিচ্ছে। কিন্তু আটা নিতে শর্ত দিচ্ছে। এই বাজারের ইউসুফ জেনারেল স্টোর, মেসার্স মায়ের দোয়া স্টোরসহ অন্যান্য বাজারের খুচরা বিক্রেতাদেরও অভিযোগ মিলমালিকরা তেলের দাম বাড়ানোর জন্য কৌশল করে থাকেন। এ জন্য প্রথমে তারা সরবরাহ কমিয়ে দেন। তারা এটা করার কারণে ডিলার ও পাইকারি বিক্রেতারাও তেলের দাম বাড়িয়ে দেন। আবার কেউ কেউ অন্য পণ্য ছাড়া দেন না।’
এ ব্যাপারে টিকে গ্রুপের ডিলার মেসার্স ছিদ্দিক এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. সিদ্দিক বলেন, ‘পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল ৮৪০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। কারও কি আটা-ডাল লাগে না। আপনার লাগে না। কিনলে সমস্যা কী? এগুলো করে লাভ কী। সব কোম্পানি এভাবে দেয়। আমরাও কোম্পানি থেকে এনে বিক্রি করি।’
ভোক্তা অধিদপ্তর বলছে, শর্ত দিয়ে পণ্য বিক্রি করা রীতিমতো আইনের লঙ্ঘন। কোনো বিধান নেই। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সমাজে অসাধু লোকের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। কেউ চুরি করলে তা স্বীকার করে না। তাই ধরা কঠিন। তার পরও বলব, ভোক্তা অধিদপ্তর আইনের আওতায় কাজ করে। প্রমাণ নিয়ে কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করলে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
আসলে সংকট কোথায়? এসব জানতে ভোজ্যতেল উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও টিকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা হায়দারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘কোনো ডিলার বা খুচরা বিক্রেতা কীভাবে শর্ত দিয়ে পণ্য বিক্রি করছে জানি না। তবে আমাদের কোম্পানি এমন কোনো শর্ত দিয়ে তেল বিক্রি করে না।’
তেল সরবরাহের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমরা (টিকে গ্রুপ) আগের মতোই তেল সরবরাহ করছি। অন্য কোম্পানি কী করছে, তা আমার জানা নেই। ব্যবসার টার্গেট থাকে। আমরাও ডিলারদের বিক্রির টার্গেট দিই। কিন্তু কোনো শর্ত দিয়ে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করি না। স্বাভাবিক নিয়মেই ব্যবসা করা হচ্ছে। রমজানের জন্য সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে। তেলের কোনো ঘাটতি দেখছি না।’
এখনো বাড়তি দামেই চাল বিক্রি
সরকার চালের দাম কমাতে আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে। তার পরও বাজারে আগের মতোই বেশি দামে মিনিকেটের কেজি ৭২-৮৫ টাকা, আটাশ চাল ৬২-৬৫, মোটা চাল ৫৪-৫৬ টাকা বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন বাজারের খুচরা বিক্রেতারা বলেন, আগের মতোই ছোলার কেজি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, মসুর ডাল ১১০ থেকে ১৩৫, দুই কেজি ওজনের প্যাকেট আটা ১০০ থেকে ১৩০, চিনি ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
কমেনি মুরগির দাম
সপ্তাহের ব্যবধানে মুরগির দামও কমেনি। খুচরা বিক্রেতারা বলেন, আগের মতোই ব্রয়লার ১৯০ থেকে ২১০ টাকা, সোনালি ৩৩০ থেকে ৩৫০, দেশি মুরগি ৫৫০ থেকে ৬০০, গরুর মাংস ৭০০-৭৫০ ও খাসির মাংস ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা কেজি এবং ডিম ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা ডজন বিক্রি করা হচ্ছে।
কমতির দিকে সবজি
সপ্তাহের ব্যবধানে আলুর দাম কেজিতে ৫ টাকা কমে ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। পেঁয়াজের দামও ৫ টাকা কমে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, দেশি আদা ১২০ ও আমদানি করাটা ২২০ ও রসুন ২২০ থেকে ২৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন বাজারের সবজি বিক্রেতারা বলেন, বেগুনের দামও ১০ টাকা কমে ৪০ থেকে ৬০ টাকা কেজি, শিম ৩০ থেকে ৫০, কাঁচা মরিচ ৮০ থেকে ৯০, টমেটো ৪০ থেকে ৫০, পেঁপে ৪০ থেকে ৫০, শসা ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ফুলকপির পিস ১৫ থেকে ২০ টাকা, বাঁধাকপি ২৫ থেকে ৩০, লাউ ও চালকুমড়ার পিস ৪০ থেকে ৫০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। তবে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় এসব পণ্য আরও কম দামে বিক্রি করতে দেখা গেছে।