ইলেকট্রনিক করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বা ইটিআইএন থাকলেই রিটার্ন জমা দিতে হবে। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি ব্যক্তিশ্রেণির আয়কর রিটার্ন জমার শেষ দিন। ওই সময়ের মধ্যে যারা রিটার্ন জমা দেবেন না, তার পরের দিন থেকে অর্থাৎ ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে নোটিশ পাঠাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। নোটিশে রিটার্ন জমা না দেওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হবে। নোটিশ পাওয়ার সাত কর্মদিবসের মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে রিটার্ন জমা দিতে হবে। নোটিশের সন্তোষজনক জবাব না পাওয়া গেলে করদাতাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনবিআরের এ সিদ্ধান্তের ফলে করদাতারা হয়রানির শিকার হবেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এনবিআর সূত্র জানায়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন জমা না দিলে জরিমানা করা হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, মাসে ৩০ হাজার ৩৫ হাজার টাকা আয় করে সংসার চালিয়ে তিন বেলা পুষ্টিকর খাবার খাওয়া সম্ভব হয় না। অনেকে খাবার তালিকা থেকে অনেক নিয়মিত খাবারও কাটছাঁট করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ করদাতাদের কর পরিশোধ করা ও রিটার্ন জমায় কঠোরতা আনা ঠিক হবে না বরং এনবিআরকে করমুক্ত আয়সীমা আরও বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ধনীরা খুব কৌশলী। তারা নিজেদের আইন বিশেষজ্ঞ দিয়ে খুব কায়দা করে কর ফাঁকি দেন। এনবিআরের পক্ষে বেশির ভাগ সময় এদের ধরা সম্ভব হয় না। এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
করদাতা বেসরকারি চাকরিজীবী মাইদুল হাসান খবরের কাগজকে বলেন, মাসে ৪৫ হাজার টাকা আয় করে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। গত দুই বছর ধরে কর পরিশোধ ও রিটার্ন জমা কোনোটাই করতে পারিনি। এমন পরিস্থিতিতে কর ও রিটার্ন পরিশোধ করায় কঠোরতা আনা হলে কষ্ট আরও বেড়ে যাবে।
এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ইটিআইএন থাকার পরও যারা দীর্ঘদিন ধরে রিটার্ন দাখিল করছেন না, তাদের এনবিআর থেকে শিগগিরই নোটিশ পাঠানো হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘যারা রিটার্ন দাখিল করছেন না, তাদের কোনো সমস্যায়ও পড়তে হচ্ছে না। তাই আমরা এ বিষয়ে এনফোর্সমেন্টে যাচ্ছি। আমাদের নাগরিকরা বিদেশে গিয়ে আইন ভঙ্গ করছেন না। কিন্তু দেশে আমরা আইন মানি না। তার মানে এ সমস্যার সমাধান করতে আইনের প্রয়োগ করা হয় না, এটাই সমস্যা।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, অনেকে ইটিআইএন গ্রহণ করার পর দুই-এক বছর রিটার্ন দিলেও কোনো কারণ ছাড়াই পরের করবর্ষে আর দেন না। এবার থেকে এসব চলবে না। ইটিআইএন থাকলেই বাধ্যতামূলক আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে। যারা দেবেন না, তাদের নোটিশ পাঠানো হবে। নোটিশের সন্তোষজনক জবাব না দিলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে এনবিআর।
রিটার্ন জমার সময় ১৬ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা । এ সময়ের পর ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে নোটিশ পাঠানো হবে। নোটিশ পাঠানোর সময় থেকে অর্থাৎ ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে কর পরিশোধ ও রিটার্ন জমা দিলে কর অব্যাহতির, করমুক্ত এবং হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের সুবিধা পাবে না। বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত সুবিধাও পাবে না। নিয়মিত করের পাশাপাশি নির্ধারিত হারে জরিমানা দিতে হবে- এক হাজার টাকা। একই সঙ্গে প্রতিদিন ৫০ টাকা করে জরিমানা করা হবে।
মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। চলতি অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের আগে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর দাবি করলেও বিগত সরকার তা আমলে নেয়নি। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরেও সাধারণ করমুক্ত আয়সীমা আগের মতো ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা রাখা হয়। ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী নারী ও প্রবীণ নাগরিকদের করমুক্ত আয়সীমা হবে চার লাখ টাকা, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের করদাতাদের জন্য ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এবং যুদ্ধাহত গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা আছে।
বর্তমানে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ এক করবর্ষে একজন ব্যক্তির আয় ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি হলেই তাকে কর পরিশোধ করতে হবে। হিসাব কষে দেখা যায়, এক মাসে নিট আয় ২৯ হাজার ১৬৭ টাকার বেশি হলেই কর দিতে হবে। বর্তমানে সর্বনিম্ন করহার ৫ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ।
করোনা শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত প্রায় সব ধরনের খরচই বাড়তে থাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ডলারসংকট দেখা দেয়। সাধারণ ব্যবসায়ীদের অনেকে এলসি খোলার সুযোগ পাননি। ফলে আমদানি কমতে থাকে। বাজারে পণ্য সংকট দেখা দেয়। অন্য দিকে আন্তর্জাতিকে বাজার থেকে যা কেনা হয় তার দামও বেশি পড়ে। অসাধু ব্যবসায়ীরা ডলার সংকটের অজুহাত দেখিয়ে দাম আরও বাড়িয়ে দেন। তবে সব ধরনের খরচ বাড়লেও সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। গত কয়েক বছর ধরেই খরচের চাপে দিশেহারা অল্প আয়ের মানুষ। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে, ধার-দেনা করেও চলছে। এমন পরিস্থিতিতে, করদাতাদের ওপর কঠোর অবস্থান নিল এনবিআর।