
‘পানের বাটা লড়ে চড়ে পান নাইগো মোর ঘরে, জামাইর মারে দেইক্কা আইছি পান্না বেটার ঘরে’ সিলেটি এই বিয়ের ধামাইল গীতের মতোই পান ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না সিলেটের বিয়ে। এমনকি বিয়ের আগে ‘পানচিনি’ নামে একটি অনুষ্ঠানেরও প্রচল আছে আমাদের দেশে। এই পানচিনি অনুষ্ঠান হয় পাত্র-পাত্রী পছন্দ হওয়ার পর। মূলত বিয়ের তারিখ, বিয়ের মোহরানাসহ যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা ঠিক করতে কনের বাড়িতে বরপক্ষের মুরব্বিরা মিষ্টিমণ্ডার পাশাপাশি সঙ্গে নিয়ে যান পান। এ ছাড়া বিয়ের দিনও কনের বাড়ি থেকে বরের বাড়িতে পান দেওয়া হয়।
তাই যুগ যুগ ধরেই সিলেটি বিয়েতে বড় কনের বাড়িতে পানের ডালা সাজিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচলন চলে আসছে। আগেকার দিনে বর-কনের ছোট বোন বা ভাবি এসব পানের ডালা সাজাতেন। তবে বর্তমানে সময় বাঁচানো ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য অনেকেই স্থানীয় ক্রাফটারের কাছ থেকে পানের ডালা সাজিয়ে নেন। আর এখন রাজধানীর পাশাপাশি সিলেটেও আছেন এমন একজন নারী উদ্যোক্তা। যিনি পান, সুপারি, চুন যেভাবে মানুষের মুখের ভেতর রঙিন করে, তেমনি বাহারি পানের ডালা সাজিয়ে মানুষজনের বিয়ের অনুষ্ঠান রঙিন করে তোলেন অমাবস্যা চৌধুরী।
সিলেট নগরীর সুবিদ বাজার এলাকার বাসিন্দা অমাবস্যা। ছোটবেলা থেকেই কাগজ-কাপড় দিয়ে সুন্দর ডিজাইনের ক্রাফট তৈরি করে ঘর সাজাতেন। আত্মীয়স্বজনের বিয়েতে মনের আনন্দে পানের ডালা সাজিয়ে দিতেন। তবে ২০২০ সালে তার এক ব্যবসায়ী বড় বোন ফারমিছ আক্তারের পরামর্শে পেশাদারিভাবে পানের ডালা সাজানোসহ নানা রকম ক্রাফটিংয়ের কাজ শুরু করেন।
পানের ডালার পাশাপাশি বিয়ের শাড়ির ডালা, মানি বাকেট, জন্মদিনের জন্য বা বিয়ের জন্য গিফট বক্স তৈরি করেন তিনি। নিজের ফেসবুক আইডি ‘অমাবস্যা চৌধুরী’ ও ব্যবসায়িক পেজ ‘পানদান ক্রাফট বাই অমাবস্যা চৌধুরী’ থেকে তিনি সব অর্ডার নেন। পাশাপাশি অনেক পরিচিতজন সরাসরি ফোনেও তাকে অর্ডার দেন। ডিজাইন ও আকারভেদে আড়াই হাজার থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকায় পানের ডালা সাজান তিনি। বিয়ের শাড়ির ঢালা, মানি বাকেট, জন্মদিনের জন্য বা বিয়ের জন্য গিফট বক্সে দাম নির্ধারণ করেন ক্রেতার অর্ডার অনুযায়ী। এখন পর্যন্ত তিনি ৫০ কেজি ওজনের লেহেঙ্গার ডালাও সাজিয়েছেন।
অক্টোবর থেকে মার্চ মাসকে বিয়ের মৌসুম ধরে এই ছয় মাসে সব খরচ বাদ দিয়ে ৬০ হাজার টাকা লাভ থাকে তার। তবে বিয়ের সিজন ছাড়াও সারা বছরই কমবেশি ক্রাফটিংয়ের কাজ করেন অমাবস্যা। এই চার বছরে ক্রাফটিংয়ের কাজের মাধ্যমে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছেন।
ক্রাফটার অমাবস্যা চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘ক্রাফটিংয়ের কাজ করতে আমার ভালো লাগত। ২০২০ সালে আমার পরিচিত ব্যবসায়ী বড় বোন ফারমিছ আপার ননদের বিয়েতে যাই। সেখানে তিনি আমাকে পানের ডালা সাজানোর দায়িত্ব দিলেন। আমি তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সব কিনে ডালা সাজিয়ে দিলাম। তিনি পানের ডালা দেখে আমাকে বললেন আমি অনেক সুন্দর পানের ডালা সাজাই। আমি যেন প্রফেশনালভাবে এই কাজ শুরু করি। তার উৎসাহে আমি কাজ শুরু করি। এই চার বছরে অনেক কাজ করেছি। আয় হয়তো কমবেশি হয়েছে। কিন্তু আমার কাজ সবাই পছন্দ করেছেন। একজন মানুষের একটি বিশেষ দিনে আমার তৈরি পানের ডালা অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে, এটাই আমার প্রাপ্তি।’
অমাবস্যা চৌধুরী বলেন, ‘কোনো কাজই ছোট নয়। মন দিয়ে করলে সব কাজেই সফলতা আসে। আমি একজন উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি এই ক্রাফটিংয়ের মাধ্যমে। কারণ বর্তমানে সবাই সৃজনশীলতা পছন্দ করে। যেকোনো কাজে নতুনত্ব চায় সবাই। তাই আমি মনে করি, যে কাজটি আমি করছি, সেটির সব সময় চাহিদা থাকবে। কারণ সবকিছু বন্ধ হলেও বিয়ে কখনো বন্ধ হবে না।’