জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য আগামী ২০৩১ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি চেয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)। এর বাইরে করহার কমানোসহ বিভিন্ন নীতিসহায়তা চেয়েছে ডজনখানেক ব্যবসাসংগঠন। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতি কমালে কর দিতে প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) দুপুরে রাজধানীতে এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে এনবিআর আয়োজিত প্রাক-বাজেট আলোচনায় বিভিন্ন সংগঠনের ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন। আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান।
অনুষ্ঠানে বেসিসের কো-চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি রয়েছে। আইসিটি বিভাগ তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশের জন্য ২০৩১ সাল পর্যন্ত রোডম্যাপ করেছে। দেশের প্রযুক্তি খাতের বিকাশের জন্য ওই রোডম্যাপের সঙ্গে মিলিয়ে আমরাও ওই সময় পর্যন্ত কর অব্যাহতির দাবি জানাচ্ছি।’
একই সঙ্গে ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠার আগে ক্যাশলেস ট্রানজেকশনের শর্ত শিথিল করা, দেশি সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তির ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার, সফটওয়্যার রপ্তানিতে প্রণোদনা ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে বেসিস।
এদিকে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধ করতে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিলেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহদাত হোসেন সোহেল বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আপনি দুর্নীতি বন্ধ করুন। ব্যবসায়ীরা আপনাদের সবকিছু দেবে।’
তিনি বলেন, ‘যাদের বন্ড নাই, তারা যখন রপ্তানিতে যায়, তখন চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন জায়গায় অনেক কিছু হয়। আমার কাছে প্রতিটি ভয়েস মেসেজ আছে। আপনাকে পাঠিয়েছিলাম। এখনো বন্ধ হয় নাই। আপনার কাছে আবারও অনুরোধ করব, আপনার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তারা অনেক শক্তিশালী। আপনার মেম্বার সাহেব আপনার থেকেও শক্তিশালী।’
শাহদাত হোসেন সোহেল বলেন, ‘পরশু দিন একটা ফোন এসেছে। আমাকে দেখা করতে বলল। আমি যখন বললাম, আমি এনবিআর চেয়ারম্যানসহ অনেককেই চিনি, তখন বলে জি স্যার, জি স্যার। দিস ইজ দ্য সিনারিও।’
এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘আপনাদের অভিযোগ জানাতে হবে। আপনি না দিলে সে নেবে কোথা থেকে? আপনারা জানান, দুদক ধরতে পারে, এনবিআরও ধরতে পারে।’
চেয়ারম্যান বলেন, ‘ট্রানজেকশন এখন ক্যামেরা দিয়ে রেকর্ড করে ফেলা যায়। কথোপকথন রেকর্ড করে ফেলা যায়। শত শত কোটি টাকা খরচ করে অভিযোগ জানানো অনলাইন সিস্টেম চালু করেছি। এটা আপনাদের ব্যবহার করতে হবে।’
অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়ে বাংলাদেশ প্ল্যাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কে এম ইকবাল বলেন, ‘কদিন আগে পানগাঁওয়ে দুটি কনটেইনার আটকানো হলো আমান প্ল্যাস্টিকের। দুটির ডিউটি ৭ কোটি টাকা দাবি করা হয়। সরকার পরিবর্তনের পর সেই কনটেইনার ছেলেটি কোটি টাকা দিয়ে ছাড়িয়েছে।’
বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিলেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন উৎসে কর্তনের হার হ্রাস করা, নগদ প্রণোদনা থেকে উৎসে কর কর্তনের হার কমানোর প্রস্তাব দেয়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ভারতীয় সুতার প্রভাবে আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ৭-৮ কোটি টাকার সুতা অবিক্রীত রয়েছে। আমরা মুনাফা করতে পারছি না।’
বিটিএমএর আরেক পরিচালক শহীদ আলম বলেন, ‘তাহলে কি আমরা কারখানা বন্ধ করে দেব? আমরা চোরাচালানের জন্য পণ্য বিক্রি করতে পারছি না।’
ভারতীয় সুতা এত কম দামে আসে কীভাবে, প্রশ্ন তুলে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘গত কয়েক মাসে আমরা অনেক কর অব্যাহতি বাতিল করেছি। সেসব অব্যাহতি এ বছরের জুনে শেষ হবে। এরপর আর নতুন করে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে না।’
রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকারের নীতিসহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ)। পাশাপাশি আসন্ন বাজেটে রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে কর অর্ধেক কমানোর দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
এ বিষয়ে সংগঠনের সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, ‘আমরা আগামী ৫ বছরের জন্য উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০ দশমিক ৫০ শতাংশ করা, ব্যক্তিপর্যায়ে করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪ লাখ টাকা করা, কোম্পানির ক্ষেত্রে সঞ্চয়ী আমানত, স্থায়ী আমানত ইত্যাদির সুদ বা মুনাফার ওপর উৎসে কর ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করছি।’
বাজেট আলোচনায় প্লাস্টিকের খেলনা প্রস্তুতে ২৪ ধরনের কাঁচামাল আমদানিতে করছাড় চেয়েছে বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপিজিএমইএ)। আমদানি করা ১৪টি কাঁচামালে করছাড় চেয়েছে বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতি। রপ্তানির উদ্দেশ্যে উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাঁচামাল বাবদ আরোপযোগ্য শুল্ক ও করের বিপরীতে শতভাগ ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে বন্ড সুবিধা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ফার্নিচার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন।
সভায় বাংলাদেশ এলপিজি অটোগ্যাস স্টেশন অ্যান্ড কনভারসন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এলপিজি অটোগ্যাস সেক্টরকে ট্যাক্স হলিডে সুবিধা প্রদান, এলপিজি কনভারসন কিট, সিলিন্ডার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়েছে। পাশাপাশি ভোক্তাপর্যায়ে অটোগ্যাসের বিক্রিমূল্যের সঙ্গে সংযোজিত মূসক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছে।
বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা প্রদান, নগদ সহায়তার ওপর ১০ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছেন বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সভাপতি তারিকুল ইসলাম জহির। বাংলাদেশ বিস্কুট, ব্রেড ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতি কেক, বিস্কুট ও কনফেকশনারি পণ্যে শুল্ক অব্যাহতি চেয়েছে।
দি বাংলাদেশ জুয়েলারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘হীরা আমদানি-রপ্তানিতে মূসকের ওপর ২০ শতাংশ ভর্তুকি প্রদান ও স্বর্ণের গহনার ক্ষেত্রে তিন বছরের জন্য মূসকের ওপর ৫০ শতাংশ ভর্তুকি প্রদানের প্রস্তাব করছি।’
এ ছাড়া বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশন ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে এআইটি ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে।