উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশেও বাড়ছে কাগুজে টাকার পরিবর্তে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন। দেশে সব ধরনের কার্ডে লেনদেন অব্যাহতভাবে বাড়ছে। লেনদেনে স্বচ্ছতা বাড়ানো, ঝুঁকিমুক্ত, কম খরচ ও দ্রুত করতে আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত শহরকেন্দ্রিক নাগরিকরা কার্ড ছাড়া নিজেদের অচল মনে করেন।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখনো দেশের বড় অংশের মানুষের ব্যক্তিগত লেনদেন নগদ টাকায় সম্পন্ন হচ্ছে। পাশাপাশি কার্ডের মাধ্যমে যে লেনদেন হচ্ছে তা আর্থিক খাতের মোট লেনদেনের তুলনায় হয়তো অনেক কম। তবে আশার দিক হচ্ছে, দিনকে দিন কার্ডে লেনদেন বাড়ছে। ব্যাংকারদের মতে, শহরের মানুষ এখন অনেক সচেতন। তারা আর নগদ লেনদেন করতে চায় না। শহরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ কার্ডের মাধ্যমে সব ধরনের লেনদেন করে থাকে। যদিও গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ এখনো নগদ লেনদেন করেন।
এই প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, গ্রাহক সহজেই সেবা নিতে চায়। ব্যাংকগুলোও সেদিকে ঝুঁকছে। ফলে বাড়ছে ডিজিটাল লেনদেনের প্রসার। ডলার সংকট এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ফলে মানুষের ভ্রমণ ও চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি বেড়েছে। সেই সঙ্গে ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে মানুষের কেনাকাটাও বেড়েছে। এ ছাড়া অধিকাংশ মানুষ ক্যাশ লেনদেন ছেড়ে কার্ডে লেনদেন করছে। এসব কারণেই কার্ডের লেনদেন প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তিনি বলেন, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক সব সময়ই গ্রাহকদের সর্বোচ্চ মানের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে। তরুণ প্রজন্মের আগ্রহের জায়গা থেকে আমরা চলতি বছর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ তরুণরাই আজকে দেশটাকে নতুন করে বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখিয়েছে। আমরা সেই পরিবেশটা তৈরি করতে চাই, তরুণরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী সেবা পাবে। এজন্য আমরা সম্প্রতি একটা ডিজিটাল ওয়ালেট চালু করেছি, যেখানে এমন কিছু নেই যা পাওয়া যাবে না। এটা পুরোপুরি হয়ে গেলে বড় ঋণের লেনদেন ছাড়া দিনের যাবতীয় সব কাজই গ্রাহক এই কার্ড থেকেই করতে পারবেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে কার্ডের লেনদেন কিছুটা বেড়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
একই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, বর্তমানে মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটা স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে। আবার অর্থনীতির কর্মচাঞ্চল্যও ফিরে এসেছে। তাই মানুষ খরচও বেশি করছে। শহরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ এখন নগদ লেনদেনের পরিবর্তে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন ধরনের কার্ডে লেনদেন বেড়েছে।
একই বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের ইভিপি ও হেড অব কার্ডস অ্যান্ড রিটেইল অ্যাসেট জোয়ার্দ্দার তানভীর ফয়সাল খবরের কাগজকে বলেন, দেশে মানুষের মাঝে কার্ডের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ব্যাংকগুলোও কার্ডের ব্যবহার বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। প্রাইম ব্যাংকের কার্ডের চাহিদাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত তিন বছরে আমাদের ব্যাংকের কার্ডের ব্যবহার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থা এবং ডিজিটাল পেমেন্ট বৃদ্ধির প্রতিফলন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় কার্ড ইস্যুকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রথম অটোমেটেড টেলার মেশিন বা এটিএম যন্ত্র স্থাপন শুরু করে কয়েকটি ব্যাংক। যার মাধ্যমে কার্ড দিয়ে নগদ টাকা তোলার সুযোগ তৈরি হয়। ১৯৯৬ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক দেশে প্রথম ক্রেডিট কার্ড চালু করে। এরপর বিভিন্ন ব্যাংক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কার্ড সেবা নিয়ে আসে। এসব কার্ডের মধ্যে ভিসা, মাস্টারকার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস, ডিসকভার, জেবিসি ও ইউনিয়ন পে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দেশে গত জানুয়ারি মাসে ডেবিট কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৯৩ হাজার ৮৮২। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ৩ কোটি ৫২ লাখ। ক্রেডিট কার্ড রয়েছে ২৭ লাখ ৬ হাজার ৯৮টি। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৪ লাখ ২৯ হাজার। আর প্রি-পেইড কার্ড ইস্যু করা হয়েছে ৭৫ লাখ ৪৭ হাজার ২৪৪টি। সব কার্ড দিয়ে এটিএম ও বিক্রয়কেন্দ্রে (পয়েন্ট অব সেলস) লেনদেন করা যায়। প্রি-পেইড কার্ড দিয়ে গ্যাস-বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করা হয়। এ সময় এসব কার্ডে ৪৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায় দেশে কেনাকাটা বা লেনদেনে নগদ অর্থের পরিবর্তে কার্ডের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে ডেবিট, ক্রেডিট এবং প্রিপেইড কার্ড ইস্যুর পরিমাণ বেড়েছে ১৪২ শতাংশ এবং এই তিন ধরনের কার্ডে লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে ১৬৬ শতাংশ।
কার্ডে কেনাকাটা সহজ ও সুলভ মূল্যে পাওয়ার সহযোগিতা করছে ব্যাংকগুলো
গ্রাহকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে গ্রাহক নগদ টাকা উত্তোলন করার পাশাপাশি বিভিন্ন শপিংমলে কেনাকাটা করতে পারেন। এতে নগদ টাকা বহনের ঝামেলা খুব সহজেই এড়ানো যায়। এবারের ঈদে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে গ্রাহকরা কেনাকাটা করতে গিয়ে অধিকাংশই নগদ টাকার পরিবর্তে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করছেন। জানতে চাইলে নাবিল আহমেদ নামে একজন গ্রাহক খবরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেও ভালো না। তাই আমি ঈদের কেনাকাটার পুরোটাই কার্ডের মাধ্যমে করেছি। এতে প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড যেমন আমার কাছে রয়েছে, তেমনি কোনো ধরনের ঝুঁকিও নিতে হয়নি।
আর ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহক বাকিতে পণ্য কিনে নির্দিষ্ট মেয়াদে সেটা পরিশোধ করতে পারেন। অর্থাৎ গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা না থাকলেও তার কাছে থাকা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে তিনি নির্বিঘ্নে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে পারবেন। বর্তমানে দেশে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ২৭ লাখ। প্রতি মাসে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন করছেন তারা। পরিসংখ্যান বলছে, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীরা সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেন সুপারমার্কেট ও রিটেইল আউটলেটে।
ডিজিটাল লেনদেন মানুষের জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি কিছু সমস্যাও আছে। কার্ডে লেনদেন করতে গিয়ে মানুষ প্রায়ই নানা ধরনের ভোগান্তি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছে। যেমন- অনেক সময় এটিএম বুথে গিয়ে পর্যাপ্ত টাকা পাওয়া যায় না বা কার্ড আটকে যায় অথবা পিন চুরি করে গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এ ছাড়া এসব সেবার বিনিময়ে অনেক সময় ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে বড় অঙ্কের হিডেন চার্জ আরোপ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতারণা ঠেকাতে মানুষকে সচেতন হতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানকেও সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী হতে হবে। মোবাইলে আর্থিক সেবায় একটি সেবাদাতা থেকে অন্য সেবাদাতার হিসাবে যাতে সহজে টাকা লেনদেন করা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। সব সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য উন্মুক্ত করাও দরকার।