
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে নীতিগত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রত্যাশিত দিকনির্দেশনা নেই বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট বা বিল্ড। সংস্থাটির মতে, শুধু তাই নয়, এই মুদ্রানীতির কারণে মূল্যস্ফীতি দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে গবেষণা সংস্থা বিল্ড।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্ধবার্ষিক মুদ্রানীতির মাধ্যমে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছে, তার প্রধান লক্ষ্য হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা, বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ-ব্যবস্থা পুনর্গঠন এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের বৃদ্ধির প্রবণতা মোকাবিলা করা। এতে মূলত অর্থবাজারের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, যা এই মুদ্রানীতির ভালো দিক, তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এবং কর্মসংস্থান বাড়াতে এবারের মুদ্রানীতি খুব বেশি কার্যকর হবে না।
বিল্ডের মতে, নতুন ও চলমান বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি খাত স্বল্প সুদে ঋণ প্রত্যাশা করেছিল। নীতি সুদহার ১০ শতাংশ রাখায় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি করবে, কাঁচামাল আমদানি ব্যয় বাড়াবে, মজুরি বাড়াবে, যন্ত্রপাতির ব্যয় বৃদ্ধি করবে, যা নীতিগতভাবে মূল্যস্ফীতি কমানোর কৌশলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শুধু উচ্চ সুদের হার দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়; সরবরাহ সংকট, আমানতকারীদের আস্থার অভাবসহ অন্যান্য কারণও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। যেন প্রতিযোগিতামূলক বাজার ও সুশাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে সমন্বিতভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
সংস্থাটির মতে, ২০২৪ ও ২০২৫ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ২ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে বলে মুদ্রানীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ২০২৫ অর্থবছরের দ্বিতিয়ার্ধের মুদ্রানীতির মাধ্যমে কীভাবে এই সুবিধা কাজে লাগানো হবে সে বিষয়ে কোনো নতুন নীতিগত নির্দেশনা স্পষ্ট করেনি।
সম্প্রসারিত রাজস্ব নীতি ও সংকোচিত মুদ্রানীতির প্রয়োগ সত্ত্বেও মুদ্রাস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের ওপরে রয়েছে, যদিও ২০২৪ সালের ডিসেম্বর ও ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এটি কিছুটা কমেছে, যা প্রধানত খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমার কারণেই হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী দিনে মুদ্রাস্ফীতি ৭-৮ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
বিল্ডের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজম্যান্ট সুশৃঙ্খল না থাকা, মাঠপর্যায়ে চাঁদাবাজির আধিপত্য, ব্যাপক ইনফরমাল অর্থনীতির উপস্থিতি, রাজনৈতিক খাতে কনফিডেন্সের অভাব মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে না নিয়ে আসার পেছনে কাজ করছে। বর্তমানে ভোগ্যপণ্যের বাজার মাত্র ৮-৯টি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে অলিগোপলি বাজার কাঠামো তৈরি হয়েছে। উচ্চ সুদের হার উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি করছে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে। আবার সম্প্রতি প্রকাশিত অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থনীতির ৪২ শতাংশ হচ্ছে ইনফরমাল বা অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি। অন্যদিকে সম্প্রতি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক নীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে যা মূল্যস্ফীতির একটি কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এনবিআর, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা প্রয়োজন।
এতে বলা হয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ১০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। যেখানে স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) ১১ দশমিক ৫ শতাংশ এবং স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) ৮ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে, যার ফলে নীতিগত সুদের হার পরিসীমা (+-)১৫০ বেসিস পয়েন্ট নির্ধারিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সুদহার বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য উচ্চ সুদহার নির্ধারণে নীতিগত নির্দেশনা দিচ্ছে, যেখানে স্প্রেড রেট প্রায় ৬ শতাংশ। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় এই স্প্রেড ধাপে ধাপে কমানো যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরিচালনার জন্য ‘ক্রলিং পেগ’ বিনিময় হার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং আন্তব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ বন্ধ রেখেছে, যাতে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি বাড়ানো যায়। তবে ব্যাংকগুলোর জন্য স্থিতিশীল বিনিময় হার বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ আন্তব্যাংক বাজারের নির্ধারিত হার অন্যান্য বাজারমূল্যের তুলনায় কম। বাংলাদেশ বর্তমানে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের জন্য ছয়টি ভিন্ন বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করছে, যা নির্দিষ্ট মুদ্রাভিত্তিক বাণিজ্যের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে বাংলাদেশ ব্যাংক সহজেই চাহিদা ও সরবরাহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে করতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বৈদেশিক সম্পদ (এনএফএ) ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে, যার প্রধান কারণ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ। চলমান বাজেটে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন টাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, যা সংশোধিত ৯৯ হাজার কোটি টাকার তুলনায় অনেক বেশি। রাজস্ব ঘাটতি প্রথমার্ধে ৫৮ হাজার কোটি টাকা হয়েছে (এনবিআর তথ্য অনুসারে)। এমতাবস্থায় স্থানীয় উৎস থেকে ঘাটতি পূরণ করাই মূল চ্যালেঞ্জ। কারণ ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ কমার প্রবণতা রয়েছে। মুদ্রানীতিতে এই বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
এ ছাড়া সব শেষ ডিসেম্বর মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার (৯ দশমিক ৮ শতাংশ) নিচে রয়েছে। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ২০২৩-২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে ৮ দশমিক ২২ শতাংশ থাকলেও, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-অক্টোবর) তা ২ দশমিক ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির প্রবণতা ২৫ দশমিক ১ শতাংশ কমে ১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা বিনিয়োগের ধীরগতির ইঙ্গিত দেয়। কর্মসংস্থান পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী কৌশল প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যা মুদ্রানীতিতে উল্লেখ নেই।