দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ পরিচালনায় এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর ফলে দ্বৈতনীতিতে চলছে প্রশাসনের কার্যক্রম। দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত থাকা কর্মকর্তারা প্রশাসনিক পদসোপান কাঠামো ভেঙে এক সপ্তাহের ব্যবধানে তিন ধাপে পদোন্নতি নিয়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, বঞ্চিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি বঞ্চিত সেজে কিছু সুবিধাভোগী, বিতর্কিত ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন। পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন, যার বিরুদ্ধে অপরাধে জড়ানোর অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা চলছে এমন কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন।
প্রায় প্রতিদিনই সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে ভিড় করছেন তদবিরকারী কর্মকর্তারা। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে প্রশাসনের ওপর এত চাপ তৈরি হয়নি। গত ১৫ বছরে ব্যাপক দলীয়করণ, সেটা উপেক্ষা করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের কারণে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সময় লাগবে। জনপ্রশাসন ক্যাডারের এই বিশৃঙ্খলায় বঞ্চিত অন্যান্য ক্যাডারের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পদোন্নতিসহ বিভিন্ন দাবিতে জোট বেঁধেছেন বিসিএস ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ৩১ আগস্ট তারা আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ নামের জোট ঘোষণা করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেন।
এক মাস ধরে গোটা প্রশাসনে চলছে সমন্বয়হীনতা, বিশৃঙ্খলা। ‘সুবিধাভোগী ও বঞ্চিত’- কর্মকর্তারা এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের মধ্যে চলছে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। সম্প্রতি দুই ধাপে ৫৯ জেলার ডিসি নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এ তালিকায় বঞ্চিতরা উপেক্ষিত হওয়ায় বাগবিতণ্ডা ও অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তারা।
এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রশাসনিক ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক আমলা ও প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। তারা এ ঘটনাকে দুঃখজনক, অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মন্তব্য করেছেন। মাঠ প্রশাসনে এর প্রভাব পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করেছেন সচিবালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, কারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল এবং কাউকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করায় এখন সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদ খালি। এসব মন্ত্রণালয়ের কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। গত বুধবার আট জেলার ডিসির নিয়োগ স্থগিত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া আরও চার জেলার ডিসি পদে রদবদল আনা হয়েছে।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডিসি নিয়োগ ইস্যুতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে যে বাগবিতণ্ডার ঘটনা ঘটেছে তা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং প্রশাসনিক শৃঙ্খলাবিরোধী। সচিবালয় হচ্ছে সরকারের প্রাণকেন্দ্র। কারণ এই সচিবালয়ে মন্ত্রী-সচিবরা বসেন। এখন সরকারের উপদেষ্টারা বসছেন। এখান থেকেই জনপ্রশাসন পরিচালিত হয়।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন হওয়া দরকার প্রশাসনের সর্বস্তরে। প্রশাসনে শৃঙ্খলা ও কাজের গতি ফিরিয়ে আনতে হলে সেটাও যোগ্যতার ভিত্তিতে হতে হবে।
সরকারি চাকরির আচরণবিধি মেনে সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে প্রশাসনের প্রত্যেক কর্মকর্তাকে। কিন্তু সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কার্যালয়ে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা রীতিমতো শঙ্কার বিষয়। কারণ প্রশাসনে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের স্থান তা সবার জানা।
কিন্তু তাদের এ ধরনের বিতর্কিত আচরণ সাধারণ মানুষকে চরমভাবে আহত করেছে। সরকার যদি এটি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশ এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে। আশা করি, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।