ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর স্বাস্থ্য প্রশাসনে এক ধরনের অচলাবস্থায় দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। এতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে দেশের স্বাস্থ্যসেবা। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে চিকিৎসা কার্যক্রম। ভাটা পড়েছে ডেঙ্গুসংক্রান্ত সামগ্রিক কার্যক্রমে। এ অবস্থার উন্নয়নে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে স্বাস্থ্যখাত মারাত্মকভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্বাস্থ্য প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বিগত সরকার সমর্থিত চিকিৎসকরা কর্মরত ছিলেন। সরকার পতনের পর নিরাপত্তাহীনতায় তারা অনেকেই কর্মস্থলে অনুপস্থিত।
দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মশানিধন কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে আছে। এখন ডেঙ্গুর মৌসুম। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম তেমন একটা চোখে পড়ছে না। এরই মধ্যে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত মঙ্গলবার দেশে ৬১৫ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যা চলতি বছরে একদিনে আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড। প্রতিদিনই এই সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত ১০৬ ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ১৮ হাজার ৫৮৯ জন। এর মধ্যে চলতি মাসে এ পর্যন্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৫ হাজার ৭৪৮, মারা গেছেন ২৩ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৬ হাজার ৮১৯ জন। দেশের পরিবর্তিত অবস্থায় অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি আত্মগোপনে থাকায় এক মাসের অধিক সময় মশানিধন কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে। মাঠপর্যায়ে অনেকে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের সব শীর্ষ জনপ্রতিনিধিকে পদ থেকে বরখাস্ত করায় এসব জায়গায় মশানিধন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো এলাকায় মশার হটস্পটের খবর তথ্যকেন্দ্রে না আসায় এক ধরনের অস্পষ্টতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এডিস মশার ঘনত্ব এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ফলে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। ধীরে ধীরে মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
চলছে বর্ষার শেষ মৌসুম। এ সময়টাতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরকে এডিস মশার বংশবিস্তারের উৎকৃষ্ট মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এ সময় মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সর্বোচ্চ অবহেলিত। গত দুই মাসে বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে নতুন করে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। হাসপাতালগুলোতে শয্যা খালি নেই। রোগী ঠাঁই নিয়েছে মেঝেতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোগীর শক সিনড্রোম দেখা দেওয়ার আগেই চিকিৎসা নিশ্চিত করা দরকার। তথ্যমতে, প্রতিদিনই গড়ে ৫০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নিচ্ছে। গত বছর দেশে ডেঙ্গু নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। রাজধানী ছাড়াও জেলাগুলোর ডেঙ্গু অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। তখন মারা যায় ১ হাজার ৭০৫ জন। হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।
ডেঙ্গু মৌসুমের শুরুতেই সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তৎপর থাকতে হবে। বিশেষ করে লিফলেট বিতরণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সমন্বয়ে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদারকি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনীয় মুহূর্তে বিশেষায়িত হাসপাতাল চালু রাখতে হবে।
হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট ও আইভি ফ্লুইড সরবরাহ করতে হবে। ডেঙ্গুর হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এটাই প্রত্যাশা।