অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেশের ১৮টি রাজনৈতিক দলের গত শনিবার তৃতীয় দফা বৈঠক হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাষ্ট্রসংস্কার নিয়ে ভাবনা এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ বিষয়ে তাদের মনোভাব ও প্রস্তাবগুলো তুলে ধরে। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ করে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন দলের নেতারা। তারা বলছেন, যত দ্রুত সংস্কারকাজ করে নির্বাচন দেওয়া হবে অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলের জন্য ততই কল্যাণকর হবে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেছেন, সংলাপের সময় অন্তর্বর্তী সরকারকে সব রাজনৈতিক দল সমর্থন জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেবে ছয় কমিশন।
বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার নির্বাচন। সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে অবিলম্বে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সংস্কার করতে এবং আগামী নির্বাচন কবে হবে, তার একটি রোডম্যাপ দেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি। এ ছাড়া প্রশাসনের ফ্যাসিবাদের দোসরদের সরানো, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, বঞ্চিতদের পদোন্নতি, আইনশৃঙ্খলা ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, গায়েবি মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি। অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা, সংস্কার কমিটির সাবেক দুজন সচিব, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালককে নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। বৈঠক শেষে জামায়াতের আমির জানান, ভোটের আগে সংস্কার, এর পর নির্বাচন। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশ শাসনের জন্য আসেনি। তারা দেশ শাসনের সুষ্ঠু পথ বিনির্মাণের জন্য এসেছে।
আমরা আশা করব, বর্তমান সরকার কোনো পক্ষ-বিপক্ষের মানসিকতা না নিয়ে দেশকে ভালো জায়গায় নিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে সক্ষম হবে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমকে নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে গণধিকার পরিষদ। এ ছাড়া হেফাজতে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ দলের পরিচয়ে বৈঠকে না ডাকায় মনোক্ষুণ্ন হয়েছেন সেসব দলের নেতা। বিতর্কিতদের দায়িত্ব কমানো এবং নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ দাবি এবি পার্টির।
সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার ঐকমত্যে আসবে, এটা আশা করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো একটি ন্যূনতম ঐকমত্যে এলে এর ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের সময়সীমা। সংস্কার কাজের মধ্যদিয়েই নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়ার কাজ চলবে। বেশকিছু রাজনৈতিক দলের নেতা সরকারের সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ততা ও নিয়মিত সংলাপের কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এখনো রোধ হয়নি। জনগণ আশাহত হলে সংস্কারের কথা শুনবে না। কোনো দলের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, পুলিশ বাহিনী অকার্যকর, দুর্বল ও নৈতিক মনোবলহারা। সশস্ত্র বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হলেও মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি।
গণ-অভ্যুত্থানের শক্তির মধ্যে বিভেদ দেখা যাচ্ছে। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয় না থাকার বিষয়টিও দৃশ্যমান। সংস্কারে গঠিত কমিশনগুলো কাজ শুরু না করায় হতাশা দেখা দিয়েছে। সব নাগরিকের চাওয়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর গণতান্ত্রিক সংস্কার শেষে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ দেবে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে টেকসই ও গ্রহণযোগ্য সংস্কার হওয়ার প্রয়োজন। বিভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের জন্য ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে হবে।
একটি নির্বাচন চাইলেই হয়ে যাবে, সে অবস্থায় এখন দেশ নেই। সর্বজন গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ও সহযোগিতা থাকতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। একটি জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও স্বচ্ছতা আনা দরকার। তা না হলে দেশ এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি থেকে দেশ বঞ্চিত হবে।
ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের চাওয়ার প্রতিফলন ঘটাতে হবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় উত্তরণের মাধ্যমে। দেশের কল্যাণে অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলো সেই যৌক্তিক সময়টুকু দেবে। জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকেও গুরুত্বের সঙ্গে সরকার বিবেচনা করবে।