অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এ রকম সময়সীমার মধ্যে একটা নতুন সরকার কতটা সাফল্য পেল, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহল থাকে। সরকার নিজেও কতটা সফলতা অর্জন করেছে, জন-আকাঙ্ক্ষা কতটা পূরণ করা গেছে, উপলব্ধি করাটা জরুরি হয়ে পড়ে। এই উপলব্ধির প্রয়োজন হয় মূলত ভবিষ্যতের করণীয় আরও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনার জন্য।
গত ১০ নভেম্বর সরকারের প্রেস সচিব সাংবাদিকদের কাছে যে বিবরণ দেন তাতে দেখা যাচ্ছে, এই ৯০ দিনে সরকার অন্তত পাঁচটি ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছে। প্রথমত, যে পরিবর্তন ঘটেছে, সেটা হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে। দ্বিতীয়ত, ভঙ্গুর অবস্থা থেকে অর্থনীতিকে সরকার উদ্ধার করছে। তৃতীয়ত, ব্যাপকভাবে বৈশ্বিক সহায়তা পাওয়া গেছে। চতুর্থত, সংস্কারের পথে অগ্রগতি ঘটেছে। পঞ্চমত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কলকারখানার অস্থিরতা দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে।
একটু বিস্তৃতভাবে বললে, প্রথম সাফল্যটি ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে যে সংকট ছিল, সেই সংকট পুরোপুরি দূর না হলেও স্থিতিশীলতা এসেছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়েছে। বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতিও আশাব্যঞ্জক।
দেশের মানুষের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার কী ধরনের সংস্কার করে তা নিয়ে। এই দিকটিতেও সরকারের সাফল্য এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্যই বলা যায়। ১০টি সংস্কার কমিশন সরকার গঠন করেছে।
এই মুহূর্তে সব সংস্কার কমিশন কমবেশি সংস্কারের কাজে ব্যস্ত রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সংস্কারের অগ্রগতি জানার জন্য ছয়টি কমিশনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক করেছেন। সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুসারে ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কার কমিশনগুলোর খসড়া রূপরেখা জনসাধারণসহ অংশীজনের কাছে তুলে ধরা হবে বলে আমরা আশা করছি। প্রেস সচিব জানিয়েছেন, সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করবে সরকার। সংস্কারের পথে সরকারের বর্তমান অগ্রযাত্রা অক্ষুণ্ন থাকবে বলে আমরা আশা করছি।
একটা বিষয় আমরা লক্ষ করেছি, প্রথমে যা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুললেও বর্তমানে অনেকখানি স্থিতিশীলতা এসেছে। সরকারের প্রথম দিনগুলোতে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করছিল। এতে জনজীবনে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাতে দেখা দিয়েছিল অস্থিরতা। এখন এই বিষয়টি অনেকটাই স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। যদিও শিল্পাঞ্চলগুলোর অস্থিরতা পুরোপুরি দূর হয়নি। বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ চলছেই। সরকার এই সংকট সমাধানের জন্য কার্যকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা করছি।
সাফল্য দৃশ্যমান হয়েছে জনপ্রশাসন ক্ষেত্রেও। তবে প্রশাসনকে আরও গতিশীল করা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়েছে। পুলিশকে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। এই তিন মাসের একেবারে শুরুতে, অর্থাৎ আগস্ট মাসে যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল, সাধারণ মানুষ ও ছাত্রছাত্রীদের সহায়তায় সেই বন্যা বেশ ভালোভাবেই মোকাবিলা করতে পেরেছে সরকার।
মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্যও সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আমদানি খাদ্যপণ্যের শুল্ক হ্রাস, বাজার তদারকি, কম মূল্যে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করেছে। মুদ্রাস্ফীতি ঊর্ধ্বগতি খুব দ্রুত না হলেও কমে আসবে বলে সরকার আশা করছে।
সব মিলিয়ে প্রথম তিন মাসে সরকারের অর্জন আশানুরূপই বলা যায়। তবে এখানেই তারা থেমে থাকতে চাইছে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কতটা অগ্রগতি হয়েছে, না হলে কেন হয়নি, মন্ত্রণালয়গুলোর কাছ থেকে সেসব জানার উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি আমাদের আশাপ্রদ করে তুলছে। জনকল্যাণ সাধনের বিষয়টি যে চলমান একটি প্রক্রিয়া, প্রতি মুহূর্তে একটা অবস্থা থেকে আরও উন্নত স্তরে যাওয়ার চেষ্টা, বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য সেটা খুবই জরুরি। সরকারও সেই চেষ্টাটা করে যাচ্ছে। সাংবাদিকদের কাছে প্রেস সচিব নিজেও সে কথা বলেছেন। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারের এই প্রয়াসকেই আমরা সাধুবাদ জানাই। আমাদের অপেক্ষা সেই নতুন সূর্যোদয়ের, যে সূর্যোদয় অন্ধকার দূর করে আমাদের আলোর পথে নিয়ে যাবে।