আলোকিত মানুষ গড়ার স্বপ্ন ও প্রত্যয়ে গড়া হয়েছিল ব্যতিক্রমী এই প্রতিষ্ঠান। নাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে ৪৫ বছর পূর্তি হলো সেই প্রতিষ্ঠানের। আলোকিত মানুষের অবদানে দেশ, সমাজ ঋদ্ধ হবে, এই স্বপ্ন যিনি দেখেছিলেন তার নাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
অধ্যাপনা ছেড়ে তিনি দুর্গম কাঁটাবিছানো পথ পাড়ি দিয়ে চলেছেন। আজ শুক্রবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৪৫ বর্ষপূর্তির উদযাপন অনুষ্ঠান। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চত্বরে চলবে আনন্দ সম্মিলন। এই উপলক্ষে গত বুধবার সন্ধ্যায় জ্ঞানব্রতী আচার্য আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের কপি এডিটর হাসান হাফিজ। সঙ্গে ছিলেন আহমদ সিফাত। ওই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
খবরের কাগজ: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৪৫ বর্ষপূর্তিতে অভিনন্দন। নিজের গড়া প্রতিষ্ঠানকে এত বড় একটা পর্যায়ে এত সম্প্রসারিত এবং একটা উৎকর্ষের প্রতিষ্ঠান হিসেবে আপনি দেখতে পেলেন। অনেক ত্যাগও স্বীকার করেছেন এই প্রতিষ্ঠানের জন্য। প্রত্যাশা কতটা পূরণ হলো? এই মুহূর্তে আপনার অনুভূতিটা কী হচ্ছে?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: কী হয়েছে, এটা নিয়ে আমার কোনো দিন মাথাব্যথা ছিল না, আজও নেই। কথা হচ্ছে যে, আনন্দে কাজ করেছি। একটা স্বপ্ন ছিল, দেশের অজ্ঞতার যে দুঃখ, সেটা আমাকে কষ্ট দিত এবং মনে হয়েছে যে আমার যেটুকু সাধ্য, সেটা আনন্দের সঙ্গে করে দিই। সেটা না করলে হয়তো আরও খারাপ কাজ করতে হতো।
স্যাক্রিফাইস যা করেছি, তার চাইতে পেয়েছি বেশি। যে আনন্দটা পেয়েছি, এটা ঠিক ওই ধরনের স্যাক্রিফাইস দিয়ে হয় না। এতেই আমি খুশি। এরপরে কী হবে না হবে, সেটা পরের প্রজন্ম দেখবে। প্রত্যাশা পূরণ হওয়া তো একটা বিরাট ব্যাপার। আমরা ছোট পিঁপড়ের মতো মানুষ। তার আবার স্বপ্ন পূরণই বা কী, তার আবার অপূরণই কী। আমি যেটাকে গুরুত্ব দেই, সেটা হচ্ছে আনন্দে ছিলাম কিনা? অনেক দুঃখে থাকতে পারতাম। অনেক খারাপ থাকতে পারতাম। অনেক ক্লেদাক্ত পরিবেশে ক্লেদাক্ত জীবনে থাকতে পারতাম। সেটা থেকে বেঁচে গিয়েছি। আমি তারুণ্যের সঙ্গে থেকেছি। জীবন কাটিয়েছি। উৎসব করেছি। তাদের সঙ্গে লেখাপড়াসহ জীবনের বহু কিছুতে অংশ নিয়েছি। এর চাইতে ভালো জীবন আর কী হতে পারে?
খবরের কাগজ: তারুণ্যের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা অনুভূতিটা একটু যদি বলেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: অনেকে তরুণদের পছন্দ করে না। কিছু লোক আছে, যারা তরুণদের দেখলে আস্তে করে অন্য দিকে সরে যান। তাহলে তরুণরা তাকে আস্থায় নেবে কেন? তাকে ভালোবাসবে কেন? তাকে বন্ধু মনে করবে কেন? তরুণদের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এমনিতেই আমরা যেহেতু কিছুটা বে-তরুণ।
খবরের কাগজ: নতুন প্রজন্মের কাছে আপনার কী আশা?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আশা করি আর না করি, যা হওয়ার সেটাই তো হবে। দেখা যাক কী হয়। আমরা কাজ করতে পারি শুধু। একটা কোনো কিছুর জন্য আমরা উৎসাহের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে, স্বপ্ন নিয়ে সৌন্দর্যবোধ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি। কী হবে, সেটা তো আমরা কেউ বলতে পারি না। আমি ক্লাসে প্রায়ই ছেলেমেয়েদের বলি যে, বর্তমান বলে কিছু নেই। এটা এক সেকেন্ডের হয়তো এক কোটি ভাগের এক ভাগ। ভবিষ্যৎ আসেনি। আমরা কিছুই জানি না। আমি সে জন্য দেখেছি, ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যত কথা লোকে বলে, তার ৯৫ ভাগই ভুয়া। যে যা মনে করে, সে তা বলে দেয়।
একটাই সত্যি, সেটা হচ্ছে যা ঘটে গেছে। অতীত। অতীতকে মূল্যায়ন করে সামনে এগিয়ে যাওয়া হতেও পারে, নাও হতে পারে। অতীতকে কে কীভাবে নেবে। অতীতে কেউ যদি প্রচণ্ডভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাহলে সে একভাবে নেবে, আবার যার অতীত খুব সুখের ছিল, আনন্দের ছিল, আশাবাদিতায় ভরা ছিল, বড় কিছুর স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ ছিল, সে আবার আরেকভাবে নেবে। প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা, প্রতিটি গোলাপ আলাদা।
খবরের কাগজ: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সম্প্রসারণ নিয়ে নতুন কী পরিকল্পনা? এটা কী রোলমডেল হতে পারে বিশ্বে?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: এই যে ১৮ কোটি লোক আমাদের মতো ছোট একটা দেশে, সেখানে একটা ছোট প্রতিষ্ঠান কতটুকুই বা তাদের জন্য কাজে আসতে পারে? কতটুকু উপকারে লাগতে পারে। এটার উত্তর আমার জানা নেই। আমি আমার সাধ্যের মধ্যে যা পারি করি, যা কিছুই হোক। আমরা কেউই থাকব না। অনেকের মনের মধ্যে হয়তো চাপা আশা অনেক সময় কাজ করে। রবীন্দ্রনাথও মৃত্যুর আগে বলেছেন, হে উদাসীন পৃথিবী আমাকে সম্পূর্ণ ভুলবার আগে তুমি ভুলে যাবে, তুমি পৃথিবীর কত বিশ্ব চরাচরের, কত বিশাল বিশাল কিছুকে ভুলে গেছো, আমার মতো একটা তুচ্ছ মানুষকে মনে রাখবে, এই আশা করতে পারি না। কিন্তু আমাকে সম্পূর্ণ ভুলবার আগে তোমার নির্মম পদপ্রান্তে রেখে যাই আমার প্রণতি।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাইছি।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: শিক্ষাব্যবস্থাটা এ দেশে এতদিন খুব খুঁড়িয়ে চলেছে। আমাদের যোগ্যতা যে পরিমাণ হবে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সে মাপেরই হবে। আমরা সে জায়গাতে সবসময় খুব যোগ্যতা দেখাতে পেরেছি, এই কথা আমি বলব না। তাহলে আমরা আরও অনেক ভালো শিক্ষাব্যবস্থা পেতাম। তবে আমরা বিশ্বাস করি, কখনো না কখনো অত্যন্ত যোগ্য, অত্যন্ত বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন গভীর মানুষদের পাব। কারণ এত বড় একটা জাতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করাটা অত্যন্ত কঠিন একটা ব্যাপার। বহু দেশ আছে, বহু জাতি আছে, যেটা আমাদের মিরপুরের চাইতেও ছোট। তো সেই ক্ষেত্রে এত বড় একটা জাতিকে সোনার পাত্রে পরিণত করে বড় একটা কিছু উপহার দেওয়া, এর জন্য যে মানুষ দরকার, সে মানুষ হয়তো এখনো আমরা ওইভাবে পাইনি।
আমাদের অতীতও তো দুঃখজনক। দীর্ঘকাল আমরা পরাধীন ছিলাম। দীর্ঘকাল শিক্ষা থেকে দূরে ছিলাম। অসংখ্য মানুষের কোনো বোধই নেই। শিক্ষার বিষয়ে তো আমরা একটু পিছিয়ে পড়েছি মাঝখানে। তবে আশা করি, ৫০ বছরের মধ্যে বা ১০০ বছরের মধ্যে আমরা একটা জায়গাতে পৌঁছাব।
খবরের কাগজ: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে কতটা অর্জন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? কোনো ফল কী দেখতে পাচ্ছেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কিছু ফল দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে তৈরি হচ্ছে, ভালো করছে। যেখানেই যাই, সেখানেই দেখি। আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করে, কিছু ফল যে হচ্ছে, আপনি টের পাচ্ছেন কী করে? আমি সব সময় বলি, ওদের গলার আওয়াজ থেকে আমি টের পাই। যদি দেখি যে তার গলার স্বর সুপরিশীলিত রুচিশীল স্নিগ্ধ এবং তার মধ্যে জীবনের পিপাসা অন্বেষণ রয়েছে, তখন আমি বুঝতে পারি, সে বড় কিছুর দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে।
খবরের কাগজ: নতুন প্রজন্মের প্রতি আপনার পরামর্শ কী থাকবে? আপনি একসময় নিজেকে বলেছিলেন ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: পরামর্শ কেউ কাউকে দেয় না। কেউ কাউকে দিতে পারে না। নিজের পরামর্শ নিজেকেই দিতে হয়। সেই পরামর্শ যে নিজেকে ঠিকমতো দিতে পারে, সে জীবনে অন্যের অনেক উপকারে আসতে পারে। আর যে দিতে পারে না, সে কারও উপকারেও আসতে পারে না।
আমি শিক্ষকতায় গিয়েছিলাম অনেক স্বপ্ন নিয়ে, ভেবেছিলাম শিক্ষার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে, আগামী প্রজন্মকে অর্থপূর্ণ কিছু উপহার দেব। কিন্তু সেটা হয়নি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সেটা আমি করতে পারিনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা ছক কাটা, গৎবাঁধা, গতানুগতিকতাদুষ্ট। বলা চলে প্রায় গ্রাম্য। শেষ পর্যন্ত আমি সেই শিক্ষকতা থেকে চলে আসি। বুঝলাম যে, এইটা আমার জায়গা নয়। আমি আরও কিছু চাই। নিষ্ফলা মাঠের কৃষক, ও আমার একটা বইয়ের কথা তুমি বলছো। কৃষক নিষ্ফলা নয় মাঠটা নিষ্ফল। কৃষক সেখানে নিষ্ফলা হয়ে গেছে।
শিক্ষকদের বেতন পাঁচ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হোক। দেখবে সমস্ত তরুণরা শিক্ষকতা পেশায় আসবে। কিন্তু শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি দিয়েই যদি শিক্ষকের মাপকাঠি করি, তাহলে যে শিক্ষক আমরা পাব, সে শিক্ষক তো একটা অর্থলোভী, অর্থপিশাচ। তাকে দিয়ে কী হবে? শিক্ষকতার মধ্যে একটা আদর্শের জায়গা আছে, আত্মোৎসর্গের একটা জায়গা আছে। চরিত্রের একটা জায়গা আছে, মিশনারি একটা জায়গা আছে। সেটা যদি একজনের মধ্যে না থাকে, তাহলে তো সে শিক্ষক হতে পারে না। বেতন ২ কোটি টাকা করে দিলেও তার উন্নতি হবে না।
এটার কারণ, আজকের পৃথিবী অর্থের পেছনে ছুটছে। উন্মাদের মতো ছুটছে। কোনো চিন্তা যুক্তিবুদ্ধি বাছবিচার এগুলো কিছু নেই। আমরা গত ৫০০ বছর ধরে রেনেসাঁ, শিল্প বিপ্লব অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে অনেক উঁচুতে উঠেছি। এখন আবার সেখান থেকে আমাদের পতন ঘটে যাচ্ছে। গত ১৬ বছর ধরে ডেমোক্রেসি ক্রমাগতভাবে নামছে এবং সেটা সারা পৃথিবীতেই।
৫০০ বছর ধরে আমাদের এই পৃথিবী ওপরের দিকে উঠেছে, এখন কিছুকালের জন্য নেমে যাবে হয়তো এবং এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। এর সঙ্গে কী করে যুদ্ধ চালিয়ে আবার আমরা সেই উন্নত জায়গায় চলে যেতে পারব, তার জন্য আমাদের যুদ্ধ-সংগ্রাম করতে হবে।