বাংলাদেশের বিমা খাতের সম্ভাবনা অনেক। তবে সমস্যাও কম নয়। যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হলে খাতটি এ দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখতে সক্ষম হবে। বিমা খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছে আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান আলমগীর শামসুল আলামিনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডেপুটি বিজনেস এডিটর ফারজানা লাবনী।
খবরের কাগজ: আমাদের দেশে বিমা করার হার খুবই কম। আরও বেশিসংখ্যক জনগণকে বিমার আওতায় আনতে হলে সরকারের কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
আলমগীর শামসুল আলামিন: বিমার আওতা বাড়াতে বিমার গ্রহণ যোগ্যতা বাড়াতে হবে। বিমার সুবিধা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা আনতে হবে। আস্থা আনতে হবে। পাশাপাশি বিমাসেবা ডিজিটালাইজেশন করা, ভ্যালু অ্যাডেড সেবা প্রদান, ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলের সম্প্রসারণ ও বিমা খাতের সুশাসন নিশ্চিতে আরও গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে যৌথভাবে পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশে বিমা ব্যবসা বিকাশে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো কী? এ থেকে উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী?
আলমগীর শামসুল আলামিন: দেশে জীবন বিমার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মানুষের আস্থাহীনতা। সাধারণ বিমার ক্ষেত্রেও আমি একই কথা বলব। এর বাইরে দাবি নিষ্পত্তিতে কোম্পানিগুলোর প্রক্রিয়াগত জটিলতা, গ্রাহকদের দীর্ঘ মেয়াদে আর্থিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে অনীহা ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব এবং বিমা কোম্পানির এজেন্ট বা প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সন্তোষজনক সেবা না পাওয়াও বিমা খাতের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা।
খবরের কাগজ: বিমা সম্পর্কে দেশের জনগণের আস্থার সংকটের কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
আলমগীর শামসুল আলামিন: কিছু কোম্পানির কাছ থেকে অনেকে সময় মতো বিমার সুবিধা পায় না। এসব কথা একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিমার সুবিধা সময়মতো পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে অনেকের মনেই বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন দেখা দেয়। বিমার প্রতি সাধারণ মানুষের অনেকেরই আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্যজনিত জরুরি অবস্থায় বিমার অর্থ ঠিকভাবে পাবে কি না তা নিয়ে গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন। তা ছাড়া সন্তানদের শিক্ষা, অবসর-পরবর্তী অর্থায়ন, সম্পদ ক্রয়, ভ্রমণ ও অবসর কাটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিয়েও উদ্বেগে থাকেন সাধারণ মানুষ।
খবরের কাগজ: বর্তমানে জীবন এবং সাধারণ মিলে প্রায় ৮১টি বিমা কোম্পানি রয়েছে। আপনি কি মনে করেন আরও নতুন কোম্পানি আসা উচিত।
আলমগীর শামসুল আলামিন: ১৬ থেকে ১৭ কোটি মানুষ এদেশে। আরও নতুন কোম্পানি আসলে সমস্যা হবে কেন? তবে বিমা খাতে যে প্রতিষ্ঠানই আসুক না কেন অবশ্যই তাদের কাজের গুণগতমান বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বর্তমানে যে সব কোম্পানি আছে তাদের কাজের পদ্ধতি আধুনিকতা ও সময়োপযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
খবরের কাগজ: বিমা খাতে প্রায়ই অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা শোনা যায়। বিমা খাতকে ডিজিটালাইজেশন অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় আনা সম্ভব হলে অনিয়ম-দুর্নীতি কি কমবে?
আলমগীর শামসুল আলামিন: ডিজিটালাইজেশনের আওতায় সম্পূর্ণ বিমা খাত আনা প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে অর্থাৎ ডিজিটালাইজেশন বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় আনা সম্ভব হলে অবশ্যই অনিয়ম-দুর্নীতি কমবে। এ বিষয়ে কাজ চলছে বলে জেনেছি। তবে আইডিআরএ, সাধারণ বিমা করপোরেশন, জীবন বিমা করপোরেশন এবং বিমা একাডেমিকে আনলেই হবে না বেসরকারি খাতকেও গুরুত্ব দিয়ে আধুনিকভাবে সাজাতে হবে, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে।
খবরের কাগজ: প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অন্য সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিমা শিল্পের অবস্থান কোথায়?
আলমগীর শামসুল আলামিন: জিডিপিতে বাংলাদেশের বিমার অবদান শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে থাইল্যান্ডে এ হার সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ, মালয়েশিয়া ও ভারতে যথাক্রমে ৫ ও ৪ শতাংশ।
খবরের কাগজ: বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বিমা খাতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি আছে। আপনি কী মনে করেন?
আলমগীর শামসুল আলামিন: এদেশে বিমা খাতে দক্ষ জনবলের ঘাটতি আছে। যারা এ খাতে যুক্ত আছেন তাদের অনেকে দক্ষ। তবে বেশির ভাগেরই দক্ষতা আরও বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। উন্নত দেশে বিমা খাতের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। উন্নত দেশের আদলে আমাদেশেও বিমা খাত ঢেলে সাজানো যেতে পারে। এতে বিমা খাতে গতি আসবে। বিমা খাতে কর্মরতদের উন্নত দেশের আদলে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
খবরের কাগজ: আওতা বাড়াতে অনেকে আমাদের দেশে সব খাতেই বিমা বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল): সবকিছু বাধ্যতামূলক বিমার আওতায় আনতে হবে। শুধু বিমার আওতায় আনলেই হবে না, একই সঙ্গে কঠোরভাবে নজরদারিও করতে হবে। আমাদের দেশে কি যথাযথভাবে নজরদারি হয়? সরকারি সম্পত্তির কথাই ধরেন আর গণপরিবহনের কথা বলেন, বিমা করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা হচ্ছে কি? অনেকেই তা করেন না। চাপিয়ে দিয়ে কোনো কাজ ভালো হয় না, আবার চাপিয়ে না দিলেও হয় না। যেমন অনেক মানুষ কর দিতে চান না। কিন্তু চাপানো আছে বলেই অনেকে কর দিতে বাধ্য হন।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশে বিমা খাতের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল): এ খাতের সম্ভাবনা, খুবই উজ্জ্বল। সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা ফেরাতে হবে। আধুনিকায়ন করতে হবে। সব কিছু ঠিকভাবে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হলে অর্থনীতিতে অবদানের দিক থেকে আর্থিক খাতের মধ্যে বিমা খাত একসময় ব্যাংক আর পুঁজিবাজারকেও ছাপিয়ে যাবে। এ পরিস্থিতি আনতে হলে সরকারের এ বিষয় আরও কিছু কাজ করার আছে।
খবরের কাগজ: বিমা দিবসের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু বলুন।
আলমগীর শামসুল আলামিন: জাতীয় বিমা দিবস ১ মার্চ। বীমা শিল্পের উন্নয়ন ও বিমা সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার এটি প্রবর্তন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬০ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগ দেন। তার এ যোগদানের দিনটিকে জাতীয় পর্যায়ে স্মরণীয় রাখতে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সুপারিশক্রমে প্রতিবছর ১ মার্চকে জাতীয় বিমা দিবস ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। ওই বছরের ১ মার্চ এটি প্রথম দিবস হিসেবে পালিত হয়। প্রতিবছর বাংলাদেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিমাশিল্পের উন্নয়ন, বিমা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে শোভাযাত্র, বিমা মেলা, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি পালিত হয়।