৬ বছর ধরে দেশের বাইরে অনেকটা নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। প্রধান বিচারপতি থেকে পদত্যাগসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি বই লিখেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আছেন তিনি। তবে খুব একটা নিয়মিত নন। সরকারের পালাবদলে গত ৫ আগস্ট থেকে তিনি ফেসবুকে সক্রিয়। শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে খবরের কাগজ তার সঙ্গে কথা বলেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিলেট ব্যুরো প্রধান উজ্জ্বল মেহেদী
খবরের কাগজ: কেমন আছেন?
এস কে সিনহা : ভালো। মিথ্যার মধ্য থেকে সত্যের বিস্ফোরণ হলে যে আনন্দ, সে রকম এক আনন্দ নিয়ে আছি।
খবরের কাগজ: এখন কি বাংলাদেশে আসবেন?
এস কে সিনহা: রিসেন্টলি আমি এ ব্যাপারটি নিয়ে ফেসবুকে লিখেছি। বাংলাদেশে আসার ঘটনাটি যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে। বাংলাদেশে আমার ফেরাটা হবে আরেক রেভ্যুলুশন।
খবরের কাগজ: ফেসবুকে কী লিখেছেন?
এস কে সিনহা: ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট তিনটি লেখা আমার ফেসবুকে দিয়েছি। প্রথম লেখায় দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে প্রধান উপদেষ্টার পদমর্যাদায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়েছি। পরিবর্তনে সঠিক ব্যক্তি নির্বাচন করার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতিও অভিনন্দন জানিয়েছি। আমি মনে করি, প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার করা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাই দ্বিতীয় অগ্রাধিকার। তৃতীয় অগ্রাধিকার আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন ও হাসিনা সমর্থকদের হাত থেকে অবৈধ কোটি কোটি টাকা উদ্ধার করা। পরবর্তী অগ্রাধিকার উচ্চ বিচারব্যবস্থার সম্পূর্ণ সংস্কার।
মনে রাখবেন, ‘কীভাবে পাকিস্তানের গণতন্ত্র পাকিস্তানের উচ্চ আদালত দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল, সাবেক সিজে মহম্মদ মুনির নেতৃত্বে। বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে, কারা দায়ী তা-ও লিখেছি। পাকিস্তানিরা সিজেকে দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে এবং নিম্ন বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের মারধর করেছে। একই সঙ্গে আমাদের উচিত বর্তমানে কর্মরত সেরা বিচারক যেমন সৈয়দ রেফাত হোসেন, জুবায়ের রহমান, ফারহা মাহবুব এবং আরও কয়েকজনকে সর্বোচ্চ আদালতে তুলে নেওয়া এবং অবিলম্বে উচ্চ আদালত বিভাগে মেধাবী তরুণ আইনজীবী নিয়োগ করা।’
দ্বিতীয় লেখায় লিখেছি, ‘যে সব শুভাকাঙ্ক্ষী ইতিবাচক মতামত দিয়েছেন ও মন্তব্য করেছেন এবং আমাকে বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুরোধ করেছেন, তাদের আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর আমি স্বৈরাচারী হাসিনার শাসনামলে নির্বাসিত প্রধান বিচারপতি হিসেবে যাওয়ার আগে আমার বাসভবনের সামনে জমায়েত হওয়া সাংবাদিকদের প্রতি সাহসী বিবৃতি দিয়েছিলাম, শিগগিরই আমি আসব। এই বিবৃতি হাসিনার সরকারকে ভীত করে এবং তিনি মো. আব্দুল ওহাব মিয়ার সঙ্গে মিল রেখে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ভুয়া তথ্য প্রকাশ করেন। তবে আমি সব সময় আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে, আমি দেশে ফিরব। কারণ আমি জানতাম পেশাদার জীবনে আমি কোনো ভুল করিনি। যেকোনো সময় শেখ হাসিনার পতন আশা করছিলাম, তাতে আমার নিরাপদ প্রত্যাবর্তন হবে। এখন আমি অত্যন্ত উত্তেজিত সেই মুহূর্তটার জন্য, যখন আমি বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখতে পারব, যা যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে।’
আর প্রথম লেখায় আন্দোলনকারীদের অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছি, কোটাব্যবস্থা ও স্বৈরাচারী হাসিনার বিরুদ্ধে লড়াই করা আমার প্রিয় ছাত্র প্রতিবাদীদের অভিনন্দন। এটা আমাকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে সংঘটিত অসহযোগ আন্দোলনের পুনরুজ্জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাহায্য বা সমর্থন ছাড়াই তারা এটি অর্জন করেছেন। এখন, দেশের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমার পরামর্শ হলো প্রশাসন থেকে অটোক্র্যাট সরকারের নিয়োগ করা ব্যক্তিদের অবশিষ্টাংশ মুছে ফেলা। আর বিচারব্যবস্থা স্বাধীন হলে নির্বাহী সরকার মানুষকে দমন করতে পারবে না, যে অধিকারের জন্য আমি লড়েছি স্বৈরাচারী হাসিনার বিরুদ্ধে।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশের পালাবদলের সময় নিয়ে কিছু বলুন।
এস কে সিনহা: কী দুঃসহ অবস্থা! কেউ তো ছিল না হাল ধরার। প্রফেসর ইউনূস সাহস করে হাল ধরেছেন। আমি মনে করি, এ জন্য কেবল বাংলাদেশ নয়, বাংলাদেশের প্রতি গোটা পৃথিবীর যেসব মানবতাবাদী চোখ রয়েছেন, সবাই তার প্রতি কৃতজ্ঞ, অল রেসপেক্টস টু প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে বাংলাদেশ দুই-তিন দিন সরকার-প্রশাসন ছাড়া চলেছে। ক্যান্টনমেন্ট অরক্ষিত ছিল। সরকারবিহীন থাকায় হযবরল অবস্থা হয়েছে। এই অবস্থা কেন হলো, তা-ও দেখা দরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা দেখবে। তবে তাদের আগে আস্থায় আসতে হবে। ডেমোক্রেসির পথে হাঁটতে হবে।
খবরের কাগজ: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও পরিবর্তিত পরিস্থিতি কীভাবে দেখছেন?
এস কে সিনহা: এটা রেভ্যুলুশন। এই রেভ্যুলুশনটা প্রত্যাশিত ছিল। আমি একটু চিন্তার মধ্যে আছি, রেভ্যুলুশন পরবর্তী সরকারবিহীন অবস্থা নিয়ে। এটা কি পরিকল্পিত ছিল? সরকার ছাড়া এক কথায় বলতে গেলে হযবরল অবস্থায় কেটেছে। দুই দিন থেকে তিন দিন, দেশ সরকারবিহীন! ভাবা যায় না। ক্যান্টনমেন্ট থেকে থানা-সব অরক্ষিত ছিল। রেভ্যুলুশনের পর হযবরল অবস্থা থেকে অন্য কিছুও ঘটার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেশ কিন্তু জ্বলছে।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কেমন হলো?
এস কে সিনহা: ওয়েল অ্যান্ড গুড। উপদেষ্টারাও ভালো। তবে তাদের ইন্টারিম গভর্নমেন্টের বাইরে যাওয়া যাবে না। জনগণের আস্থায় আসতে হবে, এজেন্ডা পরিষ্কার করতে হবে। পজিশনও পরিষ্কার করতে হবে। কথা ও কাজে সমন্বয় রেখে নানা পন্থায় এগোতে হবে। দেশকে খুব দ্রুত নরমাল করতে হবে। সরকারপ্রধানের দিকনির্দেশনা বাস্তবায়ন দরকার।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু বলুন।
এস কে সিনহা: একজন নরমাল পাবলিক হিসেবে আমি বলব, যত দ্রুত সম্ভব ইয়ং ছেলেদের ঘরে ফেরাতে হবে। জনগণের কথা বলতে হলে জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হবে। এ বিষয়টি ইন্টারিম গভর্নমেন্টকে মনে রাখতে হবে। পলিটিক্যাল ইন্টারেস্ট সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। আরেকটা কথা, ইন্টারচেঞ্জ বিষয়েও পজিশন পরিষ্কার করতে হবে।
খবরের কাগজ: ইন্টারচেঞ্জ বিষয়টি কী?
এস কে সিনহা: ডেমোক্রেসিতে অনেক ইস্যু আছে। ইন্টারচেঞ্জের মাধ্যমে এসব জানতে হবে। ইকোনমি ও ল-অ্যান্ড অর্ডারের দিকে নজর রাখতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে। পৃথিবীর রেভ্যুলুশন ও পরবর্তী অবস্থা নিয়ে রিসার্চ করতে হবে। ইয়ংদের দিয়ে এ কাজটি করা যায়। ফ্রান্সসহ পৃথিবীর বড় বড় রেভ্যুলুশন ও পরবর্তী অবস্থা পর্যালোচনায় রাখতে হবে। তবে কোনোভাবে ইন্টারিম গভর্নমেন্ট স্টেপের বাইরে যাওয়া যাবে না। এখন কোনো কিছুই পারমানেন্ট না। সব বিষয় কিন্তু সিরিয়াস ম্যাটার হিসেবে দেখতে হবে।
খবরের কাগজ: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
এস কে সিনহা: ওকে থ্যাঙ্কস, সি ইউ ইন বাংলাদেশ!
> সাক্ষাৎকারে এস কে সিনহা: হাসিনাকে ২০১৭ সালেই পদচ্যুত করা যেত [শেষ পর্ব]