ঢাকা ৫ মাঘ ১৪৩১, রোববার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

সাক্ষাৎকারে এম জামাল উদ্দিন প্রত্যেক গ্রাহকের যত্ন নিই

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৫ এএম
আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৭ এএম
প্রত্যেক গ্রাহকের যত্ন নিই

আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ৪০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সাফল্য অর্জন করে আসছে। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে লোকসান করেনি। এর মূল কারণ করপোরেট সুশাসন। এ ছাড়া গ্রাহক বাছাই করার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম নীতি। আইডিএলসির বর্তমান পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আর্থিক খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এম জামাল উদ্দিনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এম মনিরুল আলম

খবরের কাগজ: আইডিএলসির সবচেয়ে ভালো দিকটি তুলে ধরুন। 

এম জামাল উদ্দিন: প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই করপোরেট সুশাসন আমাদের একটি বেস্ট প্র্যাকটিস। তখন প্রমোটর ও শেয়ারহোল্ডার ছিল বিশ্বব্যাংকের আইএফসি (ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন) এবং একটি কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান। শেয়ারহোল্ডার পরিচালকরা তাদের আন্তর্জাতিক মানের অভিজ্ঞতা এই প্রতিষ্ঠান গড়তে কাজে লাগিয়েছেন। ফলে সব সময় একটি টেকসই প্রবৃদ্ধি ও প্রত্যাশিত মুনাফা করতে পেরেছে। প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠা করা হয় আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা। পরিচালনা পর্ষদের কেউ আর্থিক ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করেননি। আমি তো শুরু থেকেই এই প্রতিষ্ঠানে আছি। ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি থেকে আজ আমি এ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে। এখনো আমি প্রথমদিনের মতো নিজেকে এ প্রতিষ্ঠানের কর্মী মনে করি। আমি এও বলতে পারি, কোনো পরিচালক বা পর্ষদের কেউ কোনো দিন বলেননি ‘ওর ঋণ আবেদনটা দেখো বা আমি একটা লোক পাঠালাম চাকরিটা দিও’।

খবরের কাগজ: আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজনেস মডেল সম্পর্কে বলবেন কি?

এম জামাল উদ্দিন: আইডিএলসি শুরু থেকেই করপোরেট ফোকাসড-২০০৬ সালে এসএমই খাতের দিকে নজর দেওয়া হয়। কোনো গ্রাহক আমাদের কাছে এলে দ্রুত অ্যাসেসমেন্ট প্রসেস সম্পন্ন করা হয়। ঋণ পাওয়ার উপযোগী হলে গ্রাহককে তা জানিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া হয়। আর অ্যাসেসমেন্ট প্রসেসে কোনো সূচকে গ্রাহক কোয়ালিফাই না করলে সেটাও তাকে দ্রুত জানানো হয়। আমরা গ্রাহকের সময় নষ্ট করি না। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমরা গ্রাহকের যত্ন নিই, পরামর্শ দিই ও নিয়মিত তদারকি করি।

খবরের কাগজ: ঋণ আবেদনকারীর অ্যাসেসমন্ট করতে কোন সূচককে আপনার প্রতিষ্ঠান বেশি গুরুত্ব দেয়?

এম জামাল উদ্দিন: অন্য সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের মতো আমরাও ঋণ আবেদনকারীর ব্যবসার সম্ভাবনা দেখি, ঋণ ফেরত দেওয়ার আগ্রহ ও সক্ষমতা যাচাই করি। সবচেয়ে বেশি যেটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, তা হলো তার ব্যবসা বা উদ্যোগের পরবর্তী নেতৃত্ব বা উত্তরাধিকারী দেখি। 

খবরের কাগজ: তৃণমূলের গ্রাহকদের জন্য আপনাদের কোনো সৃজনশীল সেবা আছে কি? 

এম জামাল উদ্দিন: আমরা সব সময়ই সেবার ক্ষেত্রে সৃজনশীল ধারণায় বিশ্বাস করি। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বিকাশের সঙ্গে আমরাই প্রথম সঞ্চয় স্কিম চালু করি, যাতে তৃণমূল থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। এরপর অন্যরাও এই সেবা নিয়ে এসেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা পাইওনিয়ার বা পথিকৃৎ। 

খবরের কাগজ: আর্থিক সেবা পেতে এসএমই উদ্যোক্তারা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে থাকে? 

এম জামাল উদ্দিন: এসএমই উদ্যোক্তাদের বড় অংশই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এদের যথাযথ জামানত দেওয়ার সক্ষমতা থাকে না, ট্রেড লাইসেন্স ও লেনদেনের রেকর্ড থাকে না, যেগুলো অ্যাসেসমেন্ট করতে প্রয়োজন হয়। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তো তার বিনিয়োগের অর্থ মুনাফাসহ ফেরত পাওয়ার গ্যারান্টি চায়। অধিকাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রেন্টেড প্লেস বা ভাড়া করা স্থানে ব্যবসা করে। তাদের স্থায়িত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়তা থাকে না। এই সমস্যাগুলো রয়েছে। 

খবরের কাগজ: বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের সহায়তা করতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করেছে। তারপরও উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না কেন? 

এম জামাল উদ্দিন: ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম একধরনের নিরাপত্তা। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়ে তা উদ্ধার করতে না পারলে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই টাকা পরিশোধ করবে। এটি সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একধরনের স্টিমুলাস স্কিম, যা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু উদ্যোক্তার মানসিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সেই সুযোগটা নিয়ে যদি ব্যবসা ফেলে যান, তাহলে কী হবে? বারবার একই ধরনের ঘটনা ঘটলে সেটা খুব খারাপ নজির তৈরি করবে। তা ছাড়া এ ধরনের ঘটনায় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে হয়রানি হতে হবে। সময় ও আর্থিক ক্ষতিও আছে। কারণ প্রতিটি ঋণগ্রহীতার পেছনে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সময় ও অর্থ বিনিয়োগ রয়েছে।

খবরের কাগজ: নিয়ন্ত্রক সংস্থার দিক থেকে আর্থিক খাতের চ্যালেঞ্জ কী কী বলে আপনি মনে করেন?

এম জামাল উদ্দিন: একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয়, তা হলো শ্রেণীকৃত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ। এই প্রভিশন তুলনামূলক বেশি। এ কারণে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান মুনাফা দেখাতে পারছে না। এ ছাড়া বিনিয়োগযোগ্য তারল্য বা পরিচালন ব্যয় নির্বাহে অর্থ থাকছে না। আর্থিক প্রতিষ্ঠান তো বিনিয়োগ করেই আয় করে। তা যদি নাই করতে পারে তাহলে আয় হবে কী করে? আমাদের প্রতিষ্ঠান কিন্তু ব্যতিক্রম। আমাদের এই চাপ নেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানের তা নেই।

খবরের কাগজ: আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অসতর্কতা আছে বলে মনে করেন কি আপনি?

এম জামাল উদ্দিন: আমি তা মনে করি না। কারণ, কে কী উদ্দেশ্যে লাইসেন্স চাইছে তা তো বোঝা মুশকিল। রাজনৈতিক ব্যক্তি উদ্যোক্তা হলেই যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি খারাপ হয়ে পড়বে, সেটা মনে করা ঠিক নয়। আসলে উদ্যোক্তাদের মিশন-ভিশন থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো চললে তা একসময় দাঁড়াবেই।

খবরের কাগজ: আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করছেন এবং ভবিষ্যতে যারা কর্মী হতে ইচ্ছুক তাদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?

এম জামাল উদ্দিন: যারা চাকরি করছেন, তাদের আমি বলব- গ্রাহককে নিজ ঘরের মেহমান হিসেবে দেখবেন। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আপনার কাছে গেলে যেই সম্মান ও সেবা আপনি দিয়ে থাকেন একজন গ্রাহককে সেই সম্মান ও গুরুত্ব দিয়ে সেবা দিতে হবে। ভবিষ্যৎ কর্মীদের জন্য আমি বলব, যেই প্রতিষ্ঠানের জন্য আপনি কাজ করবেন তার স্বার্থের প্রতি যত্নবান হবেন। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন। প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রতি সম্মান দেখাবেন। এটি পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার স্থান। পরিশ্রম করলে খুব শিগগির উন্নতি হবে ক্যারিয়ারের।

সাক্ষাৎকারে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান কয়েকজন লোক বাজার নিয়ন্ত্রণ করে

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৫৩ এএম
আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৩ পিএম
কয়েকজন লোক বাজার নিয়ন্ত্রণ করে
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান একজন শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সমাজচিন্তাবিদ। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র‍্যাকের চেয়ারম্যান। একই সঙ্গে তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ২০০৭-০৮ সালের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় উপদেষ্টা হিসেবে বাণিজ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পরামর্শদাতা ছিলেন। খবরের কাগজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি দারিদ্র্যবিমোচন, ভূমি-সংস্কার, সুশিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, অর্থনীতির পুনর্জাগরণ, সুশাসন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন অর্থাৎ গণতান্ত্রিক উৎকর্ষের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক শেহনাজ পূর্ণা

খবরের কাগজ: বর্তমানে দেশের অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী কী বলে আপনি মনে করেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: দেশের অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ অনেক মাত্রায়। একটা মাত্রা হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো। গত ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে দুর্নীতি যেভাবে হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যে ধস নেমেছিল এবং এখনো সেসব ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত অনেক সমস্যা আছে। একটা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোকে এক ধরনের স্থিতিশীল রাখা। এটা অর্থনীতি ঠিক করার গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে- পরিবার পর্যায়ে অর্থনীতির জায়গাগুলোকে কীভাবে স্বস্তিদায়ক করা যায়। সেগুলো আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে আছে। সেখানে সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে- অর্থনীতির চাকাকে আরও বেগবান করতে হবে। অর্থনীতি ঠিক করার জন্য অর্থনীতির কর্মকাণ্ডের পরিধিটা বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান তৈরির কাজ বাড়াতে হবে। এখন আমাদের এক ধরনের সমস্যা ঠিক করতে গিয়ে অন্য সব স্থবির হয়ে গেল। যারা অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে পারবেন, তারা এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছেন। কারণ আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা ঠিক জায়গায় নেই। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে না। অর্থনীতিকে বেগবান করতে এই জায়গাটাও ঠিক করা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে আরও একটি স্তর খুবই জরুরি। কারণ বাংলাদেশকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করার বিষয় আছে। আরেকটা হচ্ছে, অর্থনৈতিক কষ্ট কমানো। 

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি বেগবান করার নতুন প্রবৃদ্ধির চালক আবিষ্কার করা দরকার। সেখানে এলডিসি গ্রাজুয়েশন হলে কী কী ধরনের বিষয় আমাদের মধ্যে নিয়ে আসা উচিত, তা ভাবতে হবে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কীভাবে আমাদের পদচারণাগুলো ঠিক করব তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। অর্থনীতি চালুর জন্য তিনটি পর্যায়ে কাজ করা খুব জরুরি। একটা বিষয় দেখেছি যে, সামষ্টিক সূচকগুলো ঠিক করার বিষয়ে কিছুটা মনোযোগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু অন্য দুটো স্তরে জোরালো পদক্ষেপগুলোয় বড় ধরনের ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। সেদিকে মনোযোগ বাড়ানো দরকার। 

খবরের কাগজ: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলছে। কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের পরও সেই সব পণ্যের দাম কমছে না। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: এখানে আমদানি শুল্ক একটি বিষয়। আরও অনেক ব্যাপার আছে- যেগুলো ব্যবহার করা দরকার। পণ্যের ক্ষেত্রে দুটো ভাগ আছে। একটা হচ্ছে- সাপ্লাই চেইনগুলো ঠিক আছে কি না, তা দেখা। অন্যটি হচ্ছে- দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। এই জায়গাগুলোর বাস্তবতা কেমন তা জানা দরকার। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, মুষ্টিমেয় লোকের নিয়ন্ত্রণ আছে বাজারের ওপর। সে ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে সবকিছু মোকাবিলা করা যায়নি। এখন একটা প্রবণতা বাদ দেওয়া উচিত যে, সার্বিকভাবে আমি পুরো ব্যক্তি খাতকে বললাম- এরা সবাই দোষী। এরা সবাই মুষ্টিমেয় নয়। বাস্তবতা হচ্ছে- লাখ লাখ সাধারণ ইকোনমেক্টর আছেন। যারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কাজ করে যাচ্ছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। একই সঙ্গে সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে হবে। আবার খুব কৌশলী এবং মাঠতথ্য নিবিড়ভাবে জোগাড় করা এবং সেই ভিত্তিতে প্রতিনিয়ত নতুন পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। এভাবে অনেক বেশি উদ্যোগী হওয়া দরকার। এখানেও ভালোভাবে নজর দেওয়াটা জরুরি। 

খবরের কাগজ: সিন্ডিকেট নিয়ে অনেক লেখালেখি, আলোচনা, কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারের করণীয় কী?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য সরকারের অনেককিছু করণীয় আছে। প্রথমত, সিন্ডিকেট ভাঙার বিষয়টা খোলাসা করা দরকার। সেটা কীভাবে করা সম্ভব? সিন্ডিকেট একটা শব্দ। এটা সত্য যে, সিন্ডিকেট একটা পপুলার শব্দ হয়ে গেছে। কারণ, দেখেছি মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক নানাভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে সিন্ডিকেট সংস্কারের কথা আগে যেমন বলেছিলাম, একটা শব্দ দিয়ে আমার মনে হচ্ছে আমি সব বুঝে ফেললাম, আসলে তা নয়। সিন্ডিকেটের বিষয়টা চিন্তা করতে হবে। অযৌক্তিক কোনো বাজার নিয়ন্ত্রণের জায়গাগুলো সরকারকে সক্ষমতার সঙ্গে দেখতে হবে। সেখানেও একই দুর্বলতা দেখছি। ব্যক্তি খাতের সঙ্গে এনগেজমেন্ট বা সংযোগ কম করছে সরকার। সিন্ডিকেট যদি নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাহলে অর্থনীতিতে যারা ক্রিয়াশীল আছেন তাদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কথা বলতে হবে। এই জায়গাগুলো উন্নত করা যায়। এটি চেয়ারে বসে হুমকি দেওয়ার কোনো বিষয় নয়। এখানে অনেক সূচক বের করা প্রয়োজন। যার মাধ্যমে এটাকে কিছুটা হলেও মোকাবিলা করা যেতে পারে এবং তা নিশ্চয়ই সম্ভব।

খবরের কাগজ: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সরকারের করণীয় কী?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: রিজার্ভ বাড়াতে আমাদের নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। শুধু সস্তা শ্রম নয়, উন্নতমানের শ্রম যদি পাঠাতে পারি তাহলে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে। আমাদের যে অপচয়ের জায়গাগুলো আছে, যদি তা বন্ধ করতে পারি, সেটা নিশ্চয়ই রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভালো বিষয় হবে। রিজার্ভ বাড়ানোটা একমাত্রিক লক্ষ্য হিসেবে দেখা ঠিক নয়। এমন যদি হয়, এই মুহূর্তে রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে আছে। আমদানি কমিয়ে দিয়ে এটা ম্যানেজ করা হয়েছে। এর কারণে রিজার্ভ সন্তোষজনক। তাহলে এই সন্তোষজনক রিজার্ভ অর্থনীতির জন্য কোনো শুভ ফল বয়ে আনবে না। আমদানি না করলে অর্থনীতি চলবে না। কিন্তু আমার রিজার্ভ ঠিক আছে। রিজার্ভ দিয়ে তাহলে কী করবে? রিজার্ভকে যাই বলি, এটা একটা সূচক। এটাকে আলাদা করে শুধু রিজার্ভকে ঠিক করব- এটা কোনো নীতির উদ্দেশ্য হতে পারে না। কাজেই বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীলতায় আমাদের আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। 

খবরের কাগজ: কর-জিডিপি অনুপাতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে নিচে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: এখানে অন্যতম সত্য কথা হলো- কর-জিডিপি অনেক কম। কিন্তু আমাদের একই কথার দুটো সত্য এখানে আছে। একটি হচ্ছে যে, কর-জিডিপির অনুপাত কম। কিন্তু মানুষ কর ছাড়াও অনেক কিছুতে চাঁদা দেয়। তার পকেট থেকে অনেক অনেক চাঁদা চলে যায়। অনেক ধরনের ঘুষ চলে যায়। মানুষের পকেট থেকে দেখা টাকা কর হিসেবে সরকারের তহবিলে ঢুকছে না। কিন্তু মানুষের পকেট থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। এমন নয় যে, মানুষ দেওয়ার বিষয়ে পিছিয়ে আছে। এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কর প্রশাসনিক সংস্কার। এর জন্য কর কমিশনের দরকার ছিল না। একটা সংস্কার কমিশন রিপোর্ট দেবে। এর জন্য নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই। এখনই এই কর প্রশাসন সংস্কারের পদক্ষেপগুলো শুরু করা যেতে পারে। মানুষকে উৎসাহিত করার বিষয় আছে কর দেওয়ার জন্য। কর প্রশাসনটা মূলত হয়রানিমূলক একটা বাস্তবতা। তাদের ডিসক্রিমিনেশনের ক্ষমতা এত বেশি যে, যেকোনো উদ্যোক্তা সবসময় একটা ভয়ের মধ্যে থাকেন। তখন তারা এদের কিছু ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সার্বিকভাবে করটা হয়তো বাড়ে না। তাই এই মুহূর্তে কর প্রশাসনের সংস্কার খুবই জরুরি।

খবরের কাগজ: বেসরকারি বিনিয়োগ অনেক বছর ধরে একই জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার কী পদক্ষেপ নিতে পারে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: বেসরকারি বিনিয়োগ এখন আরও স্থবির হয়ে আছে। এর গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে- ব্যবসার পরিবেশ। ব্যবসায় পরিবেশের একটা বিষয় আছে। কর প্রশাসনে আমলাতান্ত্রিক হয়রানি, হয়রানিমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে বিনিয়োগ কমে যায়। দ্বিতীয়ত, আমাদের এখানে বিনিয়োগ করতে হলে জমি দরকার, আমাদের এনার্জি দরকার- এগুলোর যদি নিশ্চয়তা না থাকে, তাহলে বিনিয়োগ সেভাবে তৈরি হবে না। এখানে দীর্ঘসূত্রতার বিষয় অনেক বেশি। আমরা দেখেছি যে, বিদেশি বিনিয়োগ একেবারেই স্থবির। অনেকের হাতে হয়তো পয়সা আছে, কিন্তু তারা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এগুলোর পেছনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দায়ী। একটা সূচক ঠিক করলাম, কিন্তু দেখা গেল যে, একটা শব্দ চালু আছে; সবসময় এটা নিয়ে প্রোগ্রাম হয়- ওয়ান স্টপ সার্ভিস। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের পেছনে ১০টি স্টেপ নিতে হয়। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের বাস্তবতা সেভাবে নেই। এখানে ব্যবসার পরিবেশটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের কিন্তু জোরালো কার্যকর আলোচনা এবং ব্যবসায়িক মহলের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখাটা খুবই জরুরি। সেখানেও একটা মতানৈক্যের ঘাটতি সবসময় পরিলক্ষিত হয়।

খবরের কাগজ: বাজেটঘাটতি মেটাতে সদ্য বিদায় নেওয়া শেখ হাসিনার সরকার বিপুল পরিমাণ ঋণ রেখে গেছে। ফলে সুদ পরিশোধে চাপ বাড়ছে। বিশাল এই ঋণের সুদাসল কীভাবে পরিশোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: ঋণ পরিশোধ করতে হবে অর্থনীতির উদ্বৃত্ত থেকে। আমাদের অর্থনীতি বাড়বে, সেটা থেকে যে উদ্বৃত্ত আসছে বা কর আসছে এটা থেকেই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। বিগত সরকার এই যে বিপুল পরিমাণ ঋণই শুধু রেখে গেছে, তাই নয়। এই বাক্যটাকে আমি যদি কিছুটা পরিবর্তন করি, তাহলে বলতে পারি যে, বিপুল পরিমাণ দুষ্টু ঋণ রেখে গেছে। এগুলো শুধু ঋণ নয়, দুষ্টু ঋণ। দুষ্টু ঋণ এই অর্থে যে- অনেক প্রজেক্টের সম্ভাব্যতা যাচাই হয়নি। আপনি জোরালোভাবে ঋণ নিয়ে প্রকল্প করেছেন। যার থেকে আসলে অর্থনীতির যে ভূমিকা রাখার কথা- তা রাখছে না। সুতরাং ঋণটা তখন বোঝা হয়ে যায়। ঋণ সবাই নিতে পারে। ঋণ নিয়ে যদি খুব ভালো করি, এটাকে ব্যবহার করে অর্থনীতির পরিধি আরও দ্বিগুণ করে ফেলতে সক্ষম হই, তখন ওই ঋণ পরিশোধ করতে তেমন কোনো সমস্যা থাকে না। এখানে দুষ্টু ঋণের যে বোঝা রেখে গেছে বিগত সরকার, এটা অবশ্যই একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। যেকোনো সরকারের ক্ষেত্রে, পরবর্তীতে যারা আসবে- এই দুষ্টু ঋণ আমি দেব না- এমন কথা বলার অবকাশ তাদের নেই। আন্তর্জাতিক চুক্তি সই হয়েছে। সেখানে সহজেই এগুলো বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। এটা একটা কঠিন পরিস্থিতি। বিষয় হচ্ছে- এখানে ব্যবস্থাপনা একটা বড় ইস্যু। কোথায় কোনগুলোকে কিছুটা আইনি মাধ্যমে মোকাবিলা করা যায়- তা দেখার বিষয় আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- আমাদের অর্থনীতিকে বেগবান করার মাধ্যমে এই ঋণের বোঝা পরিশোধের চেষ্টা করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই। 

খবরের কাগজ: শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরেনি এখনো। ফলে বাজারে পতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। শেয়ারবাজার চাঙা করতে কী ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া যায়?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: এতদিনে শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আসা উচিত ছিল। আমরা একটা বিষয় দেখেছি, যেমন- স্টক এক্সচেঞ্জের যিনি সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, তিনি দৃশ্যত দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসনের সহযোগী ছিলেন। তাকে সরানো হলো। এটা একটা কাজ হয়েছে। এভাবে অনেককে সরানো হয়েছে। কিন্তু যাদের বসানো হয়েছে, তারা ওই স্থানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন কি না, সেটাও দেখা দরকার। শেয়ারবাজারের বিষয়টাও একই বিষয়। শেয়ারবাজার ম্যানেজ করা; যারা দায়িত্ব পেয়েছেন তারা সঠিকভাবে সিগন্যালগুলো ঠিকমতো দিতে পারছেন কি না। এখনো একটা কথা সত্যি যে, এতদিন যারা অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন তারা সবাই চলে যাননি। তারা অনেকেই আছেন। তারা এখনো সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। ভোল পাল্টানোর একটা সংস্কৃতি বাংলাদেশে জোরালোভাবে আছে। অর্থাৎ ভোল পাল্টিয়ে আগের চেহারা বদলে আবারও সুযোগ-সুবিধা নিতে শুরু করার একটা সংস্কৃতি ছিল এবং এখনো আছে। এই ভোল পাল্টানোর সুযোগগুলো শক্ত হাতে বন্ধ করা খুবই জরুরি। সেখানে কোনো ধরনের নতুন সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। আপনি দুনীর্তিবাজকে সরালেন, কিন্তু সক্ষমতার জায়গাটা তৈরি করতে পারলেন না। তাহলে ওটা আংশিক পদক্ষেপই থেকে গেল। এর সুফল পাওয়া কখনো সম্ভব নয়।

খবরের কাগজ: বিগত সরকারের সময়ে আর্থিক খাতে বা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ভুল পদক্ষেপের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বিপাকে পড়েছে এবং এসব প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ কর্মী কাজ করছে। এরা যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে পারে, সে ব্যাপারে করণীয় কী?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: এটাও একটা ম্যানেজমেন্ট চ্যালেঞ্জ। আপনি যেটা বললেন, প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার দুর্নীতিপরায়ন হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটা হয়তো চলছে। বিশ্বের অনেক দেশে উদাহরণ আছে- এগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়। আপনার প্রতিষ্ঠানটা যেন চলতে পারে সেটা নিশ্চিত করা দরকার। যারা এটার কর্ণধার হিসেবে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন তাদের সরিয়ে কীভাবে তা করা যেতে পারে অর্থাৎ এটা সার্বিক অর্থনীতির ম্যানেজমেন্ট চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত। সে জায়গায় বিষয়টাকে দেখতে হবে। এটাতে অন্য কোনো ম্যাজিক ফরমুলা নেই। এখানে কেস বাই কেস- ঢালাও এক সিদ্ধান্তের ব্যাপার নয়। সে ক্ষেত্রে সক্ষম একটা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

খবরের কাগজ: আমাদের দেশে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি করতে সরকারের পক্ষ থেকে করণীয় কী?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: তরুণ উদ্যোক্তা সরকার তৈরি করবে না। তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি করবে সামগ্রিকভাবে ব্যক্তি খাত। তারা তৈরি করবে এবং তরুণ যারা, তারা নিজ উদ্যোগেও উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করবে। সরকারের এখানে যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, সেটা হচ্ছে- তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা এবং যেখানে নীতিসুযোগগুলো দেওয়া দরকার অর্থাৎ যেখানে বিনিয়োগের সুযোগগুলো তৈরি করা দরকার, সেই জায়গায় তাদের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে মাঠে আসা দরকার। সরকার কর্মসংস্থান তৈরি করে না, সরকার উদ্যোক্তা তৈরি করে না, সরকার পরিবেশটা তৈরি করে এবং সেই পরিবেশটা সঠিকভাবে তৈরি করতে পারছে কি না, সেটিই হচ্ছে মূল বিবেচ্য বিষয়।

খবরের কাগজ: আপনি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে কীভাবে দেখতে চান?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সবাই যেভাবে দেখতে চায়- এখানে বৈষম্যের বিষয়টা খুব বেশি এসেছিল। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ দেখতে চাই অবশ্যই। পাশাপাশি বলতে হবে, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক কষ্টের একটা অবসান হওয়া খুব দরকার। একই সঙ্গে আমি দেখতে চাইে, দেশে একটা সহিষ্ণু সমাজ গড়ে উঠুক। আমাদের একটা সক্ষম রাষ্ট্র দরকার। রাষ্ট্রের অনেক অক্ষমতা আমরা দেখতে পেয়েছি। যদিও স্বৈরশাসন ছিল। রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে অনেক ধরনের অক্ষমতা ছিল। এখন আমরা একটি সক্ষম রাষ্ট্র চাই। একই সঙ্গে আমি উচ্চ মূল্যবোধের বিকাশও চাই। এই ধরনের একটা সমাজ চাই, যেখানে প্রতিটি নাগরিক একটি মর্যাদার আসনে নিজেকে ভাবতে পারবে। সে প্রাত্যহিক জীবনে হোক, অর্থনৈতিক জীবনে হোক, বা প্রাতিষ্ঠানিক জীবন হোক- যেভাবেই হোক। সেজন্য আমরা যেন বিচার ও ইনসাফগুলো নিশ্চিত করতে পারি। একটা সুষ্ঠু সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে সবারই যে আকাঙ্ক্ষা, আমারও সেই একই আকাঙ্ক্ষা যে, আমরা একটা সুন্দর, অসাম্প্রদায়িক একই সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ দেখব।

খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। 
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।

পোলট্রিশিল্পে তদারকি সেল গঠনের দাবি

প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:১৯ এএম
আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪১ এএম
পোলট্রিশিল্পে তদারকি সেল গঠনের দাবি
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার। ছবি: খবরের কাগজ

দেশের পোলট্রিশিল্প বিকশতি হচ্ছে। পাশাপাশি নানা সমস্যাও রয়েছে। এ খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা সিন্ডিকেটের আধিপত্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণ। এর সমাধানে সরকারি ফিড মিল ও হ্যাচারি চালু করা, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং বাজারে ভারসাম্য বজায় রাখতে একটি মনিটরিং (তদারকি) সেল গঠন করা প্রয়োজন। পোলট্রিশিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদারের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারে নিয়েছেন সাখাওয়াত হোসেন সুমন

খবরের কাগজ: পোলট্রিশিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

সুমন হাওলাদার: বাংলাদেশের পোলট্রিশিল্প বর্তমানে একটি সংকটময় সময়ের মধ্যে রয়েছে। করপোরেট সিন্ডিকেট এবং বাজারের ভারসাম্যহীনতার কারণে প্রান্তিক খামারিরা তাদের উৎপাদনের জন্য ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, ফলে তারা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এর ফলে অনেক খামারি তাদের উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন, ফলে পোলট্রিশিল্পের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়েছে।

খবরের কাগজ: পোলট্রিশিল্পের উন্নয়নে বিপিএর ভূমিকা কী এবং ভবিষ্যতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?

সুমন হাওলাদার: বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) পোরট্রিশিল্পের উন্নয়নের জন্য একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সরকারি ফিড মিল এবং হ্যাচারি চালুর উদ্যোগ, যাতে করে করপোরেট সিন্ডিকেটের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ভাঙা যায়। এ ছাড়া, বিপিএ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে খামারিদের সরাসরি বাজারে সংযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা করেছে, যা তাদের লাভজনক উৎপাদন নিশ্চিত করবে। ভবিষ্যতে খামারিদের জন্য ঋণ সুবিধা সহজলভ্য করার উদ্যোগ এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

খবরের কাগজ: পোলট্রিশিল্পের জন্য সরকারের নীতি এবং সহায়তা সম্পর্কে কিছু বলুন? 

সুমন হাওলাদার: সরকার পোলট্রিশিল্পের উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু সেগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, ফিড মিল এবং হ্যাচারি স্থাপন প্রক্রিয়ায় আরও উদ্যোগী হতে হবে। সরকারের উচিত প্রান্তিক খামারিদের জন্য ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ এবং বাজারের ওপর শক্ত মনিটরিং ব্যবস্থা তৈরি করা, যেন তারা বাজারে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হন।

খবরের কাগজ: পোলট্রি মাংস ও ডিমের বাজারে দাম বৃদ্ধি এবং সরবরাহের সমস্যা সম্পর্কে আপনার মতামত সম্পর্কে বলুন। 

সুমন হাওলাদার: বর্তমানে পোলট্রি মাংস ও ডিমের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মূলত সিন্ডিকেটের কারণে। এই একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ খামারিদের জন্য ক্ষতিকর, কারণ তারা উৎপাদন খরচ মেটাতে পারছেন না। এর সমাধানে, সরকারি উদ্যোগে ফিড মিল ও হ্যাচারি চালু করার পাশাপাশি খামারিদের জন্য সরাসরি বিক্রির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, যাতে তারা বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেন।

খবরের কাগজ: পোলট্রি খামারে রোগবালাইয়ের সমস্যা অনেক বড় একটি বিষয়। বিপিএ এই সমস্যা মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?

সুমন হাওলাদার: পোলট্রি খামারে রোগবালাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কিন্তু বিপিএ খামারিদের জন্য স্বাস্থ্যবিধি ও রোগ প্রতিরোধে আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট। তারা নিয়মিত সচেতনতা কার্যক্রম এবং উন্নত চিকিৎসাপদ্ধতির মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করছে। খামারিদের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

খবরের কাগজ: পরিবেশবান্ধব পোলট্রি চাষের জন্য বিপিএ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কি না?

সুমন হাওলাদার: হ্যাঁ, বিপিএ পরিবেশবান্ধব পোলট্রি চাষের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা খামারের বর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদন এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পোলট্রি চাষ পরিচালনার জন্য খামারিদের উৎসাহিত করছে, যাতে পোলট্রিশিল্পের পরিবেশগত প্রভাব কমে।

খবরের কাগজ: বর্তমানে পোলট্রি খামারি ও প্রোডিউসারদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো কী এবং সেগুলোর সমাধান কীভাবে করা যেতে পারে?

সুমন হাওলাদার: সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সিন্ডিকেটের আধিপত্য এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ। এর সমাধানে, সরকারি ফিড মিল ও হ্যাচারি চালু করা, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং বাজারের ভারসাম্য বজায় রাখতে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন। তাছাড়া, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে খামারিদের সরাসরি বাজারে সংযোগ তৈরি করা প্রয়োজন।

খবরের কাগজ: পোলট্রিশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার কী দৃষ্টিভঙ্গি? এই শিল্প কোন দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

সুমন হাওলাদার: পোলট্রিশিল্পের ভবিষ্যৎ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত যদি প্রান্তিক খামারিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায় এবং বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানো যায়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে খামারিরা সরাসরি বাজারে তাদের পণ্য বিক্রি করতে সক্ষম হবেন এবং সরকারি সহায়তার মাধ্যমে শিল্পের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। এই শিল্পে টেকসই উন্নয়ন এবং লাভজনক বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।

খবরের কাগজ: আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পোলট্রিশিল্পের অবস্থান কেমন এবং বিশ্ববাজারে এর প্রতিযোগিতার সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে চলা সম্ভব?

সুমন হাওলাদার: বাংলাদেশের পোলট্রিশিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করছে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে হলে আমাদের উৎপাদন খরচ কমাতে হবে এবং পণ্যের মান বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের পণ্য সরবরাহ করতে পারলে বাংলাদেশের পোলট্রিশিল্প বিশ্ববাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে।

খবরের কাগজ: নতুন পোলট্রি খামারি হিসেবে যারা এই ব্যবসা শুরু করতে চান, তাদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?

সুমন হাওলাদার: নতুন পোলট্রি খামারিদের জন্য প্রথমেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা এবং বাজারের চাহিদা বুঝে উৎপাদন শুরু করা উচিত। এ ছাড়া, সরকারি সহায়তা এবং ঋণ সুবিধা ব্যবহার করে ব্যবসা শুরু করা উচিত, যাতে প্রাথমিক পর্যায়ে আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায়।

খবরের কাগজ: খামারিদের জন্য ঋণ সুবিধা বা ফিন্যান্সিং সুযোগ বিষয়ে বিপিএর কোনো উদ্যোগ আছে কি?

সুমন হাওলাদার: বিপিএ খামারিদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা এবং সরকারি সহায়তা প্রদানের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। এই সুবিধাগুলো প্রান্তিক খামারিদের জন্য বিশেষভাবে উপকারি, যাদের আর্থিকসংকট কাটানোর জন্য ঋণ প্রয়োজন।

খবরের কাগজ: ডিম ও মুরগির বাজারে স্বস্তি রাখতে বিপিএর লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য কী?

সুমন হাওলাদার: বিপিএর মূল লক্ষ্য হলো ডিম ও মুরগির বাজারে দাম ও সরবরাহের ভারসাম্য বজায় রাখা। এ জন্য তারা নিয়মিত বাজার বিশ্লেষণ এবং খামারিদের জন্য প্রান্তিক পণ্য সরবরাহের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিপিএ খামারিদের সাহায্য করতে এবং তাদের পণ্য বাজারে সঠিক মূল্য প্রাপ্তির জন্য বাজার ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহ শৃঙ্খলা শক্তিশালী করার জন্য কাজ করছে। সংকটকালে সরবরাহ সিস্টেম সহজতর করার জন্য বিপিএ নিত্যনতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে, যার মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার জন্য উন্নত মানের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং স্থানীয় বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

সাক্ষাৎকারে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঢাকা বাঁচাতে অনেক সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১৫ এএম
আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১১ এএম
ঢাকা বাঁচাতে অনেক সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ছবি: সংগৃহীত

অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা প্রশংসিত হয়েছে। তবে স্বার্থান্বেষী মহলের সমালোচনাও আছে। দেশের স্বার্থে এই উপদেষ্টা সমালোচনা আমলে না নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। খবরের কাগজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, সীমিত সময়ের মধ্যে এই সরকার হয়তো অনেক কাজ শেষ করে যেতে পারবে না, তবে শুরু করে দিয়ে যাবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের ডেপুটি বিজনেস এডিটর ফারজানা লাবনী

খবরের কাগজ: পরিবেশ সুরক্ষায় আপনি সব সময় আপসহীন। এখন তো আছেন সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। এ দেশের পরিবেশ রক্ষায় কীভাবে ভূমিকা রাখার পরিকল্পনা করেছেন? 

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: দীর্ঘদিনের উপেক্ষার কারণে দেশের পরিবেশ সমস্যাগুলো অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। স্বল্প মেয়াদের এই সরকারের পক্ষে সবকিছুর সমাধান দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে আমি কাজ শুরু করে যেতে চাই। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কাজ মূলত নিয়ন্ত্রণমূলক। এই মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর আইন প্রয়োগের কাজটিই করে। আমি আইন প্রয়োগে দীর্ঘদিনের উদাসীনতা কমানোর কাজ শুরু করেছি। ২০০২ সাল থেকে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ব্যাগের প্রচলনের কাজ শুরু হয়েছে। মানুষের দীর্ঘদিনের অভ্যাস আর বিকল্পের প্রাপ্যতা বিবেচনায় আমরা শাস্তির পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতেও কাজ করছি। শব্দদূষণ কমাতে আমরা কাজ শুরু করেছি। এ ক্ষেত্রে আইনের কিছু সংশোধন লাগবে। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা অভিযান এবং সচেতনতা সৃষ্টি- দুই দিকেই কাজ করতে পারব। ঢাকা শহরের ২১ খাল উদ্ধার করে ব্লু নেটওয়ার্ক তৈরির প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত। দেশের ৬৪ জেলা থেকে একটি করে নদী নির্বাচন করে তা দখল-দূষণমুক্ত করার কর্মপরিকল্পনা আমরা জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে পেয়েছি। এবার এসব প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে অন্তত আট বিভাগের আটটি নদী ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করতে পারব বলে আশা করি। এই মুহূর্তের সবচেয়ে জটিল আর জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু হয়েছে। কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত ও গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। আশা করি আগামী বছর এসব দুর্ভোগ কম থাকবে, তবে নদী ও বায়ুদূষণ রোধে সময় লাগবে। আমরা সেন্ট মার্টিনে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ করছি। এ ছাড়া অন্য মন্ত্রণালয়ের সাহায্য নিয়েও বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের সহায়তায় দখলকৃত বনের জায়গা উদ্ধার করছি, পাহাড় কাটা রোধে ব্যবস্থা নিচ্ছি, বালু ও পাথর তোলা নিয়ন্ত্রণ করছি। এরই মধ্যে আমরা ঢাকার পুকুর আর দেশের পাহাড়ের তালিকা চূড়ান্ত করেছি।

খবরের কাগজ: ঢাকার পরিবেশ নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। এই নগরীর দূষণ কমাতে আপনার পরামর্শ কী?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: বিশ্বের বসবাসযোগ্য নগরীর তালিকায় সবচেয়ে নিচে ঢাকার অবস্থান। এই নগরীর কোনো দর্শন নেই। ঢাকাকে বাঁচাতে শুধু পরিবেশ মন্ত্রণালয় নয়, সরকারের অনেক সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন, রাজউক এবং ওয়াসার। ভাবা যায়, একটি নগরী মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে অথচ তার পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা আর কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এমন বেহাল? ঢাকাকে রক্ষায় পরিবেশ মন্ত্রণালয় সব সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করবে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ও জলাশয় রক্ষায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা থেকে দূষণকারী পুরোনো যানবাহন তুলে নেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বায়ুদূষণ কমাতে একগুচ্ছ জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

খবরের কাগজ: পলিথিন নিষিদ্ধে আপনি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। এই পদক্ষেপ বাস্তবায়নে কোন পথে অগ্রসর হচ্ছেন?
 
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আমাদের প্রচেষ্টার কারণে ঢাকা শহরের বড় মলগুলোতে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ হয়েছে। আমরা দ্বিতীয় দফায় কাপড়ের বাজার ও কাঁচাবাজারে অভিযান চালাচ্ছি। শিগগিরই আমরা পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনের জায়গায় আবার অভিযানে যাব। এই কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে ঢাকার বাইরেও জোরদার করা হবে। জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রাখতে। নদী, মাটি আর জীবন বাঁচাতে এর বিকল্প নেই।

খবরের কাগজ: সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ রক্ষায় আপনার মন্ত্রণালয় থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব নিয়ে কিছু মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত কী?
 
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: অপপ্রচার নিয়ে মতামতের সুযোগ নেই, কিন্তু পর্যটন নিয়ন্ত্রণের সুফল স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকরা পেতে শুরু করেছেন। অনিয়ন্ত্রিত জাহাজমালিকরা নিয়ম মানছেন না, পর্যটকরা পলিথিন-প্লাস্টিক সামগ্রী নিচ্ছেন না, এগুলো বড় পরিবর্তন। জেলা প্রশাসকরা নিয়মিত নজরদারি ও অভিযান চালিয়েছেন, আর এসব কাজে প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এটি প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি বলে মনে করি। পরিবেশ আইন যে মানতে হবে, তার একটি বার্তা আমরা পৌঁছাতে পেরেছি।

খবরের কাগজ: বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণমুক্ত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা কতটা পাচ্ছেন?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: স্থানীয় পরিবেশ ইস্যুতে সাহায্য করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে, তবে বৈশ্বিক ক্ষেত্রে জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলার রোধে তাদের ভূমিকা হতাশার। আন্তর্জাতিক সাহায্য পেতে আমরা আগ্রহী, উন্নয়ন সংস্থাগুলোও সাহায্য করতে আগ্রহী। তবে আমাদের আমলাতন্ত্র প্রকল্প অনুমোদনে যে সময় নেয়, তা উদ্বেগের।

খবরের কাগজ: স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রক্ষা করতে হলে সরকারকে কোন বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষায় বিগত সরকার কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: অতীতের সরকার সেই ভূমিকা রেখেছে, যা রাখলে সবচেয়ে দূষিত বাতাসের নগরী হওয়া যায় আর সবচেয়ে বসবাস অযোগ্য নগরীর অধিবাসী হওয়া যায়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমূল পরিবর্তন দরকার, যা একটি সীমিত সময়ের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য কষ্টসাধ্য। তবে আমরা পরিবর্তনের ধারা সূচনা করে দিয়ে যাব, যাতে পরবর্তী সরকার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে। আমি মনে করি, পলিথিন দূষণ, বায়ু, নদী আর শব্দদূষণ প্রাধিকার। 

খবরের কাগজ: রাজধানী ঢাকার রাস্তায় গাড়ির কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এ সমস্য এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আপনি এই সমস্যার সমাধানে কী পরামর্শ দেবেন। আপনি এ বিষয়ে কী করতে চান?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: বিষয়টি নিয়ে সড়ক ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এক হয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। আমরা আগামী মে মাসের মধ্যে সড়ক থেকে পুরোনো বাস-ট্রাক সরানোর নির্দেশ দিয়েছি। এর কিছু প্রায়োগিক দিক আছে, যেমন ১৪ হাজার যানবাহনের বিকল্প নিশ্চিত করা। আমরা সেই লক্ষ্যেও কাজ শুরু করেছি।

খবরের কাগজ: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বর্তমান সরকার মোটা দাগে সময়সীমা জানিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে পরিবেশ রক্ষায় আপনার কর্মপরিকল্পনা কী?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: প্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলো ধরে কাজ শুরু করে দেওয়া এবং সব কাজে জনগণকে, বিশেষত তরুণ সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করা।

ব্র্যাক ব্যাংক সব সূচকে এগিয়ে

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১৭ এএম
আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১৯ এএম
ব্র্যাক ব্যাংক সব সূচকে এগিয়ে
সেলিম আর এফ হোসেন

গ্রাহক চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে, তাদের মতামতের প্রতি সম্মান জানিয়ে ব্র্যাক ব্যাংক প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পণ্য ও সেবা নিয়ে আসছে। ব্যাংকটির এ সাফল্য ও ব্যাংক খাত নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম আর এফ হোসেনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এম মনিরুল আলম
 
খবরের কাগজ: ব্যাংকিং খাত একটা দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেও ব্র্যাক ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। কীভাবে সম্ভব এটি?
সেলিম আর এফ হোসেন: ব্র্যাক ব্যাংক অন্য যেকোনো ব্যাংক থেকে আলাদা। সুশাসন, নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, নিয়মানুবর্তিতা আমাদের ব্যাংকের বিজনেস মডেলের মূল স্তম্ভ। অভিজ্ঞ, স্বতন্ত্র ও পেশাদার পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করে। আর পেশাদার সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিম ব্যাংকের পলিসি ও স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনা করে। ব্যাংকের বিভিন্ন কমিটি মানদণ্ড অনুযায়ী ও কার্যকারিতা বজায় রেখে ব্যাংকের কার্যক্রম নজরদারি করে। এভাবে নিশ্চিত হয় সুশাসন, যা নিশ্চিত করে শক্তিশালী আর্থিক ভিত ও টেকসই প্রবৃদ্ধি।

আমাদের এ ব্যাংকের রয়েছে সবচেয়ে বেশি মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ও ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ারহোল্ডিং। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা এসঅ্যান্ডপি ও মুডি’স থেকে প্রাপ্ত দেশের সব ব্যাংক থেকে উৎকৃষ্ট ক্রেডিট রেটিং এ ব্যাংকের উচ্চমানের ব্যবস্থাপনা ও কর্মদক্ষতার প্রতিফলন বহন করে। প্রায় সব আর্থিক সূচক ও মানদণ্ডে ব্র্যাক ব্যাংক অন্য সব স্থানীয় ব্যাংক থেকে এগিয়ে আছে। এভাবেই ধারাবাহিকভাবে আর্থিক সাফল্য অর্জন করছে ব্র্যাক ব্যাংক।

খবরের কাগজ: ব্র্যাক ব্যাংকের দৃষ্টিতে গ্রাহকের অবস্থান কোথায়?
সেলিম আর এফ হোসেন: ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান শক্তি হচ্ছে গ্রাহকদের আস্থা। গ্রাহকরা সেবার সুযোগ দিচ্ছেন বলেই ব্র্যাক ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছে। এই ব্যাংকের কাছে গ্রাহকের অবস্থান সবার ওপরে। সুশাসন, স্বচ্ছতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ আমাদের ব্যাংকিং মডেলের ভিত্তি। পরিবেশের কথা বিবেচনায় রেখে আমরা ব্যাংকিংয়ে সাসটেইনেবিলিটিতে জোর দিয়ে থাকি। এসব কারণে গ্রাহকরা ব্র্যাক ব্যাংকে আস্থা রাখেন ও ব্যাংকিং করতে পছন্দ করেন। একটি গ্রাহককেন্দ্রিক ব্যাংক হিসেবে গ্রাহকদের মতামত নিয়ে নতুন প্রোডাক্ট ও সার্ভিস ডিজাইন করে ব্র্যাক ব্যাংক। যেমন, প্রিমিয়াম ব্যাংকিং সার্ভিস আরও বেশি গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে আমরা প্রিমিয়াম ব্যাংকিং প্লাস ও ফ্যামিলি ব্যাংকিং চালু করেছি। আমাদের ডিজিটাল ব্যাংকিং অ্যাপে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ফিচার যোগ করা হচ্ছে, যাতে গ্রাহকরা অনেক সার্ভিস ঘরে বসেই দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা নিতে পারেন। গ্রাহকদের বর্তমান সময়ের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে আমরা নতুন নতুন প্রোডাক্ট ও সার্ভিস চালু করা অব্যাহত রাখব। 

খবরের কাগজ: অন্তর্ভুক্তিমূলক ঋণ বিতরণে ব্র্যাক ব্যাংক কি বাংলাদেশ ব্যাংকের সব নির্দেশ মেনে চলছে? 
সেলিম আর এফ হোসেন: ব্র্যাক ব্যাংক একটি এসএমই-প্রধান ব্যাংক। জামানতবিহীন এসএমই ঋণ বিতরণে আমরা দেশসেরা। এটি বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক, যার মোট ঋণ পোর্টফোলিওর অর্ধেকের বেশি এসএমই। ২০০১ সাল থেকে ১৪ লাখ তৃণমূল গ্রাহককে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা সিএমএসএমই ঋণ প্রদান করেছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের চার লাখ গ্রাহককে ব্র্যাক ব্যাংক আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে এসেছে। এক লাখ নারী গ্রাহকের মাঝে ৩ হাজার ১৩১ কোটি টাকা অর্থায়ন করা হয়েছে। এক লাখ কৃষকের মাঝে ৬৫০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে থাকা মানুষকে আর্থিক ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার জন্য ১০, ৫০ ও ১০০ টাকা প্রাথমিকভাবে জমা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে উপকৃত হচ্ছেন হাজার হাজার প্রান্তিক ও নিম্ন আয়ের মানুষ। 

খবরের কাগজ: নতুন কী উদ্ভাবনী চিন্তা করছে ব্র্যাক ব্যাংক?
সেলিম আর এফ হোসেন: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ব্র্যাক ব্যাংক সব সময়ই ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করে আসছে। গ্রাহককে স্বাচ্ছন্দ্য ও উপভোগ্য ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা দিতে আমরা ডিজিটাল ব্যাংকিং অবকাঠামোতেও বড় ধরনের বিনিয়োগ করছি। আস্থা অ্যাপে সাত লাখ গ্রাহক যুক্ত হয়েছেন। প্রতি মাসে এখন ১২ হাজার ৫০০ কোটির বেশি টাকা ট্রান্সফার হচ্ছে। প্রাথমিক সাফল্য অর্জনের পর ডিজিটাল লোন, ন্যানো লোন, সাপ্লাই চেইন ফাইন্যান্সিং আরও বিস্তৃত করা হবে। ডিজিটাল অনবোর্ডিয়ের জন্য ই-কেওয়াসিকে আস্থা অ্যাপের সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড করা হবে। সিআরএমের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে, যাতে গ্রাহকরা ২০ ঘণ্টা রিয়েল-টাইমে নগদ উত্তোলন ও জমা দিতে পারেন। করপোরেট ও ইনস্টিটিউশনাল গ্রাহকদের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘কর্পনেট’কে আরও সমৃদ্ধ করা হবে। আর সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এপিআই কানেক্টিভিটি স্থাপন করে গ্রাহকদের স্বাচ্ছন্দ্যময় ট্রানজেকশন অভিজ্ঞতা দেওয়া হবে। প্রযুক্তিতে নতুন উদ্ভাবন ও বিনিয়োগ অব্যাহত থাকবে। 

খবরের কাগজ: ব্যাংকিং খাতে চলমান দুরবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে বা আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি না? 
সেলিম আর এফ হোসেন: আমার কাছে এর কোনো সহজ উত্তর বা সমাধান নেই। এমন সংকট মোকাবিলায় সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের দিকনির্দেশনা এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের প্রযুক্তিগত ও আইনি সহায়তার প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়েছে, এটা আশার কথা। এখন আমাদের ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের বিশ্বাস বাড়াতে সব স্টেকহোল্ডারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমরা যেন ভুলে না যাই যে দেশে অনেক ব্যাংক আছে, যারা সুশাসন ও ব্যবস্থাপনার মানদণ্ডে উচ্চমানের। এই ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করে সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কাজ করছে।

একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. আলী রীয়াজ ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার সুপারিশ দেবে সংবিধান সংস্কার কমিশন

প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৭ এএম
আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৩ এএম
ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার সুপারিশ দেবে সংবিধান সংস্কার কমিশন
সংবিধান সংস্কার কমিশনপ্রধান ড. আলী রীয়াজ

৭ জানুয়ারি শেষ হবে সংবিধান সংস্কারবিষয়ক কমিশনের কার্যকালের মেয়াদ। ওয়েবসাইট ও খানা জরিপের মাধ্যমে কমিশনের কাছে ৯৬ হাজারের বেশি মতামত এসেছে। তাতে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে সবচেয়ে বেশি মত দিয়েছেন অংশীজনরা। এই কমিশনের প্রতিবেদন তৈরির সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন কমিশনপ্রধান ড. আলী রীয়াজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাহনাজ পারভীন এলিস। 

খবরের কাগজ: কমিশনের প্রতিবেদন তৈরির অগ্রগতি কত দূর? নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন দেওয়া কি সম্ভব হবে? নাকি সরকারের কাছে বাড়তি সময় চাইবেন?

ড. আলী রীয়াজ: বাড়তি সময়ের দরকার হবে না। আমাদের কাজ হলো সংবিধান পর্যালোচনা, সারাংশ নির্ধারণ ও যৌক্তিক কিছু সুপারিশ তৈরি করা। পর্যালোচনা শেষ করে এরই মধ্যে আমরা সুপারিশ লেখা শুরু করেছি। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা কাজ শেষ করতে পারব। ৭ জানুয়ারি সরকারের কাছে জমা দেওয়ার সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে। 

খবরের কাগজ: কমিশনের পক্ষ থেকে মতামত সংগ্রহের ধাপগুলো কী ছিল। এ পর্যন্ত কতজন মতামত ও মন্তব্য পাঠিয়েছেন?

ড. আলী রীয়াজ: কমিশনের ওয়েবসাইটে গত ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৫০ হাজার ৫৭৩ জন মতামত দিয়েছেন। গত ৫ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এ বিষয়ে খানা জরিপ পরিচালিত হয়। তাতে মতামত দিয়েছেন ৪৫ হাজার ৯২৪ জন। ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৫টি রাজনৈতিক দল এবং ৩টি রাজনৈতিক জোটের মতামত এসেছে। ৭ জন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ৪৩টি সংগঠনের অংশীজন, ১০ তরুণ চিন্তাবিদের সঙ্গে সভা করে মতামত নিয়েছি।

খবরের কাগজ: সংবিধান সংস্কারকাজে আপনাদের কাজের ধাপগুলো কেমন ছিল?

ড. আলী রীয়াজ: আমরা দুভাগে কাজটি করছি। একটি পর্যালোচনা, অন্যটি সুপারিশমালা তৈরি। পর্যালোচনায় নিজেদের সংবিধান ছাড়া আরও ১২০টি দেশের সংবিধান আমাদের গবেষণা টিম পর্যবেক্ষণ করেছে। এর মাধ্যমে বিগত ৫২ বছরে আমাদের সংবিধানের দুর্বল ও সবল দিকগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা আমরা করেছি। অংশীজনদের কাছ থেকে সংগৃহীত মত এবং কমিশনের সব সদস্যের মত একত্রিত করে সুপারিশ তৈরি করা হচ্ছে। জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সুপারিশমালায় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আমাদের লক্ষ্য, সংবিধানকে গণতান্ত্রিক ডকুমেন্টে পরিণত করা, তার যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করা, ক্ষমতা যাতে এককেন্দ্রীকরণ না হতে পারে সেসব বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। আমাদের সুপারিশে কোনো সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হবে না। সরকার সেগুলোকে একসঙ্গে নাকি পর্যায়ক্রমে- কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করবে, সেটা তারা নির্ধারণ করবে। 

খবরের কাগজ: কমিশনের সুপারিশমালায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে কোন কোন বিষয়?

ড. আলী রীয়াজ: অংশীজনদের মতামত প্রাধান্য দিয়ে আমরা গণতান্ত্রিক ও নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা হবে এমন কিছু বিষয়কে সংস্কারে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তার মধ্যে রয়েছে- ক্ষমতার ভারসাম্য, পঞ্চদশ সংশোধনী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, আনুপাতিক হারে ভোটের বিধান দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শাসনকাল, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো, বাহাত্তরের সংবিধান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ও ক্ষমতায়ন, গণভোট প্রভৃতি। বিশেষ করে সংসদ সদস্যদের সর্বোচ্চ বয়সসীমা কমিয়ে আনার পক্ষে আমাদের সুপারিশ থাকবে। কারণ কমিশন মনে করে, বর্তমান বাংলাদেশে সংসদে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো প্রয়োজন। তারা যাতে সংসদে তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এ জন্য তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর পক্ষে মত দেব।
 
খবরের কাগজ: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে কমিশনের বিশ্লেষণ কী?

ড. আলী রীয়াজ: অতীতে এ দেশে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো নজির আমরা দেখিনি। সেগুলোতে জনমতের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। প্রতিটিতে অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতাসীন দলই বিজয়ী হয়েছে। কাজেই দেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আমি মনে করি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিকল্প নেই। 

খবরের কাগজ: সম্প্রতি আপনি বলেছেন ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবেন। সে বিষয়ে পরিকল্পনা কত দূর এগিয়েছে?

ড. আলী রীয়াজ: ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানকে কোনোভাবেই তো অস্বীকার করা যাবে না। আজ রাষ্ট্র সংস্কারে এতগুলো কমিশন হয়েছে তার সবই সম্ভব হয়েছে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে। কাজেই আমরা চাই সংবিধানে এর স্বীকৃতি থাকতে হবে। সেটা কীভাবে কোন স্থানে সংযোজন করা হবে, তা এখনো আমরা জানি না। তবে কোনো না কোনো উপায়ে এই বিষয়টা যাতে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় আমরা সেই সুপারিশ রাখব। একই সঙ্গে এই গণ-অভ্যুত্থান ঘিরে দেশবাসীর যে আকাঙ্ক্ষা তার প্রতিফলন সংস্কারের বিভিন্ন সুপারিশে উল্লেখ করা হবে।

খবরের কাগজ: যতগুলো ধাপে সংবিধান সংস্কারের মতামত এসেছে তাতে সংবিধান কি পুনরায় লিখতে হবে, নাকি কিছু সংযোজন-বিয়োজন করলেই চলবে বলে আপনি মনে করেন? 

ড. আলী রীয়াজ: সেটা আমাদের আওতার মধ্যে পড়ে না, সংবিধানের খসড়া আমরা তৈরি করছি না। সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কাজেই কমিশন সে বিষয়ে সুপারিশও দেবে না। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সংবিধান পর্যালোচনা, সারাংশ নির্ধারণ ও যৌক্তিক কিছু সুপারিশ তৈরি করা। আমরা সেই সব সুপারিশ সরকারকে দেব। আমাদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। পরে সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে তারা সংবিধান পুনর্লিখন করবেন না সংযোজন-বিয়োজন করে সংশোধনী এনে সংকট সমাধানের পথ খুঁজবেন, অগ্রসর হবেন- সেটা তাদের সিদ্ধান্ত।

খবরের কাগজ: বিগত দিনে এ দেশের সংবিধান ১৭ বার পরিবর্তন হয়েছে। সেসব পরিবর্তন কী কারণে করা হয়েছে বলে মনে করছেন?

ড. আলী রীয়াজ: কমিশনের পর্যালোচনা বলছে, শুরু থেকে এ পর্যন্ত সংবিধানে যতগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে তার গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তি কেউ দেখাতে পারেনি। মূলত ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সংবিধান বারবার সংশোধন করা হয়েছে। সেগুলোতে নাগরিক অধিকার ও জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। সংসদীয় ব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা যেমন প্রবর্তন করা হয়েছিল, অন্যদিকে দুবার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। আমি বারবার বলেছি, চলমান সংবিধানে একনায়কত্ব কায়েমের পথ আছে। আর এ কারণেই সংবিধানকে সামনে রেখেই এ দেশে বারবার একনায়কত্ব ও এক ব্যক্তির শাসন চলেছে। যার ফলাফল সুখকর ছিল না। এসব কারণে রাষ্ট্রপতির মেয়াদকাল দুই বছর বহাল থাকলেও পরিবর্তন আসতে পারে প্রধানমন্ত্রীর শাসনকালের মেয়াদে। 

খবরের কাগজ: সংবিধান বারবার পরিবর্তন করা কতটা যৌক্তিক?

ড. আলী রীয়াজ: কোনো সংবিধান পারফেক্ট নয়, এটা কোনো ঐশীবাণী না, এটা জনগণের আকাঙ্ক্ষার ফসল, রাষ্ট্রের জন্য দিকনির্দেশনা। রাষ্ট্র ও জন-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তা পরিবর্তন হতেই পারে। এক-তৃতীয়াংশ সংবিধান আপনি বদলাতে দেবেন না- এটা নৈতিক, আইনি, রাজনৈতিক কোনো দিক থেকেই সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আর সেটাই করা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। কাঠামোগত ও মর্মবস্তুর দিক থেকে আমি মনে করি, এ দেশের সংবিধান দুবার পুনর্লিখন হয়েছে। তার একটি হলো ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে চতুর্থ সংশোধনী, যা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। অপরটি ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের খোলনলচে পাল্টে দেওয়া হয়েছে। বলা যায়, ওই দুটি সংশোধনীর মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে একদলীয় শাসনব্যবস্থা ও জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে, যা এ দেশের মানুষ গ্রহণ করেনি।

খবরের কাগজ: ১৯৭২ সালের সংবিধানকে অনেকেই সর্বজন গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করে থাকেন। আপনার বিশ্লেষণ কী?

ড. আলী রীয়াজ: আমি তা মনে করি না। বাহাত্তরের সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়াই ছিল ত্রুটিপূর্ণ। কারণ জরুরি অবস্থার সময় যেভাবে গণপরিষদ তৈরি করা হয়েছিল, তা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বেশির ভাগ প্রতিনিধিত্ব ছিল একটি দলের। মাত্র তিনজন ছিলেন অন্য দলের। ফলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতের প্রতিফলন তাতে ছিল না। এ ছাড়া কন্টেন্টের দিক থেকেও বাহাত্তরের সংবিধানের নাগরিকদের অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে। 

খবরের কাগজ: সংবিধানে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের প্রাধান্য থাকা বা রাষ্ট্রধর্ম নির্ধারণ করে দেওয়াকে আপনি কীভাবে দেখেন? 

ড. আলী রীয়াজ: আমি মনে করি, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থা বিরাজমান। সেটা ধর্মের দিক থেকে, নৃতাত্ত্বিকভাবে, বিশ্বাসের দিক থেকে। তাই শব্দের বিচার-বিবেচনায় না জড়িয়ে বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থাকে সংরক্ষণ করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আর সে জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তা সরকারকে করতে হবে। আমাদের এমন সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়া দরকার, যেখানে বহুত্ববাদী এই সমাজে সবার অধিকার রক্ষিত হবে।    

খবরের কাগজ: শত ব্যস্ততার মধ্যেও মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. আলী রীয়াজ: খবরের কাগজ পরিবারের জন্য শুভ কামনা করছি।