আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ৪০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সাফল্য অর্জন করে আসছে। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে লোকসান করেনি। এর মূল কারণ করপোরেট সুশাসন। এ ছাড়া গ্রাহক বাছাই করার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম নীতি। আইডিএলসির বর্তমান পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আর্থিক খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এম জামাল উদ্দিনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এম মনিরুল আলম।
খবরের কাগজ: আইডিএলসির সবচেয়ে ভালো দিকটি তুলে ধরুন।
এম জামাল উদ্দিন: প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই করপোরেট সুশাসন আমাদের একটি বেস্ট প্র্যাকটিস। তখন প্রমোটর ও শেয়ারহোল্ডার ছিল বিশ্বব্যাংকের আইএফসি (ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন) এবং একটি কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান। শেয়ারহোল্ডার পরিচালকরা তাদের আন্তর্জাতিক মানের অভিজ্ঞতা এই প্রতিষ্ঠান গড়তে কাজে লাগিয়েছেন। ফলে সব সময় একটি টেকসই প্রবৃদ্ধি ও প্রত্যাশিত মুনাফা করতে পেরেছে। প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠা করা হয় আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা। পরিচালনা পর্ষদের কেউ আর্থিক ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করেননি। আমি তো শুরু থেকেই এই প্রতিষ্ঠানে আছি। ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি থেকে আজ আমি এ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে। এখনো আমি প্রথমদিনের মতো নিজেকে এ প্রতিষ্ঠানের কর্মী মনে করি। আমি এও বলতে পারি, কোনো পরিচালক বা পর্ষদের কেউ কোনো দিন বলেননি ‘ওর ঋণ আবেদনটা দেখো বা আমি একটা লোক পাঠালাম চাকরিটা দিও’।
খবরের কাগজ: আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজনেস মডেল সম্পর্কে বলবেন কি?
এম জামাল উদ্দিন: আইডিএলসি শুরু থেকেই করপোরেট ফোকাসড-২০০৬ সালে এসএমই খাতের দিকে নজর দেওয়া হয়। কোনো গ্রাহক আমাদের কাছে এলে দ্রুত অ্যাসেসমেন্ট প্রসেস সম্পন্ন করা হয়। ঋণ পাওয়ার উপযোগী হলে গ্রাহককে তা জানিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া হয়। আর অ্যাসেসমেন্ট প্রসেসে কোনো সূচকে গ্রাহক কোয়ালিফাই না করলে সেটাও তাকে দ্রুত জানানো হয়। আমরা গ্রাহকের সময় নষ্ট করি না। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমরা গ্রাহকের যত্ন নিই, পরামর্শ দিই ও নিয়মিত তদারকি করি।
খবরের কাগজ: ঋণ আবেদনকারীর অ্যাসেসমন্ট করতে কোন সূচককে আপনার প্রতিষ্ঠান বেশি গুরুত্ব দেয়?
এম জামাল উদ্দিন: অন্য সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের মতো আমরাও ঋণ আবেদনকারীর ব্যবসার সম্ভাবনা দেখি, ঋণ ফেরত দেওয়ার আগ্রহ ও সক্ষমতা যাচাই করি। সবচেয়ে বেশি যেটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, তা হলো তার ব্যবসা বা উদ্যোগের পরবর্তী নেতৃত্ব বা উত্তরাধিকারী দেখি।
খবরের কাগজ: তৃণমূলের গ্রাহকদের জন্য আপনাদের কোনো সৃজনশীল সেবা আছে কি?
এম জামাল উদ্দিন: আমরা সব সময়ই সেবার ক্ষেত্রে সৃজনশীল ধারণায় বিশ্বাস করি। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বিকাশের সঙ্গে আমরাই প্রথম সঞ্চয় স্কিম চালু করি, যাতে তৃণমূল থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। এরপর অন্যরাও এই সেবা নিয়ে এসেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা পাইওনিয়ার বা পথিকৃৎ।
খবরের কাগজ: আর্থিক সেবা পেতে এসএমই উদ্যোক্তারা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে থাকে?
এম জামাল উদ্দিন: এসএমই উদ্যোক্তাদের বড় অংশই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এদের যথাযথ জামানত দেওয়ার সক্ষমতা থাকে না, ট্রেড লাইসেন্স ও লেনদেনের রেকর্ড থাকে না, যেগুলো অ্যাসেসমেন্ট করতে প্রয়োজন হয়। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তো তার বিনিয়োগের অর্থ মুনাফাসহ ফেরত পাওয়ার গ্যারান্টি চায়। অধিকাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রেন্টেড প্লেস বা ভাড়া করা স্থানে ব্যবসা করে। তাদের স্থায়িত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়তা থাকে না। এই সমস্যাগুলো রয়েছে।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের সহায়তা করতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করেছে। তারপরও উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না কেন?
এম জামাল উদ্দিন: ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম একধরনের নিরাপত্তা। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়ে তা উদ্ধার করতে না পারলে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই টাকা পরিশোধ করবে। এটি সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একধরনের স্টিমুলাস স্কিম, যা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু উদ্যোক্তার মানসিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সেই সুযোগটা নিয়ে যদি ব্যবসা ফেলে যান, তাহলে কী হবে? বারবার একই ধরনের ঘটনা ঘটলে সেটা খুব খারাপ নজির তৈরি করবে। তা ছাড়া এ ধরনের ঘটনায় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে হয়রানি হতে হবে। সময় ও আর্থিক ক্ষতিও আছে। কারণ প্রতিটি ঋণগ্রহীতার পেছনে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সময় ও অর্থ বিনিয়োগ রয়েছে।
খবরের কাগজ: নিয়ন্ত্রক সংস্থার দিক থেকে আর্থিক খাতের চ্যালেঞ্জ কী কী বলে আপনি মনে করেন?
এম জামাল উদ্দিন: একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয়, তা হলো শ্রেণীকৃত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ। এই প্রভিশন তুলনামূলক বেশি। এ কারণে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান মুনাফা দেখাতে পারছে না। এ ছাড়া বিনিয়োগযোগ্য তারল্য বা পরিচালন ব্যয় নির্বাহে অর্থ থাকছে না। আর্থিক প্রতিষ্ঠান তো বিনিয়োগ করেই আয় করে। তা যদি নাই করতে পারে তাহলে আয় হবে কী করে? আমাদের প্রতিষ্ঠান কিন্তু ব্যতিক্রম। আমাদের এই চাপ নেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানের তা নেই।
খবরের কাগজ: আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অসতর্কতা আছে বলে মনে করেন কি আপনি?
এম জামাল উদ্দিন: আমি তা মনে করি না। কারণ, কে কী উদ্দেশ্যে লাইসেন্স চাইছে তা তো বোঝা মুশকিল। রাজনৈতিক ব্যক্তি উদ্যোক্তা হলেই যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি খারাপ হয়ে পড়বে, সেটা মনে করা ঠিক নয়। আসলে উদ্যোক্তাদের মিশন-ভিশন থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো চললে তা একসময় দাঁড়াবেই।
খবরের কাগজ: আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করছেন এবং ভবিষ্যতে যারা কর্মী হতে ইচ্ছুক তাদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?
এম জামাল উদ্দিন: যারা চাকরি করছেন, তাদের আমি বলব- গ্রাহককে নিজ ঘরের মেহমান হিসেবে দেখবেন। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আপনার কাছে গেলে যেই সম্মান ও সেবা আপনি দিয়ে থাকেন একজন গ্রাহককে সেই সম্মান ও গুরুত্ব দিয়ে সেবা দিতে হবে। ভবিষ্যৎ কর্মীদের জন্য আমি বলব, যেই প্রতিষ্ঠানের জন্য আপনি কাজ করবেন তার স্বার্থের প্রতি যত্নবান হবেন। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন। প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রতি সম্মান দেখাবেন। এটি পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার স্থান। পরিশ্রম করলে খুব শিগগির উন্নতি হবে ক্যারিয়ারের।