কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িকে বাঙালি নারীর ফ্যাশনের সূতিকাগার বলা যায়। এই বাড়ির আধুনিকতা কেবল পোশাক-আশাক বা সাজসজ্জায় যে সীমাবদ্ধ ছিল তা কিন্তু না। বরং তাদের এই আধুনিকতার ছোঁয়া আমরা দেখতে পাই শিক্ষা এবং নারী জাগরণের ক্ষেত্রেও। বর্তমান সময়ে এসে যে কেউই ঠাকুরবাড়ির সাজসজ্জার সঙ্গে এখনকার সাজসজ্জার মেলবন্ধন ঘটিয়ে সাজে আনতে পারেন ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মিশেল। পোশাকে রাবীন্দ্রিক সাজ নিয়ে লিখেছেন মেরিনা আহমেদ
শাড়ির ইতিহাস মূলত মোঘল আমলেই গুরুত্ব পায়। ওই সময় তাঁতিরা শাড়ির বুননে নিজেদের পুরো মনঃসংযোগ একত্র করে বুনে চলেন একের পর এক নানা ধরনের শাড়ি। ফলে শাড়ির বুননেও আসে বৈচিত্র্য। কিন্তু নারীরা আধুনিক শাড়ি পরার চলন, ঢং শিখেছেন মূলত ঠাকুরবাড়ির কল্যাণে। সামনে কুচি দিয়ে পেছনে আঁচল দিয়ে শাড়ি পরার কৌশল তারাই শুরু করেন। এরপর সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শাড়ি পরার ধরন-ধারণও পাল্টেছে বহুরূপে। যেমন, শাড়ির আঁচল ছোট করে পরা, হাতকাটা ব্লাউজে সামনে আঁচল দিয়ে শাড়ি পরা, এক প্যাঁচে বা খোলা আঁচলের স্টাইলসহ আরও নানা স্টাইলে এখন মেয়েরা শাড়ি পরে ।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা সেই সময়ে অন্দরমহল থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছিলেন, মিশতে শুরু করেছিলেন বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে। তাই তাদের সবকিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছিল। এ কারণেই আমরা তাদের শাড়ি পরার স্টাইলের মধ্যেও খুঁজে পাই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশেল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঠাকুরবাড়ির একটি ঐতিহ্য ছিল বিয়ের সময় পুরুষর্ একটি কালো বেনারসি শাল গায়ে চাপিয়ে তবেই বিয়ে করতেন, যা স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন। কালো রংকে সব সময় বিয়ের আয়োজন থেকে শত হাত দূরে রাখলেও ঠাকুরবাড়িতে ঘটেছিল ঠিক উল্টোটিই। আর এভাবেই ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য আর আধুনিকতা এখন পর্যন্ত মিলেমিশে চলে আসছে আমাদের সমাজেও।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা সে সময় বিয়ের সাজে পরতেন একহারা ঢঙে শাড়ি। কখনো সেই শাড়ি কোমরে স্কার্ট বা লেহেঙ্গার মতো গুঁজে দিয়ে অনেকটা বিলেতি কেতায় পরা হতো। আবার সেসব শাড়ির আঁচলে দেখা যেত অনেক ভাঁজ। এই ভাঁজগুলো কাঁধের কাছে আটকে রাখা হতো ব্রোচ দিয়ে। চিত্রা দেবের লেখা ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল বইটিতে বিয়ের যে ছবিগুলো আছে, তার সব কটিই মূলত মসলিন, বেনারসি বা ঢাকাই শাড়ি পরা কনের ছবি। এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, ঠাকুরবাড়িতে বুনন-বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ শাড়ির চলই বেশি ছিল। আর সেই ঐতিহ্য মাথায় রেখে আমরা এখনকার বিয়েতে ব্যবহার করতে পারি জামদানি শাড়ি। লাল, সোনালি, কোরা রঙের জামদানি শাড়িতে জরির কাজ আর তার সঙ্গে মানানসই ওড়না বিয়েতে অনায়াসে আনতে পারে ঠাকুরবাড়ির বউদের সাজসজ্জার ছোঁয়া। ব্লাউজে লম্বা হাতায় লেইসের ব্যবহারে আসবে রাবীন্দ্রিক ঢং।
আবার জামদানির বাইরে গিয়ে কনেরা মসলিনের শাড়ি পরেও আনতে পারবেন একই ধরনের লুক। ঠাকুরবাড়ির বিয়ের সাজগুলো ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তাদের বিয়ের সাজসজ্জায় আভিজাত্যের পাশাপাশি রুচির ছাপও ছিল যথেষ্ট মাত্রায়। সেই সময়ে তাদের মধ্যে সাজসজ্জার যে চল ছিল, তা আমরা এখনো নিয়ে আসতে পারি আমাদেরই বৈচিত্র্যপূর্ণ শাড়িগুলোর মাধ্যমে। এই ফ্যাশনে যেমন রুচির পরিচয় দেওয়া যায়; তেমনি বিয়ে আয়োজনের আড়ম্বরে নিজের আরামকেও প্রাধান্য দেওয়া সম্ভব। গহনার ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রাধান্য ছিল সোনার পেটানো গহনার। গলায় কয়েক লহরের চেইন, সীতাহার, চোকার এবং কানে ঝুমকার চেয়ে বেশি চোখে পড়ত কানজুড়ে থাকা দুল বা লম্বাটে নকশার কোনো দুল। সোনা ছাড়া গহনার নকশায় মুক্তোর ব্যবহারও দেখা গেছে। হাতভর্তি সোনার চুড়ি, সেই সঙ্গে গোলাপবালাও। বাহুতে বাজুবন্ধের ব্যবহারও ছিল লক্ষ্যণীয়।
সে সময়ে অনেক বেশি গহনার ব্যবহার দেখা যেত চুলের সাজে। বেণি করে সেই বেণি পেঁচিয়ে খোঁপায় বেঁধে ছোট ছোট সোনালি কাঁটায় খোঁপা সাজানো যেতে পারে। সেই সময়ে টিকলির পাশাপাশি দুই পাশে গোল এক ধরনের গহনা লাগানো হতো। সেগুলোও ব্যবহার করা সম্ভব। কনে সাজের বিষয়ে চিত্রা দেব তার ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে লিখেছেন ‘সোনালি ফিতে লাগিয়ে খোঁপায় সোনার কাঁটা ও চিরুনি, কপালে ও গালে চন্দনের পত্রলেখা। লাল টুকটুকে বেনারসির সঙ্গে টিকলি, দুল, নথ, বাজুবন্ধ, শাঁখা, চুড়ি, বালা, আলতা পরা পায়ে রুনুঝুনু মল, হাতে লাল লক্ষ্মীকাঠের চুড়ি-এমনই ছিল কনের সাজ।’
রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বলেন, ‘একটা সময় কনেকে অনেক বেশি মেকআপ দেওয়া হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই এই সাজে এসেছে ভিন্নতা। এখনকার কনেরা মেকআপ পছন্দ করে, তবে তাতে থাকতে হবে সাধারণত্ব। চুলের বাঁধন কিংবা মেকআপ যাই হোক, তাতে চাই পুরোনো ঢঙের ছোঁয়া। আর এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ঠাকুরবাড়ির সাজসজ্জাই সবার পছন্দ। উঁচু করে চূড়োর খোঁপা বা বেণি খোঁপা, সামনে ঢেউখেলানো চুলের বাঁধন- সবই যেন ঠাকুরবাড়ির কনেদের সাজসজ্জা মনে করিয়ে দেয়। এই সাজের সার্থকতা তখনই পাওয়া যায়, যখন মসলিনের ওড়নার ফাঁকে চেলি করা খোঁপায় দেখা যায় আভিজাত্যের ছোঁয়া’।
টিপস
• মেকআপের আগে ফেশিয়াল করতে পারলে ভালো। সম্ভব না হলে ফেশিয়াল মাস্ক লাগাতে পারেন।
• স্কিনের ন্যাচারাল টোন বজায় রাখুন। মেকআপের বেস ভালো করে করুন।
• নিজের মুখের সবচেয়ে সুন্দর অংশটি হাইলাইট করুন। আইলাইনার ও মাসকারা অন্যভাবে ব্যবহার করে চোখের অন্যরকম শেপ দিতে পারেন। ব্লাশন দিয়ে চিকবোন হাইলাইট করতে পারেন।
• ত্বকের যে অংশে কালার লাগাচ্ছেন সেই অংশের ভাঁজ, রেখার সঙ্গে কালার যেন ভালোভাবে মিশে যায়। একই সঙ্গে মেকআপ ন্যাচারাল ও ড্রামাটিক হবে।
ডিজাইনার ভাবনা
নন্দিত ফ্যাশন ডিজাইনার ও ফ্যাশন হাউস বিশ্বরঙের কর্ণধার বিপ্লব সাহা বলেন, আধুনিক বাঙালি হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না। সর্বযুগের সেরা আধুনিক বাঙালি তিনি। আমরা পাশ্চাত্যের হাওয়ায় গা ভাসাই ঠিকই, তবে সত্যিকার বাঙালির আভিজাত্য প্রকাশ করতে চাইলে তার সান্নিধ্যে যেতেই হবে। শুধু তিনিই নন, ঠাকুরবাড়ির প্রতিটি সদস্যই ছিলেন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। প্রত্যেকেরই গল্প আছে, গান আছে এবং সব কিছুতেই তাদের ব্যাপক অবদান আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা-বাবা সবাই বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলেছিলেন। চলচ্চিত্র, চিত্রকলাসহ বাঙালির সব জায়গায় তারা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন।
তিনি আরও বলেন, বাঙালির সেই সময়ের ফ্যাশন আবার ফিরে আসুক। আমরা চাই আমাদের ফ্যাশনের মধ্য দিয়েই আমাদের আধুনিকতাকে প্রকাশ করি। আর সেই জন্য ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে যারা বাস করতেন তাদের সাজ-পোশাক, তাদের জ্ঞান, শিক্ষা সব কিছু যেন আমরা ধারণ করতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্রনাথ আমার ওপর প্রভাব ফেলেছেন। আমি তার কবিতা ও বই পড়ি, তার গান শুনি, তার সাজ-পোশাক, ফ্যাশন অনুসরণ করি। ব্যক্তিগতভাবে আমি রবীন্দ্রনাথকে একজন স্টাইল আইকন হিসেবেই বুঝি। একজন বাঙালি হিসেবে তার জন্মদিন কিংবা মৃত্যুদিন মনে রাখা আমাদের কর্তব্য। তাকে নিয়ে প্রচুর কাজ করার সুযোগ আছে। যার যার মাধ্যম থেকেই তাকে নিয়ে কাজ করা উচিত।
কলি