পাখির চোখে ফসলের মাঠ। জ্যামিতিক আলপথ ভাগ করে সে জমিন- আয়ত, বর্গ, রম্বস, ত্রিভুজ; আরও কত বিচিত্র ভঙিমায়। ভাগে ভাগে, সবুজ-হলুদ রঙের ছড়াছড়ি। যেন বিস্ময় জাগানিয়া কম্পোজিশন দেখছি। সেই সবুজ-হলুদ ধানখেত একদিন সোনালি হয়। আনন্দে কৃষক মাঠে নামে কাস্তে হাতে। রাশি রাশি কাটা ধানের আঁটি, চিত হয়ে শুয়ে থাকে ক্যানভাসজুড়ে। ঠিক ধানের আঁটি নয়, কোনো মহান শিল্পীর দক্ষ হাতে দেওয়া ব্রাশের স্ট্রোক থেকে বেরিয়ে আশা যেন আলোর স্ফুরণ। একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে ভারা ভারা সেই ধান তুলে নিতে নৌকা নয়, হাজির হয় পাওয়ার টিলার। ফসল ভরে ঘরে ফেরার পথে, যান্ত্রিক টিলারের চাকা শূন্য মাঠে এঁকে দেয় আশ্চর্য ফুল। আবারও বিভ্রান্তিতে পড়ি, এটা কোনো ফটোগ্রাফ নাকি শিল্পীর আঁকা চিত্রকর্ম?
বলছিলাম মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান, আমাদের কাছে যিনি মুস্তাফিজ মামুন নামে অধিক পরিচিত। সেই মামুনের ক্যামেরায় মন ভালো করে দেওয়া কিছু ছবির কথা। দুই যুগ ধরে তার তোলা ছবির আমি একজন অনুরাগী । সুযোগ হয়েছে তাকে খুব কাছে থেকে দেখার, ছবির নানা দিক নিয়ে আলোচনার। শুরুতে যে ধানখেতের ছবির কথা বলেছি। চোখ বন্ধ করলে মুস্তাফিজের তোলা নানা বিষয়ে এমন অসংখ্য ছবি আমার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। প্রকৃতি, সংস্কৃতি, পরিবেশ, উৎসব, বিনোদন, জীবনযাপন থেকে শুরু করে ওয়াইল্ডলাইফ, প্রত্ন বা শ্রমজীবী মানুষের মুখ- তার ক্যামেরার চোখ খুঁজে ফেরে নান্দনিক কোণ; আলোছায়ার শৈল্পিক খেলা।
মোস্তাফিজুর রহমান পেশায় ফটোজার্নালিস্ট। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বিডিনিউজ২৪ ডটকম-এর ফটোগ্রাফি বিভাগের প্রধান হিসেবে। কাজ করেছেন জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলেতেও। পেশাগত কারণে তাকে প্রতিনিয়ত ছুটতে হয় সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতির নানা অসংগতি বা নেতিবাচক ঘটনা-দুর্ঘটনার পেছনে। সেদিক থেকে খুব স্বাভাবিকভাবেই তার ক্যামেরার লেন্স নেতিবাচক দিকগুলোয় স্থির হয়ে যাওয়ার কথা। পূর্বসূরি অনেক ফটোসাংবাদিক এটাই করেছেন। পেয়েছেন জাতীয়, আন্তর্জাতিক পুরস্কার, এসেছেন আলোচনায়, হয়েছেন বিখ্যাত। ব্যক্তি ফটোগ্রাফারের এসব অর্জনের মধ্যে বিশ্বপরিচয়ে বাংলাদেশের গলায় ঝুলেছে নেতিবাচকতার তকমা। মুস্তাফিজ পূর্বসূরিদের সহজ সে পথে হাঁটেননি।
যদিও তার লেন্স বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি কোণায় এবং জীবনের প্রায় সব দিকেই ছুঁয়ে গেছে, কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধে উঠে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন বাংলাদেশের সৌন্দর্যে। ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ তার সিগনেচার, যা তার বৈচিত্র্যময় ছবির বিশাল সংগ্রহে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। আর এই দিয়েই এখন পর্যন্ত অর্জন করেছেন ৫০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা, একই সঙ্গে বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে চলেছেন নান্দনিক এক বাংলাদেশের।
তার অর্জন করা উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হলো- রিডার্স ডাইজেস্ট ‘আনসিন এশিয়া’ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক ‘কনসালটেটিভ গ্রুপ টু অ্যাসিস্ট দ্য পুওর’ (সিজিএপি) পুরস্কার, ইউএসএইডের এগ্রিলিংকস ফটো অ্যাওয়ার্ডস, শ্রীলঙ্কার সার্ক কালচারাল সেন্টার থেকে ‘সার্ক ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড’, যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের ‘ম্যানগ্রোভ ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড’, ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফিক স্যালন অব জাপান (আশাহি শিম্বুন পুরস্কার), ইতালির ‘সিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল ফটো অ্যাওয়ার্ড’, যুক্তরাজ্যের ‘পিংকলেডি ফুড ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার’, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল ফটো অ্যাওয়ার্ড’, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ফটোগ্রাফি পুরস্কার ইত্যাদি।
আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি মুস্তাফিজের ক্যামেরায় রাতের এক্সপেসওয়ে ঘন অন্ধকার ভেদ করে কীভাবে আলোর ফোয়ারা হয়ে জ্বলতে থাকে। চমকে উঠি যখন দেখি আভিজাত্যের নীলে মোড়া ঢাকার গুলশান চত্বরের সড়কগুলো ছুটতে থাকে সোনালি আলোর রেখায়। আনন্দে অভিভূত হই কীর্তনখোলার বুকে বাহারি রঙের পাল তোলা ডিঙি নৌকা কিংবা জেলেদের মাছ ধরা দেখে। স্থির করে দেয় ভাসমান খেত অথবা সুগন্ধা নদীর বুকে কমলা রঙের সূর্যাস্ত। জলে স্থলে আকাশে কী তীব্র কমলা রং ছড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। আহা জীবনানন্দ, তুমি বুঝি দেখে ছিলে বাংলার এই রূপ- নদী মাঠ খেত।
দিগন্তজোড়া সাগরসৈকত, পাহাড়ের বুক বেয়ে নেমে আসা উচ্ছল ঝর্ণাধারা কিংবা গোছানো সবুজ চা-বাগান- এ তো আমারই বাংলাদেশ। আর সবুজ ঢেউ খেলানো ধানখেতের মাঝে বুড়ো নিঃসঙ্গ শিমুল ফাল্গুনে যখন ফুলে ফুলে লাল হয়ে ওঠে মুস্তাফিজের ক্যামেরায় সেটা শুধু ধানখেতে শিমুলগাছ থাকে না, হয়ে ওঠে আমাদের লাল-সবুজের পতাকা।
সুন্দরবন মুস্তাফিজের অন্যতম আগ্রহের জায়গা। বন কেন্দ্রিক মানুষের জীবিকা, বনের প্রকৃতি, গাছপালা, প্রাণীকূল, খাল, নদী ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। সেই রং ধরে রাখতে মুস্তাফিজ বারবার যান সুন্দরবন। সৌন্দর্যে অভিভূত হলেও চোখে এড়ায় না বনের দূষণ। নদী ও খালের দূষণ- পানিতে ভেসে থাকা তেলের কালো কালো ছোপ বা প্লাস্টিক ধরা পড়ে তার ক্যামেরায়। বনের দিগন্ত ছোঁয়া সবুজের মাঝে বিশালাকৃতির গাছটির বিবর্ণ হয়ে যাওয়াও প্রশ্ন রেখে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনে বেড়েছে ঘূর্ণিঝড় প্রবণতা। সেই ঝড় বুক দিয়ে আগলে দিতে কীভাবে বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সুন্দরবন- কোথাও ডালপালা মুড়ে গেছে, কোথাওবা সমূলে উপড়ে গেছে গাছ।
মুস্তাফিজের ক্যামেরা সবকিছুকেই ধারণ করেছে সযত্নে। তিনি অংশ নিয়েছেন দেশ-বিদেশের বেশ কিছু প্রদর্শনীতে। উল্লেখযোগ্য প্রদর্শনীর মধ্যে রয়েছে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ইতালির মিলানে অনুষ্ঠিত মুস্তাফিজের একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী। যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে মেক্সিকো সিটির রিফার্মা অ্যাভিনিউ, মেক্সিকোর কোলিমা ইউনিভার্সিটি, বাহরাইনের সিফ মল ও মল অব দিলমুনিয়াতে। এ ছাড়া দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশ, ইতালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, হংকং, তাইওয়ান, স্পেন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে। যার প্রধান বিষয় বাংলাদেশের সৌন্দর্য।
এই সৌন্দর্য ফ্রেমবন্দি করতে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, দিন কিংবা রাত, বছরের পর বছর মোস্তাফিজুর রহমান ছুটে চলেছেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সুন্দরবন থেকে জৈন্তা। মিশেছেন সেসব স্থানের মানুষের সঙ্গে। বোঝার চেষ্টা করেছেন এলাকাভেদে প্রকৃতি ও মানুষের ভিন্ন ভিন্ন বোঝাপড়া, সৌন্দর্য এবং টিকে থাকার সংগ্রাম। তার এই ঘুরে বেড়ানো নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে মুস্তাফিজ মামুন নামে অসংখ্য ভ্রমণ কাহিনি। প্রকাশিত হয়েছে ৪টি ভ্রমণ গ্রন্থ। ফটোগ্রাফির একটি অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছে ইতালি থেকে।
এক কাঁধে ক্যামেরা, অন্য কাঁধে ট্রাভেল ব্যাগ ঝুলিয়ে মুস্তাফিজের এই পথচলা দীর্ঘদিনের। শুধু প্রকৃতির রূপই দেখেননি। তার ফটোগ্রাফির বিষয়কে অনুভব করার চেষ্টা করেছেন পঞ্চ ইন্দ্রীয় দিয়ে। জেনেছেন, এলাকার মানুষের জীবনাচার, ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি। ২০০২ সালের ঘটনা।
মোস্তাফিজ তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ওকে সঙ্গী করে আমরা চারজন বেরিয়েছি। উদ্দেশ্য নওগাঁর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো ঘুরে দেখা। রাতের বাস ভোরে সান্তাহার ক্রস করে কেবল নওগাঁ ঢুকেছে। আধো ঘুমের মধ্যেই মোস্তাফিজ লাফ দিয়ে উঠলেন, ‘নওগাঁ চলে এসেছি’। কিছুটা বিস্মিত হয়েই জিজ্ঞেস করি, কীভাবে বুঝলেন? মোস্তাফিজ বললেন, প্রত্যেকটা জায়গার আলাদা আলাদা গন্ধ আছে। একটু খেয়াল করেন, ধান সেদ্ধর গন্ধ আসছে।
ঠিক তখন, আমিও সেদ্ধ ধানের গন্ধ পেলাম। রাস্তার পাশের রাইস মিলগুলো থেকে আসছে। আমি নওগাঁর মানুষ হয়েও বাতাসের যে গন্ধ আলাদা করে অনুভব করতে পারিনি, মুস্তাফিজ আগে কোনো একবার এসেই সেটাকে আলাদা করতে পেরেছে। এই অনুভূতির জন্যই বোধকরি তার ছবিও অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। যেমন আলাদা হয়ে যায় মোস্তাফিজের কোনো এক ব্রথেলে তোলা শিশুর ছবিটি। ব্রথেলে শিশু, বিষয়টি মোটেও সুখের নয়; বিষাদের। কিন্তু মুস্তাফিজের তোলা ছবির সেই শিশুর পেছনের দেয়াল লেখনী আমাদের ভাবনাকে অন্য জায়গায় গিয়ে নাড়া দেয়; সেখানে লেখা- ‘স-তে স্বপ্ন/ঘ-তে ঘুড়ি/ আমরা সকলে/ উড়ি উড়ি’।
মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ভ্রমণ বা ফটোগ্রাফি জীবন শুধু পেশা নয়, বরং এটি একটি আবেগ এবং দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রতিফলন। তার ক্যামেরায় বন্দি সুন্দর বাংলাদেশের প্রতিটি ছবি দেশের প্রতি তার ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার প্রদর্শন। তিনি তার কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপস্থাপন করছেন এবং দেশের সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য তুলে ধরছেন। তাই বুঝি তার ছবিতে ছড়ায় এ দেশের মাটির সুবাস।
কলি