নারীদের একটি অতি শখের প্রসাধনীর নাম লিপস্টিক। লিপস্টিক ব্যবহার করে না এমন নারী কমই আছেন। কত প্রসাধন সামগ্রী যুগে যুগে এসে যায় কিন্তু লিপস্টিক যেন তার জায়গায় অনড়। এই মেকাপ-পণ্যের রয়েছে আলাদা তাৎপর্য। লিপস্টিকের মধ্যে আবার লাল লিপস্টিক নারীদের কাছে আলাদা স্থান পায়। এমনকি ইতিহাসেও দেখা যায়, প্রাচীন মিসরের রানি ক্লিওপেট্রা নিজের ঠোঁটকে লাল রঙে সাজাতেন। যুগে যুগে প্রতিবাদের ভাষা বদলায়। সময়ের তাগিদে এক সময় লাল লিপস্টিক নারীদের প্রসাধনীসামগ্রী থেকে হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা। এই সম্পর্কে লিখেছেন সাজলিন মেহজাবীন চৌধুরী
সময়টা ১৯১২ সাল। নিউইয়র্ক সিটির ফিফ্থ এভিনিউয়ে অবস্থিত এলিজাবেথ আর্ডেনের স্যালুনের সামনে দিয়েই যাচ্ছিল ভোটাধিকারের দাবিতে মার্কিন নারীদের একটি মিছিল। আর্ডেন ছিলেন এই আন্দোলনের একজন কট্টর সমর্থক। আর এই আন্দোলনের চেতনা থেকেই তিনি একটি লাল লিপস্টিকের ডিজাইন করেছিলেন, যার নাম দেন ‘রেড ডোর রেড’। যুক্তরাজ্যের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে তখনো ৪৪ বছরের কম বয়সী কোনো নারীর লিপস্টিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ছিল।
এমন পরিস্থিতিতে নিজের স্যালুনের সামনে দিয়ে নারীদের মিছিলটি যাওয়ার সময় কয়েকজন নারীর ঠোঁটে প্রতিবাদস্বরূপ নিজের হাতে লাল লিপস্টিক মাখিয়ে দিয়েছিলেন আর্ডেন। এমনকি মিছিলে অংশ নেওয়া নারীদের একটি করে লিপস্টিক উপহার দিয়েছিলেন এলিজাবেথ আর্ডেন। এলিজাবেথ চেয়েছিলেন, লাল রংটি যেন মিছিলে অংশ নেওয়া নারীদের আশা, ক্ষমতা, শক্তি এবং পারস্পরিক আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। এবং আসলেই এটি মার্কিন নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। পরবর্তীতে এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়ই ১৯২০ সালে তারা ভোটাধিকার অর্জন করে। এখানেই শেষ নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে নারীদেরও নিয়োগ দেওয়া হয়। যারা বিভিন্ন ধরনের ‘ডেস্ক জবে’ কাজ করত।
এমনকি কিছু নারীর চাকরি হয় সমরাস্ত্র কারখানায়। তখন তাদের মধ্যে লাল লিপস্টিক ব্যবহারের চল ছিল অনেক বেশি। মূলত এটির মাধ্যমে তারা নারীদের স্বদেশপ্রেম প্রকাশ করতেন। এমনকি মনোবল চাঙা করতেও তারা লাল লিপস্টিক ব্যবহার করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খলনায়ক অ্যাডলফ হিটলার লাল লিপস্টিক একদম সহ্য করতে পারতেন না। তার কাছে লাল লিপস্টিক ছিল দুই চোখের বিষ। সে সময়ে জার্মানির বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনীর দেশগুলোতে এটি দেশাত্মবোধের পক্ষে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটি প্রতীক হয়ে ওঠে।
২০০৫ সালে ক্যানসারজয়ী নারী পরিচালক জেরালিন লুকাস একটি বই লেখেন। যেখানে তিনি ‘ম্যাসেকটমি’তে যাওয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন যখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। ম্যাসেকটমি হলো মূলত এমন একটি অস্ত্রোপচার, যার মাধ্যমে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের স্তন কেটে ফেলা হয়। জেরালিন লুকাস তার বইয়ের শিরোনাম দিয়েছিলেন, ‘হোয়াই আই ওর লিপস্টিক টু মাই ম্যাসেকটমি’। জেরালিন অস্ত্রোপচারে যাওয়ার আগে নিজের ঠোঁটগুলোকে লিপস্টিকে রাঙিয়ে নিয়েছিলেন। তার কাছে লাল লিপস্টিক হলো এমন একটি রঙ যা সাহসী নারীরাই ব্যবহার করেন।
প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে লাল লিপস্টিকের ব্যবহার এ যুগে এসেও চলমান। ২০১৫ সালে মেসিডোনিয়ায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে দাঙ্গা পুলিশের শিল্ডে এক নারীর চুমু খাওয়ার ছবি বেশ ভাইরাল হয়েছিল। লাল লিপস্টিক যেখানে বিদ্রোহের ভাষা প্রকাশ করেছিল। ২০১৮ সালে মধ্য আমেরিকার একটি ছোট রাষ্ট্র নিকারাগুয়ায়ও এই লাল লিপস্টিক নিয়ে একটি ঘটনা ঘটে। সেখানে সরকারবিরোধী আন্দোলনে গ্রেপ্তারদের মুক্তির দাবিতে নারীদের পাশাপাশি অসংখ্য পুরুষ ঠোঁটে লাল লিপস্টিক মেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন প্রতিবাদ হিসেবে। সেই আন্দোলনে মারলিন চাও নামের এক নারীকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। যাকে তখন জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময়টিতে তিনি তার ঠোঁট লাল লিপস্টিক দিয়ে রাঙিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন প্রায় ১০ হাজার নারী। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তাদের চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা ছিল। মাথায় ছিল লাল স্কার্ফ আর ঠোঁট রাঙিয়েছিলেন লাল লিপস্টিকে।
বর্তমান সময়ে এসেও লাল লিপস্টিকের মাহাত্ম্য এতটুকু কমেনি। নারীরা এখনো প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে লাল লিপস্টিকই ব্যবহার করছেন। ২০১৯ সালে র্যাচেল ফেল্ডার তার ‘রেড লিপস্টিক: অ্যান অডি টু আ বিউটি আইকন’ বইয়ে বলেছেন, ‘অনেকের কাছেই লাল লিপস্টিক একটি জোরালো সাংস্কৃতিক অস্ত্র। সংস্কৃতির ইতিহাস ও সমাজের যুগচেতনা বোঝার একটি সত্যিকারের চিহ্ন হয়ে আছে এটি।’
লাল লিপস্টিক নারীদের শুধু আত্মবিশ্বাসই বাড়ায়, এমনটা নয় বরং এর মর্ম লুকিয়ে আছে আরও গভীরে। ‘দ্য লিপস্টিক এফেক্ট’ নামে একটি অর্থনৈতিক তত্ত্বে মনকে চাঙা করতে লিপস্টিক যে ভূমিকা রাখে তা বর্ণনা করা হয়েছিল। আমেরিকার প্রসাধনী কোম্পানিগুলো দাবি করে, ২০০১ সালে নাইন-ইলেভেন হামলার পর দেশটিতে ব্যাপক হারে লিপস্টিকের বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল।
মার্কিন নারীবাদী ব্লগার ‘কেটি ভেলভেট’ বলেন, ‘লাল লিপস্টিক মাখলেই আমার মনে পড়ে সেই সব নারীর কথা, যারা একদিন ফিফ্থ এভিনিউয়ে কাঁপিয়ে ভোটের অধিকার দাবি করেছিলেন। মনে পড়ে সেই নারীদের কথা, বিশ শতকের গোড়ার দিকে যারা কর্তৃত্ববাদী সমাজব্যবস্থা এবং তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যাবতীয় অনাচারকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়েছিলেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নারীদের কথা মনে পড়ে, যারা শত্রুর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে বিজয়ের নিশানা এঁকেছিলেন।’
কলি