আগুন আছে? না চোখের জল? সে আগুন কি দহনের, শোকের? নাকি একটা শোককে উপলক্ষ্য করে শোককে পার হয়ে যাওয়ার? সে আগুন কি চিরবিদায়ের? নাকি তার মৃত্যু সেই উপলক্ষ্য, যার পরে তার কণ্ঠস্বর অনন্ত, অপরাজিত, সর্বব্যাপ্ত হয়ে উঠবে? যে মরদেহ আজ থেকে তিরাশি বছর আগে পৃথিবী আগুনের কাছে সমর্পণ করেছিল, আজ এই বাইশে শ্রাবণ সেই আগুনের স্মৃতি বহন করছে বটে, কিন্তু, তিনি যেমন বলেন মৃত্যু জীবনের একটা ছিন্ন মুহূর্ত মাত্র, আমাদের কাছে শেষ পর্যন্ত ব্যবহার্য থাকে যাপিত জীবন- মহৎ ও সুন্দরের প্রকাশে যে জীবনের সীমা-পরিসীমা নেই। এ দেশে, ও দেশে, পৃথিবীর মানুষের কাছে- যারা তাকে বাংলাভাষায় কখনো পাননি, কিন্তু নিজেদের ভাষায় পেয়ে, অবিশ্বাসী অনুবাদ-তত্ত্বকে হাস্যকর প্রমাণ করে, তাকে পেয়ে চলেছেন। সে এক অদৃশ্য, জীবন্ত, জীবনদায়ী উপস্থিতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাইশে শ্রাবণ সেই বিশাল অট্টালিকায় এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি। তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন, মানুষের জীবন অনন্ত ও প্রবহমাণ, একের জীবন সীমাবদ্ধ হলেও। এই জীবনে দুঃখ আছে, ক্ষতি আছে, ক্ষত আছে, কিন্তু তা ‘মিছে হতে মিছে- নিমেষের কুশাঙ্কুর- পড়ে রবে নীচে।’ ‘দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে, বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে... মরতে মরতে মরণটারে শেষ করে দে একেবারে। তার পরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে।’ ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব, ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।’
এ কি কেবল মুখের কথা- শুষ্ক স্তোক? কথার ছলনা? তা কেন হবে? তিনি নিজের জীবনেও তো নিজের কথাগুলো মেনে এসেছেন, ‘বুকের শিরা ছিন্ন করে’ জীবনের ‘ভীষণ পূজা’ করেছেন। কত দুঃখ, কত শোক পেয়েছেন- বজ্রাহত, কিন্তু অটল বনস্পতির মতো তা বহন করেছেন। শৈশবে মায়ের মৃত্যুশোক তিনি না-হয় বুঝতে পারেননি, কিন্তু সেই প্রথম যৌবনে বউঠান কাদম্বরীর আত্মঘাতের পর থেকে আত্মজন-বিয়োগের শোক তাকে প্রায় নিয়মিত এসে আঘাত করেছে। বিস্মিত হয়ে দেখি এই আশ্চর্য মানুষটি সমস্ত শোককে গ্রহণ করেন বর্মের ওপর শত্রুর নিষ্ফল অস্ত্রাঘাতের মতো অবলীলায়, অন্য মানুষ যাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত। সবচেয়ে প্রিয় পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে ছোট মেয়ে মীরাকে লেখেন, ‘শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই।’ এ কেমন লোক যে শোকে পৃথিবীর কাছে পাঠ নেয়, শোকের পর জ্যোৎস্নারাত্রি দেখে ভাবে যে, আমার এই পূর্ণতা থেকে কিছু শেখার আছে?
তাই এই মহাস্রষ্টা শুধু আমাদের বিনোদনের বা রসানুভবের অন্তহীন উৎস নন, ইনি আমাদের অপার শুশ্রূষাও হয়ে ওঠেন। এই জন্যই বহু মানুষের কাছে তিনি ‘গুরুদেব’, অনেক অবিশ্বাসীর কাছে তিনি ঈশ্বরের বিকল্প। শুধু বাঙালির কাছে নয়, পৃথিবীজুড়ে বহু মানুষের কাছে, তাদের ভাষায়। তরুণ ইংরেজ কবি উলফ্রেড আওয়েন যুদ্ধে যাচ্ছেন, তার ডায়েরিতে লিখে রাখছেন ইংরেজি গীতাঞ্জলির এই ছত্র দুটি- When I leave from hence, let these be my parting words: that what I have seen is unsurpassable. ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই, যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’ কবির যাওয়ার দিন তখনো তিন যুগের মতো দূরে, কিন্তু তার ওই প্রাপ্তির উপলব্ধিটি সেও যুদ্ধবিরোধী তরুণ কবিকে উদ্দীপ্ত করেছিল। সেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগের সপ্তাহে শত্রুর বোমার আঘাতে যার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। তার মা তার ডায়েরির মধ্যে ওই দুটি লাইন পেয়ে আকুল হয়ে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজবেন, চিঠি লিখবেন কোথায় পাবেন তিনি পুরো কবিতাটি। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে তার বছর পাঁচেক আগেই যক্ষ্মারোগগ্রস্ত মৃত্যুপথযাত্রী জাপানি কবি মাশিনো, ইংরেজি গীতাঞ্জলি সংগ্রহ করে পাগলের মতো তা বারবার অনুবাদ করতে থাকবেন, যেন ও-ই তার অনিবার্য মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ। তারও মৃত্যু হবে, জাপানে রবীন্দ্রনাথকে দেখার (প্রথম পদার্পণ ১৯১৬) ব্যাকুল আগ্রহ তার পূরণ হবে না। এ রকম কত আখ্যান। সবারই জানা, তবু বারবার বলার পরও আবার বলতে ইচ্ছে হয়। ১৯৪২-এ হিটলারের বাহিনী পোলান্ড দখল করল, রাস্তায় ইহুদিদের মৃতদেহ পড়ে থাকা শুরু হলো রাজধানী ওয়ারশতে। এক অনাথ আশ্রম চালাতেন ইহুদি ডাক্তার করচাক। শহরের পাশে ত্রেবলিংকা নাৎসি শিবির থেকে চিঠি এসে পৌঁছল, ‘ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে আসুন।’ মাসখানেক পরের একটা তারিখ দেওয়া। করচাক জানেন এ হলো মৃত্যুর পরোয়ানা, শিবিরে নিয়ে গিয়ে জারখন বি গ্যাস দিয়ে তাদের মেরে ফেলা হবে। কী করে বলবেন সে কথা ছেলেমেয়েদের? নিজেই স্থির করলেন পোলিশ অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ অভিনয় করাবেন ছেলেমেয়েদের দিয়ে। মৃত্যুর মুখে নাটক? সবার বিস্ময়কে প্রতিহত করে তিনি বললেন, নাটক থেকে যদি ওরা বুঝতে পারে, মৃত্যু ভয়ংকর নয়, তা রাজার কাছে যাওয়া। সে নাটক হলো, নির্দিষ্ট তারিখে ছেলেমেয়েরা মিছিল করে, বেহালা বাজিয়ে নেচেগেয়ে সেই শিবিরে, নিশ্চিত মৃত্যুর গুহায় চলে গেল। ফিরতে পেরেছিল আঙুলে গোনা কয়েকজন। এই আখ্যান নিয়ে রোমান পোলানস্কি ছবি তুলেছেন, গুগলেও বিবরণ পাওয়া যাবে। ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কারণেই রবীন্দ্রনাথের আবক্ষমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছে ইহুদিরা।
বলি ড. এলিজাবেথ কুবলার রসের কথা। ইহুদি এই মনোবিদ ডাক্তারের ১৯৪২-এই ভারতে যুদ্ধের স্বেচ্ছাসেবক হয়ে আসার কথা ছিল, আসা হয়নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন তখন। তার পর উদ্বাস্তু হয়ে এলেন আমেরিকায়, মনোবিদ ডাক্তার হিসেবে গবেষণা করলেন হাসপাতালে হাসপাতালে গিয়ে। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের নিয়ে। কেউ জানেন, কেউ জানেন না যে তাদের দিন বেশি বাকি নেই। যেদিন ডাক্তার তাদের জানাচ্ছেন সেদিন উপস্থিত থাকছেন রস, দেখছেন তাদের প্রতিক্রিয়া। তাদের প্রতিক্রিয়ার পর্যায় নিয়ে লিখলেন এক অসাধারণ গবেষণার বই- On Death and Dying. (১৯৬৯)। প্রথমে অবিশ্বাস (‘হতেই পারে না! আপনি ভুল করছেন ডাক্তার!), তার পরে ক্রোধ (‘এত লোক থাকতে আমাকে যেতে হবে কেন?’), তার পরে অবসাদ, তার পরে বৈরাগ্য, তার পরে বাস্তবের কাছে আত্মসমর্পণ। এ বইয়ে তেরো জায়গায় একজন মাত্র মানুষের লেখা থেকে উদ্ধৃতি, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কেন? মিনিয়াপোলিসে দেখা হওয়ায় জিজ্ঞেস করেছিলাম তাকে। বললেন, ‘মৃত্যু সম্বন্ধে এমন গভীর কথা আমি আর কারও লেখায় খুঁজে পাইনি। আর যে মানুষ মৃত্যুকে এমন বুঝেছেন তিনি জীবনকেও পুরোটাই বুঝে ফেলেছেন, এই কথাটা আমি জোর দিয়ে বলতে চাই।’ ২২ শে শ্রাবণ আমাদের নিরন্তর এই কথাটা বলুক।
লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়