ঢাকা ২৫ ভাদ্র ১৪৩১, সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এই শ্রাবণের বুকের ভিতর

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৪, ১১:৪৫ এএম
আপডেট: ০২ আগস্ট ২০২৪, ১২:৩২ পিএম
এই শ্রাবণের বুকের ভিতর
আঁকা: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

আগুন আছে? না চোখের জল? সে আগুন কি দহনের, শোকের? নাকি একটা শোককে উপলক্ষ্য করে শোককে পার হয়ে যাওয়ার? সে আগুন কি চিরবিদায়ের? নাকি তার মৃত্যু সেই উপলক্ষ্য, যার পরে তার কণ্ঠস্বর অনন্ত, অপরাজিত, সর্বব্যাপ্ত হয়ে উঠবে? যে মরদেহ আজ থেকে তিরাশি বছর আগে পৃথিবী আগুনের কাছে সমর্পণ করেছিল, আজ এই বাইশে শ্রাবণ সেই আগুনের স্মৃতি বহন করছে বটে, কিন্তু, তিনি যেমন বলেন মৃত্যু জীবনের একটা ছিন্ন মুহূর্ত মাত্র, আমাদের কাছে শেষ পর্যন্ত ব্যবহার্য থাকে যাপিত জীবন- মহৎ ও সুন্দরের প্রকাশে যে জীবনের সীমা-পরিসীমা নেই। এ দেশে, ও দেশে, পৃথিবীর মানুষের কাছে- যারা তাকে বাংলাভাষায় কখনো পাননি, কিন্তু নিজেদের ভাষায় পেয়ে, অবিশ্বাসী অনুবাদ-তত্ত্বকে হাস্যকর প্রমাণ করে, তাকে পেয়ে চলেছেন। সে এক অদৃশ্য, জীবন্ত, জীবনদায়ী উপস্থিতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাইশে শ্রাবণ সেই বিশাল অট্টালিকায় এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি। তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন, মানুষের জীবন অনন্ত ও প্রবহমাণ, একের জীবন সীমাবদ্ধ হলেও। এই জীবনে দুঃখ আছে, ক্ষতি আছে, ক্ষত আছে, কিন্তু তা ‘মিছে হতে মিছে- নিমেষের কুশাঙ্কুর- পড়ে রবে নীচে।’ ‘দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে, বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে... মরতে মরতে মরণটারে শেষ করে দে একেবারে। তার পরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে।’ ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব, ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।’

এ কি কেবল মুখের কথা- শুষ্ক স্তোক? কথার ছলনা? তা কেন হবে? তিনি নিজের জীবনেও তো নিজের কথাগুলো মেনে এসেছেন, ‘বুকের শিরা ছিন্ন করে’ জীবনের ‘ভীষণ পূজা’ করেছেন। কত দুঃখ, কত শোক পেয়েছেন- বজ্রাহত, কিন্তু অটল বনস্পতির মতো তা বহন করেছেন। শৈশবে মায়ের মৃত্যুশোক তিনি না-হয় বুঝতে পারেননি, কিন্তু সেই প্রথম যৌবনে বউঠান কাদম্বরীর আত্মঘাতের পর থেকে আত্মজন-বিয়োগের শোক তাকে প্রায় নিয়মিত এসে আঘাত করেছে। বিস্মিত হয়ে দেখি এই আশ্চর্য মানুষটি সমস্ত শোককে গ্রহণ করেন বর্মের ওপর শত্রুর নিষ্ফল অস্ত্রাঘাতের মতো অবলীলায়, অন্য মানুষ যাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত। সবচেয়ে প্রিয় পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে ছোট মেয়ে মীরাকে লেখেন, ‘শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই।’ এ কেমন লোক যে শোকে পৃথিবীর কাছে পাঠ নেয়, শোকের পর জ্যোৎস্নারাত্রি দেখে ভাবে যে, আমার এই পূর্ণতা থেকে কিছু শেখার আছে?

তাই এই মহাস্রষ্টা শুধু আমাদের বিনোদনের বা রসানুভবের অন্তহীন উৎস নন, ইনি আমাদের অপার শুশ্রূষাও হয়ে ওঠেন। এই জন্যই বহু মানুষের কাছে তিনি ‘গুরুদেব’, অনেক অবিশ্বাসীর কাছে তিনি ঈশ্বরের বিকল্প। শুধু বাঙালির কাছে নয়, পৃথিবীজুড়ে বহু মানুষের কাছে, তাদের ভাষায়। তরুণ ইংরেজ কবি উলফ্রেড আওয়েন যুদ্ধে যাচ্ছেন, তার ডায়েরিতে লিখে রাখছেন ইংরেজি গীতাঞ্জলির এই ছত্র দুটি- When I leave from hence, let these be my parting words: that what I have seen is unsurpassable. ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই, যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’ কবির যাওয়ার দিন তখনো তিন যুগের মতো দূরে, কিন্তু তার ওই প্রাপ্তির উপলব্ধিটি সেও যুদ্ধবিরোধী তরুণ কবিকে উদ্দীপ্ত করেছিল। সেই যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগের সপ্তাহে শত্রুর বোমার আঘাতে যার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। তার মা তার ডায়েরির মধ্যে ওই দুটি লাইন পেয়ে আকুল হয়ে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজবেন, চিঠি লিখবেন কোথায় পাবেন তিনি পুরো কবিতাটি। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে তার বছর পাঁচেক আগেই যক্ষ্মারোগগ্রস্ত মৃত্যুপথযাত্রী জাপানি কবি মাশিনো, ইংরেজি গীতাঞ্জলি সংগ্রহ করে পাগলের মতো তা বারবার অনুবাদ করতে থাকবেন, যেন ও-ই তার অনিবার্য মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ। তারও মৃত্যু হবে, জাপানে রবীন্দ্রনাথকে দেখার (প্রথম পদার্পণ ১৯১৬) ব্যাকুল আগ্রহ তার পূরণ হবে না। এ রকম কত আখ্যান। সবারই জানা, তবু বারবার বলার পরও আবার বলতে ইচ্ছে হয়। ১৯৪২-এ হিটলারের বাহিনী পোলান্ড দখল করল, রাস্তায় ইহুদিদের মৃতদেহ পড়ে থাকা শুরু হলো রাজধানী ওয়ারশতে। এক অনাথ আশ্রম চালাতেন ইহুদি ডাক্তার করচাক। শহরের পাশে ত্রেবলিংকা নাৎসি শিবির থেকে চিঠি এসে পৌঁছল, ‘ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে আসুন।’ মাসখানেক পরের একটা তারিখ দেওয়া। করচাক জানেন এ হলো মৃত্যুর পরোয়ানা, শিবিরে নিয়ে গিয়ে জারখন বি গ্যাস দিয়ে তাদের মেরে ফেলা হবে। কী করে বলবেন সে কথা ছেলেমেয়েদের? নিজেই স্থির করলেন পোলিশ অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ অভিনয় করাবেন ছেলেমেয়েদের দিয়ে। মৃত্যুর মুখে নাটক? সবার বিস্ময়কে প্রতিহত করে তিনি বললেন, নাটক থেকে যদি ওরা বুঝতে পারে, মৃত্যু ভয়ংকর নয়, তা রাজার কাছে যাওয়া। সে নাটক হলো, নির্দিষ্ট তারিখে ছেলেমেয়েরা মিছিল করে, বেহালা বাজিয়ে নেচেগেয়ে সেই শিবিরে, নিশ্চিত মৃত্যুর গুহায় চলে গেল। ফিরতে পেরেছিল আঙুলে গোনা কয়েকজন। এই আখ্যান নিয়ে রোমান পোলানস্কি ছবি তুলেছেন, গুগলেও বিবরণ পাওয়া যাবে। ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কারণেই রবীন্দ্রনাথের আবক্ষমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছে ইহুদিরা। 

বলি ড. এলিজাবেথ কুবলার রসের কথা। ইহুদি এই মনোবিদ ডাক্তারের ১৯৪২-এই ভারতে যুদ্ধের স্বেচ্ছাসেবক হয়ে আসার কথা ছিল, আসা হয়নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন তখন। তার পর উদ্বাস্তু হয়ে এলেন আমেরিকায়, মনোবিদ ডাক্তার হিসেবে গবেষণা করলেন হাসপাতালে হাসপাতালে গিয়ে। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের নিয়ে। কেউ জানেন, কেউ জানেন না যে তাদের দিন বেশি বাকি নেই। যেদিন ডাক্তার তাদের জানাচ্ছেন সেদিন উপস্থিত থাকছেন রস, দেখছেন তাদের প্রতিক্রিয়া। তাদের প্রতিক্রিয়ার পর্যায় নিয়ে লিখলেন এক অসাধারণ গবেষণার বই- On Death and Dying. (১৯৬৯)। প্রথমে অবিশ্বাস (‘হতেই পারে না! আপনি ভুল করছেন ডাক্তার!), তার পরে ক্রোধ (‘এত লোক থাকতে আমাকে যেতে হবে কেন?’), তার পরে অবসাদ, তার পরে বৈরাগ্য, তার পরে বাস্তবের কাছে আত্মসমর্পণ। এ বইয়ে তেরো জায়গায় একজন মাত্র মানুষের লেখা থেকে উদ্ধৃতি, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কেন? মিনিয়াপোলিসে দেখা হওয়ায় জিজ্ঞেস করেছিলাম তাকে। বললেন, ‘মৃত্যু সম্বন্ধে এমন গভীর কথা আমি আর কারও লেখায় খুঁজে পাইনি। আর যে মানুষ মৃত্যুকে এমন বুঝেছেন তিনি জীবনকেও পুরোটাই বুঝে ফেলেছেন, এই কথাটা আমি জোর দিয়ে বলতে চাই।’ ২২ শে শ্রাবণ আমাদের নিরন্তর এই কথাটা বলুক। 

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

তোমাকেও ছোঁবে

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
তোমাকেও ছোঁবে

ভেবো না, তোমাকেও ছোঁবে হিমেল বাতাস
আঁচড়ে দেবে
জীবনের বেলাভূমি
স্বপ্নগুলো উড়ে যাবে বৈশাখী বাতাসে
তোমার বাড়ি তার ভেতরের ঘর
প্রিয় সংগ্রহগুলো
থাকবে না কিছুই-

ভেঙে পড়বে চৈতন্যের কাঠামো
দড়ি বর্গা খড়খড়ি দরজা ধানের মটকা
স্মৃতিময় মুখগুলো হারিয়ে যাবে
ছোঁবে, তোমাকে ছুঁয়ে যাবে
হিমেল বাতাস
থেমে যাবে স্পন্দন
ধূসর প্রদেশে হবে শেষ গন্তব্য তোমার
ফিরবে না আর আলোকিত
নাগরিক কোলাহলে
ভেবো না, ছোঁবে
তোমাকেও-

নষ্টনীড় কাঁধ

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৬ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
নষ্টনীড় কাঁধ

আঁজলায় জমানো ছিল ভোরের কাজল, হৃদি কল্লোল,
দিঘিজল ছোঁয়া ধূলিওড়া লাবণ্য মেঠোপথ।
থাকেনি সেইসব ঐশ্বর্য অপার। তার পর কে যেন কবে
বলেছিল, ‘দাঁড়াও সুপান্থ, পশ্চাতে নদী, এনে দেব
দু’হাতে তোমার, বিহঙ্গ জোয়ার।
কবে কোন দেবদারু রাতে ডেকেছিল রোদরাঙা চাঁদ
                     পেতেছিল শুদ্ধ জলের ছায়ায় শয্যা শোয়ার।
আহা, কার যেন রিনিঝিনি হাত ছুঁয়েছিল নষ্ট নীড় কাঁধ।
তার পর সেই আঁজলা, নদী, চাঁদ, সেই রিনিঝিনি হাত
ঝুলে আছে দ্যাখো, দ্যাখো, একলা হাওয়ায়।

ইচ্ছেধারী পা

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
ইচ্ছেধারী পা

প্রখর তাপে ঝলসে যাচ্ছে দিনলিপির শরীর 
গর্জে উঠছে না শব্দেরা, হাতচিঠা এসে জমতে চায় 
প্রাচীন শিকারের মতো। মেঘের আঁচল প্রসারিত 
দেখি ছায়াঘর, স্বল্প ঘুমের দেশে সে এক পর্দানশীন  
কোনো লাইনই তাকে রাঙাতে পারে না
আমি নিজের মধ্যেই সমাহিত করি এক অলিখিত চুক্তি 
মধ্যবিত্তের হিসেব। একবার প্রতিলিপি তৈরি হয়ে গেলে  
বিলিয়ে দেবার প্রশ্রয়ও আসে না
একটা বিষণ্ণতার অভাব, নিদেনপক্ষে কিছু বিষাদ  
কেউ কি ফিরে এসে দ্যাখে 
               এই অভিপ্রেত শরীর বেঁচে আছে কিনা?  
এই যে মাঝ নদী, এই যে নৌকাবিহার
এই যে আমাদের ইচ্ছেধারী পা  
একে অপরের দিকে প্যাডেল করে অন্বয় হচ্ছে 
সেসব ত্যাগ করে কেন আমি ডুবে যাব!

ভেতো হাসির গল্প

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০১ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০১ পিএম
ভেতো হাসির গল্প
আঁকা: নিয়াক চৌধুরী তুলি

কেরামত আলীর হাসি আর থামে না।
বড্ড সহজ-সরল নির্বিবাদী মানুষ সে। সারা দিন সারাবেলা হাসিখুশি থাকে। দুঃখ-দৈন্য কখনো তাকে স্পর্শ করে না। পেটপুরে ভাত খাওয়া তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের কাজ। এ আনন্দের সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনাই হয় না। খেতে বসে পেট না ভরলে তার মন ব্যাজার হয়, মাথায় ঠিকমতো কাজ করে না। এমন অঘটন কখনো ঘটলে আমার মায়ের চোখে ব্যাপারটা ঠিকই ধরা পড়ে, কেরামতের মুখের দিকে তাকিয়ে মা তখন বলে, আর দুটো ভাত নিবি কেরু?

কেরু মানে কেরামত আলী মুখ ফুটে কিছুই বলে না, এ প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ অথবা না কোনোটিই পষ্টাপষ্টি জানায় না, কেবল সাদা ফকফকে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হেসে ওঠে। ওই হাসিতেই উত্তর বুঝে নেয় আমার মা। গামলা ভর্তি বাড়তি ভাত এনে কেরুর সামনে বাড়িয়ে ধরে। তরিতরকারি নিয়ে কেরুর বিশেষ ভাবনা নেই। এক বাটি ডালের সঙ্গে গোটা দুই কাঁচা মরিচ হলেই তার পূর্ণ তৃপ্তি। আহার শেষে থালাবাটি ধুয়ে কাঁধের গামছায় হাত-মুখ মোছা হলে তখন শ্বেতপদ্ম ফুটে ওঠে তার মুখের হাসিতে। কালো মানুষের মুখে সাদা দাঁতের কার্পাসফাটা হাসি দেখে আমার মায়েরও মন ভরে যায় তৃপ্তিতে, নিজেও হাসিমুখে ঘোষণা দেয়- এইবার খুশি আমার কেরু পাগল। এইবার যা ইচ্ছে তাই হুকুম করো, কেরুর মুখে আর রা নেই।

কেরামত আলীকে গ্রামের সবাই ডাকে কেরু বলে, কেবল আমার মাকেই দেখেছি তার নামের সঙ্গে পাগলটুকু জুড়ে দিয়ে সস্নেহ আশকারা দিতে। নিজের পেটের তিন পুত্রের মাঝখানে অলক্ষ্যে কোথায় যেন একটুখানি আলগা জায়গা ছেড়ে দেয় মা। সেই জায়গাটুকু সর্বসমক্ষে দৃশ্যমান না হলেও আমি বেশ ধরতে পারি। আমার বড় ভাই এবং মেজো ভাইকে তো আশৈশব তুই-তোকারিই করতে দেখেছি, কেবল আমিই সেটা পারিনি। বাড়ির রাখাল থেকে কৃষাণ হয়েছে কেরু আমাদের চোখের সামনেই, তার সঙ্গে তুই-তোকারিই তো স্বাভাবিকভাবে প্রচলিত এবং বিধিসম্মত। তবু আমি তাকে কেরুভাই বলে সম্মোধন করে এসেছি। আমার চেয়ে শুধু বয়সে বড় নয়, শরীর-স্বাস্থ্যেও কেরামত আলী আমার দ্বিগুণ। এই শরীরেরও তো একটা সম্ভ্রম আছে! বুদ্ধিতে হয়তো কিছুটা পিছিয়ে থাকতে পারে। তা-ই বা নিঃসংশয়ে বলি কী করে! ওই মোটা বুদ্ধি নিয়েই তো দিব্যি সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। নিজে কুচকুচে কালো হয়েও কপালগুণে ফরসা ধবধবে একটা বউ পেয়েছে, তারই পেটে দু-দুটো হৃষ্টপুষ্ট সন্তান পেয়েছে, এসব নিয়ে তার সংসার। আমার বাবা যথার্থই নিজে হাতে গড়েপিটে তাকে সংসারী করে গেছেন। বিয়ের সময় পাত্রের গাত্রবর্ণ নিয়ে একটুখানি খুঁতখুঁতানি উঠলে পাত্রীপক্ষকে গভীর আস্থার সঙ্গে আশ্বস্ত করেছেন- গায়ে-গতরে খেটে কেরু ঠিকই পেটের ভাত জোগাড় করে নেবে। দেখে নিও সবাই, কেরুর কোনোদিন ভাতের অভাব হবে না।

বিয়ের পর আমাদের ভিটে-জমির পুবের কোনায় কেরুর জন্য নতুন ঘর তুলে দেওয়া হয়। সেই ঘরেই তার সংসার-পত্তনি। আমাদের পিতৃ-বিয়োগের পর বিষয়-সম্পত্তি ভাইয়ে-ভাইয়ে ভাগাভাগি হলেও কেরুর ঘরবাড়ি নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি। আমাদের সঙ্গে থেকে শুধু জমিজায়গা নয়, যথার্থই আমাদের সবাইকে আগলেও রাখে সে। দূরবর্তী স্থানে বিবাহিত আমাদের দুই বোনের সঙ্গে যোগাযোগও রাখে সে। তবু কারও কাছে কোনো দাবি নেই। তার চাহিদা খুবই সামান্য এবং সেটুকু নির্দ্বিধায় জানায় আমার মায়ের কাছে। আর কিছু নয়, সে খাবার সময় পেটভরা ভাত চায়। তাহলেই সব বোঝা টানতে পারে, সব হুকুম পালন করতে পারে হাসিমুখে। আসলে সে-ই সার্থক করেছে প্রবাদবাক্য- পেটে খেলে পিঠে সয়, গাধাও তখন বোঝা বয়।

পেটের খাদ্য বলতে কেরু শুধু ভাতই বোঝে। ভাত ছাড়াও আরও কত রকম খাদ্য যে এ দুনিয়ায় আছে, আছে শতেক রকম পিঠেপুলি, সে যে তার খবর রাখে না, তা নয়। কিন্তু তার সব চেয়ে প্রিয় খাবার ভাত। গরম ভাত, পান্তাভাত, কড়কড়ে ভাত, খিচুড়ি ভাত- যেমনই হোক, ভাত হলেই হলো। তার যুক্তি খুবই সোজা- খালা বলো ফুপু বলো মায়ের সমান কে, মাকে পেলে আমি তো আর কিছু  চাইনে। কথায় কথায় এমনি ধারা কাব্যি গাওয়া স্বভাব তার। পেটের ভেতরে কথা জমানোই থাকে, কথার পিঠে কথা বলতে গিয়ে এই সব কাব্যি উগরে দেয় মুখে মুখে। ভাতের কেচ্ছা বলতে বলতে অতি শৈশবে শোনা তার বাপের খিদের গল্পও সে গড়গড় করে বলে যায়। কবে নাকি রাতের আঁধারে কার হেঁসেলে ঢুকে হাপুসহুপুস করে পান্তাভাত খাবার সময় তার বাপ ধরা পড়েছিল একটা কাঁচা মরিচের জন্য। মায়ের কাছে শুনেছে সেই আকালের বছরে ভাত চুরির অপরাধে বেচারা খুব পিটুনি খেয়েছিল। শুধু পিটুনি নয়, আরও নির্মম শাস্তিও সে ভোগ করে। পিঠমোড়া করে দুহাত বেঁধে লাল পিঁপড়ের চাকের ওপরে তাকে ফেলে রাখে। ভাতের জন্য মানুষের এমন শাস্তির কথা শুনে আমরা অনেকেই শিউরে উঠি, কিন্তু ভাতের প্রতি ভক্তি জানাতে কেরামত কাব্যি গেয়ে শোনায়- ভাতই আমার আল্লা রসুল ভাতই ভগবান, ভাতই আমার মানসম্মান ভাতেই অপমান।

ভাতপাগল এই মানুষটি সেদিন হাসপাতালে যাওয়ার পর ডাক্তারের মুখে যে-কথা শুনে আসে, তাতে তার মাথায় বাজ পড়ে। কিন্তু বজ্রপাতের আঘাতে স্তব্ধ মানুষ কখনো হা হা করে উদ্দাম স্রোতের মতো হাসতে পারে! আমাদের কেরামত আলী ওরফে কেরু ভাই হাসে, বাঁধভাঙা হাসির স্রোতে ভাসিয়ে দেয় চারদিক। এমন হাসির উচ্ছ্বাস আগে কখনো দেখিনি।

আমিই তাকে জোর করে ঠেলে পাঠিয়েছিলাম উপজেলা হাসপাতালে, আমার এক ডাক্তার বন্ধুর নামে চিঠি লিখে সেটাও ধরিয়ে দিয়েছিলাম তার হাতে। মাঠেঘাটে কখন অসাবধানে কাঁটাখোঁচের ধাক্কায় তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল কেটে রক্তাত হয়েছে, মাসখানেকের মধ্যে সেই ঘা আর শুকায় না। গ্রাম্য ডাক্তারিতে কাজ না হলে আমি একরকম জোর করেই তাকে হাসপাতালে পাঠাই। আমার বন্ধু ডাক্তার জাহিদ ক্ষতস্থান ধুয়ে মুছে যত্ন করে চিকিৎসা ঠিকই দিয়েছে, কিন্তু রক্ত পরীক্ষার পর তার কানের কাছে ভয়াবহ বোমা ফাটিয়েছে- কেরামত আলীর ডায়াবেটিস না কমলে ঘা শুকোবে না।

ডায়াবেটিস!

কেরামত আলী চমকে উঠলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। এ রোগের নাম তার অজানা নয়। নানান আজগুবি কথা শুনেছে এই রোগ নিয়ে। তবু সাহস করে সে বলে- 

তা হলি সেই রোগেরই ওষুধ দেন আমাকে।

প্রয়োজনীয় ওষুধপত্তর ঠিকই দিয়েছে ডাক্তার, সেই সঙ্গে এক গাদা লেকচার শুনিয়েছে ডায়াবেটিস রোগীর করণীয় সম্পর্কে। সেসব ঠিকই আছে, অসুখ হলে তো ডাক্তারের কথা শুনতেই হয়, তাই বলে ভাতকে বিষ বললে তাও মানতে হবে!

কেরুর তো তখন বুকে খিল লাগার দশা।

ভাত-রুটি-চিঁড়া-মুড়ি- এসবই নাকি ডায়াবেটিস রোগীর জন্য বিষের মতো। ডাক্তার চিনিকে বলে হোয়াইট পয়জন। তাহলে মানুষ বাঁচবে কী খেয়ে? ডাক্তার সে তালিকাও শুনিয়েছে ধৈর্যসহকারে। শুনতে ভালো লাগেনি বলে সে ঠিকমতো মনোযোগ দেয়নি। বরং বিদায় নেওয়ার সময় ভাতের প্রসঙ্গ পুনরায় তুলেছে- ভাত না খালি মানুষ বাঁচে স্যার?

অবশেষে দয়াপরবশ হয়ে ডাক্তার ভাতের বরাদ্দ অনুমোদন করেছে যৎসামান্য। সেই ভাতের পরিমাণ শুনে কেরুর ব্রহ্মচাঁদি ধাঁ করে জ্বলে ওঠে, সহসা আকাশসমান ক্ষুধায় সারা শরীর কাঁপতে থাকে; তখন সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয়।

বাড়ি পৌঁছেই মন ভালো হয়ে যায় কেরামত আলীর। সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা স্ত্রী তার সামনে গামলা ভর্তি ভাত এগিয়ে দেয়। বেগুন ভাজা, কচু শাকের ঘণ্ট, মসুরের ডাল সঙ্গে কাগজি লেবুর ফালি। আহা, নাক ডুবিয়ে খাওয়া যাকে বলে আর কী। এ জন্য কেউ কেউ তাকে মোষের সঙ্গেও তুলনা করে। মোষ তো দাঁত মেলে হাসতে পারে না, কেরু শোনে আর হাসে। তার স্ত্রী মাথায় ঘোমটা টেনে মধুর কটাক্ষ করে- হাসতি নজ্জাও করে না তুমার!

কেরু হাসপাতালের চিকিৎসা-বৃত্তান্ত আমার কাছে শোনাতে আসে সন্ধ্যাবেলায়। বিস্তারিত সব কথা খুলে বলতে চায়, কিন্তু বলা হয় না। হুড়মুড় করে এগিয়ে আসে ভাতের কথা। ভাপ ওঠা ভাত হোক কিংবা বাসি-পচা পান্তাই হোক, পেট পুরে ভাত না খেলে মানুষ বাঁচবে কেমন করে, তাই নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তা তার। সেই দুর্ভাবনার কথাটা ব্যক্ত করতে গিয়েই কেরু ভাইয়ের বুক ঠেলে হাসির গমক উঠে আসে। বাপরে, সে কী বিরামবিহীন হা হা হাসি! সে হাসি থামতেই চায় না। মুখ হা হয়ে চোয়াল আটকে থাকে। হা-ও বন্ধ হয় না, হাসিও থামে না কিছুতেই। এমন বিদঘুটে হাসি হাসতে দেখে আমার একটু একটু ভয় করে, আন্তরিক গলায় আমি তার নাম ধরে ডাকি- কেরু ভাই! শোনো কেরু ভাই!

না, সে আমার ডাক যেন শুনতেই পায় না। ধবধবে সাদা দুপাটি দাঁতের ফাঁকে হা করে সে হাসতেই থাকে, হাসতেই থাকে। আমি ভয়ার্ত হাতে হাস্যোজ্জ্বল মুখটা জড়িয়ে ধরতেই টের পাই তার দুচোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে তপ্ত অশ্রুধারা। এইবার আমি উদ্বেগে শিউরে উঠি- হাসি নয়, কেরামত আলী কি এতক্ষণ তবে কাঁদছে! মানুষের ভেতো হাসি কি এভাবে কান্নার হ্রদে নেমে আসতে পারে!

কেরামত আলীর হাসি অথবা কান্নার ধ্বনি শুনে তার স্ত্রী আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে আসে এবং পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে স্বামীর মুখ।

বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৭ পিএম
বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

‘মানুষ কি চায়- উন্নতি, না আনন্দ? উন্নতি করিয়া কি হইবে যদি তাহাতে আনন্দ না থাকে? আমি এমন কত লোকের কথা জানি, যাহারা জীবনে উন্নতি করিয়াছে বটে, কিন্তু আনন্দকে হারাইয়াছে।... জীবন তাহাদের নিকট একঘেয়ে, একরঙা, অর্থহীন। মন শান-বাঁধানো- রস ঢুকিতে পায় না।’...

বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের হৃদয়ে কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, দিনলিপি ইত্যাদি। জন্ম ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। পৈতৃক নিবাস যশোর জেলায়। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত ও মাতা মৃণালিনী দেবী। সাহিত্যিক-সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯) লেখাটি পছন্দ করে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশ করলে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘অপরাজিত’ (১৯৩২)... এবং গল্পসংকলন ‘মেঘমল্লার’ (১৯৩১)...। মৃত্যু ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র পুরস্কারে’ (১৯৫১) ভূষিত হন।