গত সংখ্যার পর
৭.
আনমনে বা প্রকাশ্যে মানুষ স্মৃতি ঘাটে, কখনো সম্পূর্ণ একাকিত্বে। মন্দ বা ভালো- ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয়- সেই তর্পণের মধ্যে একটা আকর্ষণ আছে। স্মৃতি মানুষকে কষ্ট দিলেও বাঁচিয়ে তোলে। রথীন দত্ত যেসব ঘটনা বলে চলেছেন তার সবগুলো চাক্ষুস না করলেও সময়ের দর্শক হিসেবে তিনি জীবন্ত হয়ে ওঠেন। অতএব, তিনি কথা বলে চলেন। তবে স্মৃতি ঘাটার একটা চাপ আছে। ফলে ঘামতে শুরু করেন দত্ত বাবু। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। মুখ মুছলেন। ভজহরিকে ডেকে বললেন- এসিটা ছেড়ে দে তো। মল্লিকা সেনগুপ্ত কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বয়স্ক মানুষ, শরীরের যদি হঠাৎ অবনতি ঘটে! রিপোর্টার ভয় পেয়ে যায়। বলে-
আজ না হয় থাক, স্যার। আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আবার না হয় আসব আমরা। বরং আজ রেস্ট নিন।
কিন্তু কথা যে শেষ হলো না! দেখো, পরের বার ভুলে গেলে দোষ দিও না আবার।
রিপোর্টার ভাবল কথাটা অসত্য কিছু নয়। ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। বয়স্ক মানুষ, নতুন করে শুরু করে কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে যাবেন- বলা যায় না। মল্লিকার চোখমুখে দ্বন্দ্ব দেখতে পেলেন দত্ত বাবু। সম্ভবত সে কারণেই মুচকি হেসে আবার চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
বললেন- আরেক দফা চা হবে নাকি, কী বল?
মল্লিকা সেনগুপ্ত: না স্যার, আজকের মতো শেষ করে আমরা উঠব। অন্য একটা অ্যাসাইনমেন্ট আছে।
সার্জন রথীন দত্ত: তাহলে শুরু করা যাক। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা বলি তোমাদের।
মল্লিকা সেনগুপ্ত: প্লিজ, স্যার।
সার্জন রথীন দত্ত: বুঝলে, ত্রিপুরার মাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে আরও একটি বড় ভূমিকা রাখে। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আগরতলা সার্কিট হাউসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বসে। ১৯৭০-এর ভোটের পর পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির কোনো অধিবেশন বসেনি। এরপর থেকে সংঘাতই শুরু হলো। অতএব, ইলেকটেড মেম্বাররা কেউ শপথ নিতে পারেননি। সবাই দেশ থেকে বিতারিত। যাই হোক, আগরতলা সার্কিট হাউসের বৈঠকটি ছিল আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির প্রথম বৈঠক। ১০ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই বৈঠকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র- মানে প্রক্লেমেশন অব ইন্ডিপেনডেন্স ও সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ঐতিহাসিক ঘটনা নয় কি?
মল্লিকা সেনগুপ্ত: নিশ্চয়ই স্যার, ঐতিহাসিক তো বটেই। দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত উপমহাদেশের জন্য একটি বড় ঘটনা। মাত্র দুই যুগের মধ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভেঙে যাচ্ছে- আবার একটি নতুন দেশের জন্ম হচ্ছে।
সার্জন রথীন দত্ত: একই সঙ্গে মোহাম্মদ আলী জিন্নার ‘টু নেশন থিওরি’- অর্থাৎ হিন্দু এক জাতি মুসলমান আরেক জাতি নীতিটিও কিন্তু ব্যর্থ প্রমাণিত হলো। বুঝলে, শুধু মুসলমান নেতারাই নন সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মতো অনেক জনপ্রিয় হিন্দু নেতাও তখন একই ধারণা পোষণ করতেন! অর্থাৎ মুসলমান এক হিন্দু আরেক। এর চেয়ে বড় মূর্খতা আর নেই।
তোমাদের ইয়ংদের জন্য বলি, এই যে চারদিকে আজ ধর্ম নিয়ে মাতামাতি, উন্মাদনা দেখছ, এর কুফল শুধু সাময়িক নয়- সুদূর প্রসারীও। এই দৃষ্টিভঙ্গি কখনো কোনো দলকে হয়তো আজ ক্ষমতায় বসাবে কিন্তু কাল রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হবে। বুঝলে, ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি শুধু ধর্মান্ধতাকে উসকে দেয় না, প্রগতিকে পেছন ঠেলে না; ন্যায়, সত্য ও সুবিচারকে নির্বাসনে পাঠায়। দেখ, আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা ধার্মিক মানুষ নই। কিন্তু আমার ব্যক্তিজীবন ও আমার পরিবার কেউই ধর্মের বাইরে নয়। কারণ ধর্ম মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ অংশ। কিন্তু একমাত্র ধর্মই কোনো জাতির মূল পরিচয় বহন করে না। দরকার হয় ভাষা, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সাজুজ্য; পাকিস্তানের বিভক্তি সেই সত্যকেই নতুন করে প্রমাণ করল।
যাই হোক, আগরতলা সার্কিট হাউসের বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি তখন পাকিস্তানের কারাগারে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বন্দি। উপরাষ্ট্রপতি হলেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, যিনি মুজিবের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ভূমিকা পালন করবেন। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য নির্বাচিত হলেন মোসতাক আহমদ (এই লোকটি কিন্তু পরে মুজিব হত্যার মূল কুশিলব হয়েছিল!) মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান- এরা।
এ সময় সার্জেন্ট দত্তকে বেশ খানিকটা উৎফুল্লও মনে হতে থাকে। মনে হয় ঘটনাটা বলতে পেরে তিনি একটি বড় কাজ সম্পাদন করলেন। তার মনে পড়ল যুদ্ধকালীন সরকারের প্রেসিডেন্ট ও প্রাইম মিনিস্টার বারকয়েকই তার হাসপাতালে এসেছেন দেশের আহত মানুষদের খোঁজখবর নিতে।
সার্জন দত্ত আবারও শুরু করলেন, তবে শোন, আগরতলায় সরকার গঠন হলেও মন্ত্রিসভার শপথ হলো আরও এক সপ্তাহ পর, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায়, ১৭ এপ্রিল ১৯৭১।
মল্লিকা সেনগুপ্ত: আগরতলায় সরকার হলো অথচ মেহেরপুরে মন্ত্রিসভার শপথ ঘটল! এমনটা কেন ঘটল?
সার্জন রথীন দত্ত: দেখ, আমি হাসপাতাল নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। হাজার মানুষের চিকিৎসা সেবা- ছোট কাজ তো নয়। অতএব, ওসবের খুব একটা খোঁজখবর রাখিনি। তবে ব্যাপারটা জটিল কিছু নয়। আগরতলা ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের কামানের গোলা ও রাইফেলের গুলির রেঞ্জের মধ্যে। অতর্কিত আক্রমণ, গোলাগুলির শেষ নেই ত্রিপুরায়। রাত্রিকালীন কারফিউ বলবৎ করা হয়েয়ে, নিষ্প্রদীপ মহড়া চলে। রাজ্যের সীমানা বরাবর এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ঘটনাটা নিরাপদে ঘটানো যায়। অথচ ভারতের মাটিতে না হয়ে বাংলাদেশের যে কোনো মুক্তাঞ্চলে অনুষ্ঠানটি ঘটতে হবে, এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। তাই শপথের জন্য প্রথমে চুয়াডাঙ্গাকে ঠিক করা হলো। খবরটা প্রচার হতেই পাকিস্তানের বিমান বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় নির্বিচার বোমা বর্ষণ করল। বহু লোক হতাহত হলো। শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে মেহেরপুরে শপথ অনুষ্ঠানের ব্যাপারটি চূড়ান্ত হলো।
চলবে...