বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলে জমিদারি ক্রয় করেন। এ সময় এতদঞ্চলে নীল চাষ হতো। দ্বারকানাথ ঠাকুরের জমিদারিতে ছিল সাবেক নদীয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার বিরাহিমপুর (ইব্রাহিমপুর) পরগনা (সদর শিলাইদহ), পাবনা জেলার সাজাদপুর পরগনা (সদর সাজাদপুর), রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগণা (সদর পতিসর) এবং ওড়িশার কটক জেলার পাণ্ডুয়া বালিয়া প্রহরাজপুর শরগড়া ইত্যাদি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও পশ্চিবঙ্গের আরও কিছু অঞ্চল দ্বারকানাথ ঠাকুরের জমিদারিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রবীন্দ্রনাথ যখন জমিদারির দায়িত্বভার পেলেন তখন তার বয়স ২৮-২৯ বছর। সময়কাল ছিল ১৮৮৯-৯০। এ সময়টায় প্রথম পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এস্টেটের এই এজমালি জমিদারি পর্যবেক্ষক হিসেবে থেকেছেন। পুরো দায়িত্ব নিয়েছেন ১৮৯৬ সালের ৮ আগস্ট। এ সময় পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দান করেন। এই এজমালি সম্পত্তি বেশ কয়েক বছর রবীন্দ্রনাথ স্বহস্তে পরিচালনা করেন। জমিদারি পরিচালনার ভার হাতে নেওয়ার দু-তিন বছরের মধ্যে জমিদারির অভ্যন্তরীণ অবস্থা, প্রজাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন ইত্যাদি বিষয়ে সম্যক অভিজ্ঞতা লাভের পর তিনি জমিদারি ব্যবস্থায় সঠিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সে সময় শিলাইদহ সদর কাচারির অধীনে নয়টি ডিহি কাচারি ছিল। রবীন্দ্রনাথ নয়টি ডিহি কাচারিকে ভেঙে তিনটি বিভাগীয় কাচারি তৈরি করলেন শিলাইদহ সদর কাচারির অধীনে। ফলে প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটল। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষভাবে প্রজাদের অবস্থা নিরীক্ষণ করতে সক্ষম হলেন। জমিদার হিসেবে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, ইংরেজ শাসকরা এ দেশকে কেবল শোষণ করে চলেছে এবং তাদের সহায়তা করেছে এ দেশের জমিদারশ্রেণি। ইংরেজদের এই মানসিকতা তাকে ক্ষুব্ধ করে। তিনি লক্ষ্য করেন প্রতিটি গ্রাম মৃতপ্রায়। সর্বত্রই শিক্ষার দারুণ অভাব। তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন, শিক্ষা ব্যতিরেকে সাধারণ মানুষের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তার কবিমন ও স্বদেশপ্রেম তাকে এসব কারণে পল্লিউন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।
প্রজাবৎসল জমিদার রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে আসেন তখন লক্ষ্য করেন তার জন্য দরবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে কিন্তু দরবারে মুসলমানদের আসন নিচে ফরাস পেতে কিংবা মাটিতে আর হিন্দুদের আসন চেয়ার বা বেঞ্চিতে। এই বৈষম্য লক্ষ্য করে তিনি জানতে চান সবার জন্য একই প্রকার ব্যবস্থা হয়নি কেন? কর্মচারীরা জানাল, ‘এই তো চলে আসছে বরাবর বাবু মশাই। প্রিন্সের আমলেও ছিল এই রকম ব্যবস্থা। মহর্ষির আমলেও।’ তিনি জানিয়ে দিলেন, ‘এমন দরবারে যোগ দেবেন না। এই ব্যবস্থার প্রতি পক্ষপাতি নন- সবাইকে সমান শ্রদ্ধা দেখাতে হবে।’ এই পুণ্যাহ উৎসব অতীতের সব বিধিবিধান ভঙ্গ করে হিন্দু-মুসলিম প্রজাদের এক আসনে বসার বাধ্য করেন এবং তিনি একই সঙ্গে বসে জমিদার প্রজার ব্যবধান ও প্রজায় প্রজায় ধর্মের কারণে পার্থক্য দূর করেন। প্রজাদের কল্যাণের জন্য তিনি বহুমুখী কর্মকাণ্ডের আয়োজন করেন।
রায়তের কথার ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু স্বভাবগত পেশা আসমানদারি। এই কারণেই জমিদারির জমি আঁকড়ে থাকতে আমার অন্তরের প্রবৃত্তি নেই। এই জিনিসটার পরে আমার শ্রদ্ধার একান্ত অভাব। আমি জানি জমিদার জমির মালিক, সে প্যারাসাইট, পরাশ্রিতজীব। আমরা পরিশ্রম না করে উপার্জন না করে ঐশ্বর্য্য ভোগের দ্বারা দেহকে অপটু ও চিত্তকে অলস করে তুলি।... প্রজারা আমাদের অন্ন যোগায় ও আমলারা আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়, এর মধ্যে পৌরুষও নেই, গৌরবও নেই।’
পৈতৃক সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে তাদের ‘ঠাকুর-এস্টেট’-এর জমিদার হয়েছিলেন। ‘ঠাকুর-এস্টেট’ সম্পর্কে জানা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পিতামহ নীলমণি ঠাকুর ছিলেন ঠাকুর-এস্টেটের প্রতিষ্ঠাতা। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষরা ছিলেন যশোরের পিরালী ব্রাহ্মণ।
রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৩ সালে ৭ নভেম্বর ২২ বছর বয়সে এবং বিবাহের দুই দিন আগে পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ঠাকুর-এস্টেটের জমিদারি দেখা-শোনার সাময়িক দায়িত্ব লাভ করেন। অন্য কোনো পুত্র এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারবে না এমন বিশ্বাসের কারণে রবীন্দ্রনাথের ওপর এই গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে লেখা পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিতে উল্লেখ আছে, ‘এই ক্ষণে তুমি জমিদারি কার্য পর্যবেক্ষণ করিবার জন্য প্রস্তুত হও। প্রথমে সদর কাছারিতে নিয়মিত রূপে বসিয়া সদর আমিনের নিকট হইতে জমা ওয়াশিল সাকি ও জমাখরচ দেখিতে থাক এবং প্রতিদিনের আমদানি-রফতানি পত্র সকল দেখিয়া তার সারমর্ম নোট করিয়া রাখ। প্রতি সপ্তাহে আমাকে তাহার রিপোর্ট দিলে উপযুক্ত মতে তোমাকে আমি উপদেশ দিব এবং তোমার কার্যে তৎপরতা ও বিচক্ষণতা আমার প্রতীতি হইলে আমি তোমাকে মফস্বলে কার্য করিবার ভার অর্পণ করিব।” দেবেন্দ্রনাথ প্রথমেই রবীন্দ্রনাথকে ঠাকুর এস্টেটের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রদান করেননি, বিশ্বাস অর্জন করার পরই ১৮৯০ সাল থেকে তিনি পুরোপুরিভাবে জমিদারি পরিদর্শনের দায়িত্ব লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ-ভবন নির্মিত হয় ১৮৯২ সালের শেষদিকে। নীলকর সাহেবদের ভগ্নকুটিরের মাল-মসলা দিয়ে বর্তমান ‘রবীন্দ্রকুঠি’ নির্মিত হয়। শিলাইদহ গ্রামের উত্তরপ্রান্তে প্রায় তেরো বিঘা জমির ওপর পদ্মানদীর ঢেউ খেলানো দৃশ্যের অনুরূপ প্রাচীরবেষ্টিত আড়াইতলা ভবন। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘক্ষণ থাকতেন এবং সাহিত্যসাধনা করতেন। এই ঘরে থেকেই রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি রচনা ও তার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। রবীন্দ্রসাহিত্যের ক্ষেত্রে আড়াইতলার এই কক্ষটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ির পরিচিতি সারা দেশ, এমনকি বিশ্বব্যাপী। তবে কুঠিবাড়ির খুব কাছেই স্মৃতিধন্য আরেকটি স্থাপনা কাচারিবাড়ি। সব জমি থেকে প্রাপ্ত খাজনা ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হতো এই কাচারিবাড়ি থেকে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ দ্বিতল ভবন জমিদারের খাজনা আদায়ের কাচারিবাড়ি। ১৮৯১ সাল থেকে প্রায় ৩০ বছর এই বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ জমিদারির খাজনা আদায় করেছেন। ১৮৯২ সালে নির্মিত হয় দ্বিতল ভবন বিশিষ্ট শিলাইদহ কাচারিবাড়ি। ৩০ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত এই ভবনটি একসময় জনমানুষের কোলাহলে জমজমাট থাকত। রবীন্দ্রনাথের আগমন উপলক্ষে কাচারিবাড়িকে জাঁকজমকের সঙ্গে সজ্জিত করা হতো। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক পূজা-পার্বণ-অনুষ্ঠানে পুণ্যপ্রার্থী প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মিশে যেতেন, বরকন্দাজরা গোল হয়ে ঘিরে ধরত তাকে। লাঠিয়ালরা নানারূপ লাঠিখেলা, কুস্তি, বল্লম ও তরবারি খেলায় বাহাদুরি প্রদর্শন করে বাবু মশায়ের নিকট থেকে পুরস্কার নিত। এক আসনে বসতে হবে রবীন্দ্রনাথের হুকুম! এই মেলায় তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ইতোপূর্বে হিন্দু-মুসলিম প্রজার বসবার জন্য পৃথক ব্যবস্থা ছিল। তাদের একই ধরনের বসার জায়গা নির্ধারণ করেন। তিনি জমিদার ও প্রজার প্রত্যক্ষ সম্পর্ককে জোরদারকরণের প্রয়াস নেন। সদর নায়েব বিরক্ত হতেন, কিন্তু বিরক্ত হলে কী হবে, এখানে যে সবাই সমান।
শিলাইদহ ছিল রবীন্দ্রনাথের জমিদারির কেন্দ্রবিন্দু। কবি এখান থেকেই শাহাজাদপুর, পতিসর যাতায়াত করতেন। তাই সব কিছুর বিচারে রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের কাচারিবাড়ি বাঙালির জন্য এক অনন্য সম্পদ। বাঙালি চিরকাল যাদের নিয়ে গর্ব করবে, তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম।