ঢাকা ২৫ ভাদ্র ১৪৩১, সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রবীন্দ্রনাথের জন্মগত পেশা জমিদারি স্বভাবগত পেশা আসমানদারি

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৪, ০১:০৬ পিএম
রবীন্দ্রনাথের জন্মগত পেশা জমিদারি স্বভাবগত পেশা আসমানদারি
ইতিহাস-ঐতিহ্যের কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারির খাজনা আদায়ের কাছারিবাড়ি।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলে জমিদারি ক্রয় করেন। এ সময় এতদঞ্চলে নীল চাষ হতো। দ্বারকানাথ ঠাকুরের জমিদারিতে ছিল সাবেক নদীয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার বিরাহিমপুর (ইব্রাহিমপুর) পরগনা (সদর শিলাইদহ), পাবনা জেলার সাজাদপুর পরগনা (সদর সাজাদপুর), রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগণা (সদর পতিসর) এবং ওড়িশার কটক জেলার পাণ্ডুয়া বালিয়া প্রহরাজপুর শরগড়া ইত্যাদি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও পশ্চিবঙ্গের আরও কিছু অঞ্চল দ্বারকানাথ ঠাকুরের জমিদারিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

রবীন্দ্রনাথ যখন জমিদারির দায়িত্বভার পেলেন তখন তার বয়স ২৮-২৯ বছর। সময়কাল ছিল ১৮৮৯-৯০। এ সময়টায় প্রথম পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এস্টেটের এই এজমালি জমিদারি পর্যবেক্ষক হিসেবে থেকেছেন। পুরো দায়িত্ব নিয়েছেন ১৮৯৬ সালের ৮ আগস্ট। এ সময় পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দান করেন। এই এজমালি সম্পত্তি বেশ কয়েক বছর রবীন্দ্রনাথ স্বহস্তে পরিচালনা করেন। জমিদারি পরিচালনার ভার হাতে নেওয়ার দু-তিন বছরের মধ্যে জমিদারির অভ্যন্তরীণ অবস্থা, প্রজাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন ইত্যাদি বিষয়ে সম্যক অভিজ্ঞতা লাভের পর তিনি জমিদারি ব্যবস্থায় সঠিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সে সময় শিলাইদহ সদর কাচারির অধীনে নয়টি ডিহি কাচারি ছিল। রবীন্দ্রনাথ নয়টি ডিহি কাচারিকে ভেঙে তিনটি বিভাগীয় কাচারি তৈরি করলেন শিলাইদহ সদর কাচারির অধীনে। ফলে প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটল। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষভাবে প্রজাদের অবস্থা নিরীক্ষণ করতে সক্ষম হলেন। জমিদার হিসেবে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, ইংরেজ শাসকরা এ দেশকে কেবল শোষণ করে চলেছে এবং তাদের সহায়তা করেছে এ দেশের জমিদারশ্রেণি। ইংরেজদের এই মানসিকতা তাকে ক্ষুব্ধ করে। তিনি লক্ষ্য করেন প্রতিটি গ্রাম মৃতপ্রায়। সর্বত্রই শিক্ষার দারুণ অভাব। তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন, শিক্ষা ব্যতিরেকে সাধারণ মানুষের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তার কবিমন ও স্বদেশপ্রেম তাকে এসব কারণে পল্লিউন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।

প্রজাবৎসল জমিদার রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে আসেন তখন লক্ষ্য করেন তার জন্য দরবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে কিন্তু দরবারে মুসলমানদের আসন নিচে ফরাস পেতে কিংবা মাটিতে আর হিন্দুদের আসন চেয়ার বা বেঞ্চিতে। এই বৈষম্য লক্ষ্য করে তিনি জানতে চান সবার জন্য একই প্রকার ব্যবস্থা হয়নি কেন? কর্মচারীরা জানাল, ‘এই তো চলে আসছে বরাবর বাবু মশাই। প্রিন্সের আমলেও ছিল এই রকম ব্যবস্থা। মহর্ষির আমলেও।’ তিনি জানিয়ে দিলেন, ‘এমন দরবারে যোগ দেবেন না। এই ব্যবস্থার প্রতি পক্ষপাতি নন- সবাইকে সমান শ্রদ্ধা দেখাতে হবে।’ এই পুণ্যাহ উৎসব অতীতের সব বিধিবিধান ভঙ্গ করে হিন্দু-মুসলিম প্রজাদের এক আসনে বসার বাধ্য করেন এবং তিনি একই সঙ্গে বসে জমিদার প্রজার ব্যবধান ও প্রজায় প্রজায় ধর্মের কারণে পার্থক্য দূর করেন। প্রজাদের কল্যাণের জন্য তিনি বহুমুখী কর্মকাণ্ডের আয়োজন করেন। 

রায়তের কথার ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু স্বভাবগত পেশা আসমানদারি। এই কারণেই জমিদারির জমি আঁকড়ে থাকতে আমার অন্তরের প্রবৃত্তি নেই। এই জিনিসটার পরে আমার শ্রদ্ধার একান্ত অভাব। আমি জানি জমিদার জমির মালিক, সে প্যারাসাইট, পরাশ্রিতজীব। আমরা পরিশ্রম না করে উপার্জন না করে ঐশ্বর্য্য ভোগের দ্বারা দেহকে অপটু ও চিত্তকে অলস করে তুলি।... প্রজারা আমাদের অন্ন যোগায় ও আমলারা আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়, এর মধ্যে পৌরুষও নেই, গৌরবও নেই।’

পৈতৃক সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে তাদের ‘ঠাকুর-এস্টেট’-এর জমিদার হয়েছিলেন। ‘ঠাকুর-এস্টেট’ সম্পর্কে জানা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পিতামহ নীলমণি ঠাকুর ছিলেন ঠাকুর-এস্টেটের প্রতিষ্ঠাতা। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষরা ছিলেন যশোরের পিরালী ব্রাহ্মণ। 

রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৩ সালে ৭ নভেম্বর ২২ বছর বয়সে এবং বিবাহের দুই দিন আগে পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ঠাকুর-এস্টেটের জমিদারি দেখা-শোনার সাময়িক দায়িত্ব লাভ করেন। অন্য কোনো পুত্র এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারবে না এমন বিশ্বাসের কারণে রবীন্দ্রনাথের ওপর এই গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে লেখা পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিতে উল্লেখ আছে, ‘এই ক্ষণে তুমি জমিদারি কার্য পর্যবেক্ষণ করিবার জন্য প্রস্তুত হও। প্রথমে সদর কাছারিতে নিয়মিত রূপে বসিয়া সদর আমিনের নিকট হইতে জমা ওয়াশিল সাকি ও জমাখরচ দেখিতে থাক এবং প্রতিদিনের আমদানি-রফতানি পত্র সকল দেখিয়া তার সারমর্ম নোট করিয়া রাখ। প্রতি সপ্তাহে আমাকে তাহার রিপোর্ট দিলে উপযুক্ত মতে তোমাকে আমি উপদেশ দিব এবং তোমার কার্যে তৎপরতা ও বিচক্ষণতা আমার প্রতীতি হইলে আমি তোমাকে মফস্বলে কার্য করিবার ভার অর্পণ করিব।” দেবেন্দ্রনাথ প্রথমেই রবীন্দ্রনাথকে ঠাকুর এস্টেটের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রদান করেননি, বিশ্বাস অর্জন করার পরই ১৮৯০ সাল থেকে তিনি পুরোপুরিভাবে জমিদারি পরিদর্শনের দায়িত্ব লাভ করেন। 

রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ-ভবন নির্মিত হয় ১৮৯২ সালের শেষদিকে। নীলকর সাহেবদের ভগ্নকুটিরের মাল-মসলা দিয়ে বর্তমান ‘রবীন্দ্রকুঠি’ নির্মিত হয়। শিলাইদহ গ্রামের উত্তরপ্রান্তে প্রায় তেরো বিঘা জমির ওপর পদ্মানদীর ঢেউ খেলানো দৃশ্যের অনুরূপ প্রাচীরবেষ্টিত আড়াইতলা ভবন। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘক্ষণ থাকতেন এবং সাহিত্যসাধনা করতেন। এই ঘরে থেকেই রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি রচনা ও তার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। রবীন্দ্রসাহিত্যের ক্ষেত্রে আড়াইতলার এই কক্ষটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ির পরিচিতি সারা দেশ, এমনকি বিশ্বব্যাপী। তবে কুঠিবাড়ির খুব কাছেই স্মৃতিধন্য আরেকটি স্থাপনা কাচারিবাড়ি। সব জমি থেকে প্রাপ্ত খাজনা ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হতো এই কাচারিবাড়ি থেকে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ দ্বিতল ভবন জমিদারের খাজনা আদায়ের কাচারিবাড়ি। ১৮৯১ সাল থেকে প্রায় ৩০ বছর এই বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ জমিদারির খাজনা আদায় করেছেন। ১৮৯২ সালে নির্মিত হয় দ্বিতল ভবন বিশিষ্ট শিলাইদহ কাচারিবাড়ি। ৩০ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত এই ভবনটি একসময় জনমানুষের কোলাহলে জমজমাট থাকত। রবীন্দ্রনাথের আগমন উপলক্ষে কাচারিবাড়িকে জাঁকজমকের সঙ্গে সজ্জিত করা হতো। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক পূজা-পার্বণ-অনুষ্ঠানে পুণ্যপ্রার্থী প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মিশে যেতেন, বরকন্দাজরা গোল হয়ে ঘিরে ধরত তাকে। লাঠিয়ালরা নানারূপ লাঠিখেলা, কুস্তি, বল্লম ও তরবারি খেলায় বাহাদুরি প্রদর্শন করে বাবু মশায়ের নিকট থেকে পুরস্কার নিত। এক আসনে বসতে হবে রবীন্দ্রনাথের হুকুম! এই মেলায় তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ইতোপূর্বে হিন্দু-মুসলিম প্রজার বসবার জন্য পৃথক ব্যবস্থা ছিল। তাদের একই ধরনের বসার জায়গা নির্ধারণ করেন। তিনি জমিদার ও প্রজার প্রত্যক্ষ সম্পর্ককে জোরদারকরণের প্রয়াস নেন। সদর নায়েব বিরক্ত হতেন, কিন্তু বিরক্ত হলে কী হবে, এখানে যে সবাই সমান। 

শিলাইদহ ছিল রবীন্দ্রনাথের জমিদারির কেন্দ্রবিন্দু। কবি এখান থেকেই শাহাজাদপুর, পতিসর যাতায়াত করতেন। তাই সব কিছুর বিচারে রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের কাচারিবাড়ি বাঙালির জন্য এক অনন্য সম্পদ। বাঙালি চিরকাল যাদের নিয়ে গর্ব করবে, তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম।

তোমাকেও ছোঁবে

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
তোমাকেও ছোঁবে

ভেবো না, তোমাকেও ছোঁবে হিমেল বাতাস
আঁচড়ে দেবে
জীবনের বেলাভূমি
স্বপ্নগুলো উড়ে যাবে বৈশাখী বাতাসে
তোমার বাড়ি তার ভেতরের ঘর
প্রিয় সংগ্রহগুলো
থাকবে না কিছুই-

ভেঙে পড়বে চৈতন্যের কাঠামো
দড়ি বর্গা খড়খড়ি দরজা ধানের মটকা
স্মৃতিময় মুখগুলো হারিয়ে যাবে
ছোঁবে, তোমাকে ছুঁয়ে যাবে
হিমেল বাতাস
থেমে যাবে স্পন্দন
ধূসর প্রদেশে হবে শেষ গন্তব্য তোমার
ফিরবে না আর আলোকিত
নাগরিক কোলাহলে
ভেবো না, ছোঁবে
তোমাকেও-

নষ্টনীড় কাঁধ

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৬ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
নষ্টনীড় কাঁধ

আঁজলায় জমানো ছিল ভোরের কাজল, হৃদি কল্লোল,
দিঘিজল ছোঁয়া ধূলিওড়া লাবণ্য মেঠোপথ।
থাকেনি সেইসব ঐশ্বর্য অপার। তার পর কে যেন কবে
বলেছিল, ‘দাঁড়াও সুপান্থ, পশ্চাতে নদী, এনে দেব
দু’হাতে তোমার, বিহঙ্গ জোয়ার।
কবে কোন দেবদারু রাতে ডেকেছিল রোদরাঙা চাঁদ
                     পেতেছিল শুদ্ধ জলের ছায়ায় শয্যা শোয়ার।
আহা, কার যেন রিনিঝিনি হাত ছুঁয়েছিল নষ্ট নীড় কাঁধ।
তার পর সেই আঁজলা, নদী, চাঁদ, সেই রিনিঝিনি হাত
ঝুলে আছে দ্যাখো, দ্যাখো, একলা হাওয়ায়।

ইচ্ছেধারী পা

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
ইচ্ছেধারী পা

প্রখর তাপে ঝলসে যাচ্ছে দিনলিপির শরীর 
গর্জে উঠছে না শব্দেরা, হাতচিঠা এসে জমতে চায় 
প্রাচীন শিকারের মতো। মেঘের আঁচল প্রসারিত 
দেখি ছায়াঘর, স্বল্প ঘুমের দেশে সে এক পর্দানশীন  
কোনো লাইনই তাকে রাঙাতে পারে না
আমি নিজের মধ্যেই সমাহিত করি এক অলিখিত চুক্তি 
মধ্যবিত্তের হিসেব। একবার প্রতিলিপি তৈরি হয়ে গেলে  
বিলিয়ে দেবার প্রশ্রয়ও আসে না
একটা বিষণ্ণতার অভাব, নিদেনপক্ষে কিছু বিষাদ  
কেউ কি ফিরে এসে দ্যাখে 
               এই অভিপ্রেত শরীর বেঁচে আছে কিনা?  
এই যে মাঝ নদী, এই যে নৌকাবিহার
এই যে আমাদের ইচ্ছেধারী পা  
একে অপরের দিকে প্যাডেল করে অন্বয় হচ্ছে 
সেসব ত্যাগ করে কেন আমি ডুবে যাব!

ভেতো হাসির গল্প

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০১ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০১ পিএম
ভেতো হাসির গল্প
আঁকা: নিয়াক চৌধুরী তুলি

কেরামত আলীর হাসি আর থামে না।
বড্ড সহজ-সরল নির্বিবাদী মানুষ সে। সারা দিন সারাবেলা হাসিখুশি থাকে। দুঃখ-দৈন্য কখনো তাকে স্পর্শ করে না। পেটপুরে ভাত খাওয়া তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের কাজ। এ আনন্দের সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনাই হয় না। খেতে বসে পেট না ভরলে তার মন ব্যাজার হয়, মাথায় ঠিকমতো কাজ করে না। এমন অঘটন কখনো ঘটলে আমার মায়ের চোখে ব্যাপারটা ঠিকই ধরা পড়ে, কেরামতের মুখের দিকে তাকিয়ে মা তখন বলে, আর দুটো ভাত নিবি কেরু?

কেরু মানে কেরামত আলী মুখ ফুটে কিছুই বলে না, এ প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ অথবা না কোনোটিই পষ্টাপষ্টি জানায় না, কেবল সাদা ফকফকে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হেসে ওঠে। ওই হাসিতেই উত্তর বুঝে নেয় আমার মা। গামলা ভর্তি বাড়তি ভাত এনে কেরুর সামনে বাড়িয়ে ধরে। তরিতরকারি নিয়ে কেরুর বিশেষ ভাবনা নেই। এক বাটি ডালের সঙ্গে গোটা দুই কাঁচা মরিচ হলেই তার পূর্ণ তৃপ্তি। আহার শেষে থালাবাটি ধুয়ে কাঁধের গামছায় হাত-মুখ মোছা হলে তখন শ্বেতপদ্ম ফুটে ওঠে তার মুখের হাসিতে। কালো মানুষের মুখে সাদা দাঁতের কার্পাসফাটা হাসি দেখে আমার মায়েরও মন ভরে যায় তৃপ্তিতে, নিজেও হাসিমুখে ঘোষণা দেয়- এইবার খুশি আমার কেরু পাগল। এইবার যা ইচ্ছে তাই হুকুম করো, কেরুর মুখে আর রা নেই।

কেরামত আলীকে গ্রামের সবাই ডাকে কেরু বলে, কেবল আমার মাকেই দেখেছি তার নামের সঙ্গে পাগলটুকু জুড়ে দিয়ে সস্নেহ আশকারা দিতে। নিজের পেটের তিন পুত্রের মাঝখানে অলক্ষ্যে কোথায় যেন একটুখানি আলগা জায়গা ছেড়ে দেয় মা। সেই জায়গাটুকু সর্বসমক্ষে দৃশ্যমান না হলেও আমি বেশ ধরতে পারি। আমার বড় ভাই এবং মেজো ভাইকে তো আশৈশব তুই-তোকারিই করতে দেখেছি, কেবল আমিই সেটা পারিনি। বাড়ির রাখাল থেকে কৃষাণ হয়েছে কেরু আমাদের চোখের সামনেই, তার সঙ্গে তুই-তোকারিই তো স্বাভাবিকভাবে প্রচলিত এবং বিধিসম্মত। তবু আমি তাকে কেরুভাই বলে সম্মোধন করে এসেছি। আমার চেয়ে শুধু বয়সে বড় নয়, শরীর-স্বাস্থ্যেও কেরামত আলী আমার দ্বিগুণ। এই শরীরেরও তো একটা সম্ভ্রম আছে! বুদ্ধিতে হয়তো কিছুটা পিছিয়ে থাকতে পারে। তা-ই বা নিঃসংশয়ে বলি কী করে! ওই মোটা বুদ্ধি নিয়েই তো দিব্যি সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। নিজে কুচকুচে কালো হয়েও কপালগুণে ফরসা ধবধবে একটা বউ পেয়েছে, তারই পেটে দু-দুটো হৃষ্টপুষ্ট সন্তান পেয়েছে, এসব নিয়ে তার সংসার। আমার বাবা যথার্থই নিজে হাতে গড়েপিটে তাকে সংসারী করে গেছেন। বিয়ের সময় পাত্রের গাত্রবর্ণ নিয়ে একটুখানি খুঁতখুঁতানি উঠলে পাত্রীপক্ষকে গভীর আস্থার সঙ্গে আশ্বস্ত করেছেন- গায়ে-গতরে খেটে কেরু ঠিকই পেটের ভাত জোগাড় করে নেবে। দেখে নিও সবাই, কেরুর কোনোদিন ভাতের অভাব হবে না।

বিয়ের পর আমাদের ভিটে-জমির পুবের কোনায় কেরুর জন্য নতুন ঘর তুলে দেওয়া হয়। সেই ঘরেই তার সংসার-পত্তনি। আমাদের পিতৃ-বিয়োগের পর বিষয়-সম্পত্তি ভাইয়ে-ভাইয়ে ভাগাভাগি হলেও কেরুর ঘরবাড়ি নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি। আমাদের সঙ্গে থেকে শুধু জমিজায়গা নয়, যথার্থই আমাদের সবাইকে আগলেও রাখে সে। দূরবর্তী স্থানে বিবাহিত আমাদের দুই বোনের সঙ্গে যোগাযোগও রাখে সে। তবু কারও কাছে কোনো দাবি নেই। তার চাহিদা খুবই সামান্য এবং সেটুকু নির্দ্বিধায় জানায় আমার মায়ের কাছে। আর কিছু নয়, সে খাবার সময় পেটভরা ভাত চায়। তাহলেই সব বোঝা টানতে পারে, সব হুকুম পালন করতে পারে হাসিমুখে। আসলে সে-ই সার্থক করেছে প্রবাদবাক্য- পেটে খেলে পিঠে সয়, গাধাও তখন বোঝা বয়।

পেটের খাদ্য বলতে কেরু শুধু ভাতই বোঝে। ভাত ছাড়াও আরও কত রকম খাদ্য যে এ দুনিয়ায় আছে, আছে শতেক রকম পিঠেপুলি, সে যে তার খবর রাখে না, তা নয়। কিন্তু তার সব চেয়ে প্রিয় খাবার ভাত। গরম ভাত, পান্তাভাত, কড়কড়ে ভাত, খিচুড়ি ভাত- যেমনই হোক, ভাত হলেই হলো। তার যুক্তি খুবই সোজা- খালা বলো ফুপু বলো মায়ের সমান কে, মাকে পেলে আমি তো আর কিছু  চাইনে। কথায় কথায় এমনি ধারা কাব্যি গাওয়া স্বভাব তার। পেটের ভেতরে কথা জমানোই থাকে, কথার পিঠে কথা বলতে গিয়ে এই সব কাব্যি উগরে দেয় মুখে মুখে। ভাতের কেচ্ছা বলতে বলতে অতি শৈশবে শোনা তার বাপের খিদের গল্পও সে গড়গড় করে বলে যায়। কবে নাকি রাতের আঁধারে কার হেঁসেলে ঢুকে হাপুসহুপুস করে পান্তাভাত খাবার সময় তার বাপ ধরা পড়েছিল একটা কাঁচা মরিচের জন্য। মায়ের কাছে শুনেছে সেই আকালের বছরে ভাত চুরির অপরাধে বেচারা খুব পিটুনি খেয়েছিল। শুধু পিটুনি নয়, আরও নির্মম শাস্তিও সে ভোগ করে। পিঠমোড়া করে দুহাত বেঁধে লাল পিঁপড়ের চাকের ওপরে তাকে ফেলে রাখে। ভাতের জন্য মানুষের এমন শাস্তির কথা শুনে আমরা অনেকেই শিউরে উঠি, কিন্তু ভাতের প্রতি ভক্তি জানাতে কেরামত কাব্যি গেয়ে শোনায়- ভাতই আমার আল্লা রসুল ভাতই ভগবান, ভাতই আমার মানসম্মান ভাতেই অপমান।

ভাতপাগল এই মানুষটি সেদিন হাসপাতালে যাওয়ার পর ডাক্তারের মুখে যে-কথা শুনে আসে, তাতে তার মাথায় বাজ পড়ে। কিন্তু বজ্রপাতের আঘাতে স্তব্ধ মানুষ কখনো হা হা করে উদ্দাম স্রোতের মতো হাসতে পারে! আমাদের কেরামত আলী ওরফে কেরু ভাই হাসে, বাঁধভাঙা হাসির স্রোতে ভাসিয়ে দেয় চারদিক। এমন হাসির উচ্ছ্বাস আগে কখনো দেখিনি।

আমিই তাকে জোর করে ঠেলে পাঠিয়েছিলাম উপজেলা হাসপাতালে, আমার এক ডাক্তার বন্ধুর নামে চিঠি লিখে সেটাও ধরিয়ে দিয়েছিলাম তার হাতে। মাঠেঘাটে কখন অসাবধানে কাঁটাখোঁচের ধাক্কায় তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল কেটে রক্তাত হয়েছে, মাসখানেকের মধ্যে সেই ঘা আর শুকায় না। গ্রাম্য ডাক্তারিতে কাজ না হলে আমি একরকম জোর করেই তাকে হাসপাতালে পাঠাই। আমার বন্ধু ডাক্তার জাহিদ ক্ষতস্থান ধুয়ে মুছে যত্ন করে চিকিৎসা ঠিকই দিয়েছে, কিন্তু রক্ত পরীক্ষার পর তার কানের কাছে ভয়াবহ বোমা ফাটিয়েছে- কেরামত আলীর ডায়াবেটিস না কমলে ঘা শুকোবে না।

ডায়াবেটিস!

কেরামত আলী চমকে উঠলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। এ রোগের নাম তার অজানা নয়। নানান আজগুবি কথা শুনেছে এই রোগ নিয়ে। তবু সাহস করে সে বলে- 

তা হলি সেই রোগেরই ওষুধ দেন আমাকে।

প্রয়োজনীয় ওষুধপত্তর ঠিকই দিয়েছে ডাক্তার, সেই সঙ্গে এক গাদা লেকচার শুনিয়েছে ডায়াবেটিস রোগীর করণীয় সম্পর্কে। সেসব ঠিকই আছে, অসুখ হলে তো ডাক্তারের কথা শুনতেই হয়, তাই বলে ভাতকে বিষ বললে তাও মানতে হবে!

কেরুর তো তখন বুকে খিল লাগার দশা।

ভাত-রুটি-চিঁড়া-মুড়ি- এসবই নাকি ডায়াবেটিস রোগীর জন্য বিষের মতো। ডাক্তার চিনিকে বলে হোয়াইট পয়জন। তাহলে মানুষ বাঁচবে কী খেয়ে? ডাক্তার সে তালিকাও শুনিয়েছে ধৈর্যসহকারে। শুনতে ভালো লাগেনি বলে সে ঠিকমতো মনোযোগ দেয়নি। বরং বিদায় নেওয়ার সময় ভাতের প্রসঙ্গ পুনরায় তুলেছে- ভাত না খালি মানুষ বাঁচে স্যার?

অবশেষে দয়াপরবশ হয়ে ডাক্তার ভাতের বরাদ্দ অনুমোদন করেছে যৎসামান্য। সেই ভাতের পরিমাণ শুনে কেরুর ব্রহ্মচাঁদি ধাঁ করে জ্বলে ওঠে, সহসা আকাশসমান ক্ষুধায় সারা শরীর কাঁপতে থাকে; তখন সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয়।

বাড়ি পৌঁছেই মন ভালো হয়ে যায় কেরামত আলীর। সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা স্ত্রী তার সামনে গামলা ভর্তি ভাত এগিয়ে দেয়। বেগুন ভাজা, কচু শাকের ঘণ্ট, মসুরের ডাল সঙ্গে কাগজি লেবুর ফালি। আহা, নাক ডুবিয়ে খাওয়া যাকে বলে আর কী। এ জন্য কেউ কেউ তাকে মোষের সঙ্গেও তুলনা করে। মোষ তো দাঁত মেলে হাসতে পারে না, কেরু শোনে আর হাসে। তার স্ত্রী মাথায় ঘোমটা টেনে মধুর কটাক্ষ করে- হাসতি নজ্জাও করে না তুমার!

কেরু হাসপাতালের চিকিৎসা-বৃত্তান্ত আমার কাছে শোনাতে আসে সন্ধ্যাবেলায়। বিস্তারিত সব কথা খুলে বলতে চায়, কিন্তু বলা হয় না। হুড়মুড় করে এগিয়ে আসে ভাতের কথা। ভাপ ওঠা ভাত হোক কিংবা বাসি-পচা পান্তাই হোক, পেট পুরে ভাত না খেলে মানুষ বাঁচবে কেমন করে, তাই নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তা তার। সেই দুর্ভাবনার কথাটা ব্যক্ত করতে গিয়েই কেরু ভাইয়ের বুক ঠেলে হাসির গমক উঠে আসে। বাপরে, সে কী বিরামবিহীন হা হা হাসি! সে হাসি থামতেই চায় না। মুখ হা হয়ে চোয়াল আটকে থাকে। হা-ও বন্ধ হয় না, হাসিও থামে না কিছুতেই। এমন বিদঘুটে হাসি হাসতে দেখে আমার একটু একটু ভয় করে, আন্তরিক গলায় আমি তার নাম ধরে ডাকি- কেরু ভাই! শোনো কেরু ভাই!

না, সে আমার ডাক যেন শুনতেই পায় না। ধবধবে সাদা দুপাটি দাঁতের ফাঁকে হা করে সে হাসতেই থাকে, হাসতেই থাকে। আমি ভয়ার্ত হাতে হাস্যোজ্জ্বল মুখটা জড়িয়ে ধরতেই টের পাই তার দুচোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে তপ্ত অশ্রুধারা। এইবার আমি উদ্বেগে শিউরে উঠি- হাসি নয়, কেরামত আলী কি এতক্ষণ তবে কাঁদছে! মানুষের ভেতো হাসি কি এভাবে কান্নার হ্রদে নেমে আসতে পারে!

কেরামত আলীর হাসি অথবা কান্নার ধ্বনি শুনে তার স্ত্রী আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে আসে এবং পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে স্বামীর মুখ।

বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৭ পিএম
বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

‘মানুষ কি চায়- উন্নতি, না আনন্দ? উন্নতি করিয়া কি হইবে যদি তাহাতে আনন্দ না থাকে? আমি এমন কত লোকের কথা জানি, যাহারা জীবনে উন্নতি করিয়াছে বটে, কিন্তু আনন্দকে হারাইয়াছে।... জীবন তাহাদের নিকট একঘেয়ে, একরঙা, অর্থহীন। মন শান-বাঁধানো- রস ঢুকিতে পায় না।’...

বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের হৃদয়ে কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, দিনলিপি ইত্যাদি। জন্ম ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। পৈতৃক নিবাস যশোর জেলায়। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত ও মাতা মৃণালিনী দেবী। সাহিত্যিক-সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯) লেখাটি পছন্দ করে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশ করলে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘অপরাজিত’ (১৯৩২)... এবং গল্পসংকলন ‘মেঘমল্লার’ (১৯৩১)...। মৃত্যু ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র পুরস্কারে’ (১৯৫১) ভূষিত হন।