লাল, নীল, হলুদ ক্ষয়ে যাওয়া রঙের প্রলেপের কারুকাজ করা কাঠের জানালায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়। মফস্বলে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নামায় জানালার পাশের বাতাবি লেবু, কামিনী ফুলের গাছগুলোকে মনে হয় একেকজন অপরিচিত মানুষের ছায়া, ঘরে ঢোকার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। গোলাপজান পালংকে শুয়ে বাইরের আকাশ দেখেন, উনার এ সময় কবিতা মনে পড়ে। প্রতিদিনই মনে হয় লিখবেন কিন্তু সবকিছু মনেই থেকে যায়। উনার শৌখিন স্বামী উনার জন্য কাগজ-কলম এনেছেন কলকাতা থেকে। বাপজানের ওপর উনার খুব অভিমান হয়। আরেকটু কি পড়ালেখা উনাকে করাতে পারতেন না? উনি খেই হারিয়ে ফেলেন, আবার মনে মনে কয়েক লাইন কবিতা লিখে ফেলেন এবং রোজ এই একটা কবিতাই-
‘একদিন একটা লাল রঙা খামে চিঠি দিও,
আমি অপেক্ষায় থাকব।
ডাকপিয়নের সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দের;
এক দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে সোজা চিলেকোঠায়
বুক চেপে চিঠি পড়া হবে সহস্রবার।
ময়ূরের পালক গুজে রাখা ডায়েরিতে লিখব উত্তর।
জানালার বাইরে লেবু ফুলের সুবাস।
বসব রুমাল আর রঙিন সুতো নিয়ে,
হেমফোঁড়ে কাপড়ে আর হৃদয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে
ফুটে উঠবে একটাই কথা- ‘ভুলো না আমায়।’
ইতি,
‘আমি’
মফস্বলে সন্ধ্যের এ সময় প্রতিদিন নিয়ম করে ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। একজন মহিলাকে এসে আলো জ্বালিয়ে রেখে যেতে দেখা যায়, উনি তাকে চেনেন না। না, অনেক কষ্ট করেও মনে করতে পারছেন না। এই মহিলা কে? উনার বাসায় কীভাবে এল? কিন্তু সঙ্গের ছোট ছেলেটাকে উনি চিনতে পারছেন। এটা উনার মেজো ছেলে, ইস্তিয়াক। উনি স্মৃতি হাতড়ে বের করেন, ছেলেটা ফিরনি খেতে খুব পছন্দ করত, প্রতি শুক্রবার বাবার হাত ধরে মসজিদে যেত জুমার নামাজে, ওইটুকুন ছেলে ফেরার সময় যে মিলাদের জিলাপি বা মিষ্টি এটা উনার জন্য নিয়ে আসত। যে পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল। উনাদের পারিবারিক কবরস্থানে ছেলেটার কবর। উনার সেই ছেলেটাও আবার ফিরে এসেছে। উনি নিশ্চিত হলেন। উনি ইস্তিয়াককে কাছে ডাকলেন। সে প্রথমে সেই অপরিচিত মহিলার আঁচল ধরে পেছনে লুকিয়ে ফেলল ছোট শরীরটা, শুধু মাথা বের করে উনার দিকে তাকিয়ে হাসল। এর পর উনার দিকেই এগিয়ে গেল এবং উনাদের দুজনের ভিতর কিছু কথা হলো, যা আর কেউ শোনার মতো নয়, ফিসফিস করে, আবার কখনো ইশারায়। প্রতিদিনকার কাজ এটা। এর পর আসে সেজো ছেলে লতিফ। উনার এই ছেলেটা ধুরন্ধর। কীভাবে এরকম হলো ভেবেই পান না। উনি বা উনার স্বামী কেউই এরকম না। এই ছেলেটা রুমে ঢোকে কোনো না কোনো ধান্ধা নিয়ে। উনার বিয়ের লাল বেনারসি শাড়িটা, সঙ্গে বেগুনি বালুচুড়ি কাতান, যেটা উনার স্বামী প্রথম ছেলে হওয়ার পর এনে দিয়েছিলেন, আরও অনেক শাড়ি, সবই কলকাতা থেকে। উনার বিয়ের ভারী ভারী গয়না সবই এই ছেলেটা তার বউয়ের জন্য চুরি করে নিয়ে গেছে। উনি এখন পরবেন কী? উনার স্বামীও কিছু বলছেন না, কেন কী জানি? উনাকেও তো আশপাশে কোথাও দেখছেন না। সবকিছু উনার কাছে অসহ্য লাগে।
নাহ ,উনি আগামীকালই ছোটছেলে আহসানের কাছে যাবেন। তার এই মা-পাগল ছেলেটাই সবসময়ই দূরে থেকে গেল। সব সন্তানই কাছে-দূরে, আশপাশে। একমাত্র আহসান ছাড়া। বহু বছর আগে মেডিকেলে পড়তে গিয়ে সেই যে বাড়ি ছাড়ল আর ফিরলই না। উনার ইচ্ছে শেষ কটা দিন এই ছেলের কাছেই থাকবেন। এত বছর সংসারের চাপে উনি যেতে পারেননি। এখন যাবেন। লতিফকে বললেন, উনার ব্যাগ গোছানোই আছে। আগামীকাল সকালের ট্রেনের টিকিট কাটা হয়েছে কিনা ঠিকঠাক, আর আহসানকে খবর দেওয়া দরকার, না-হয় স্টেশনে উনাকে কে নিতে আসবে? ছেলেটার জন্য উনি পুলিপিঠা, পাকোয়ান পিঠা তৈরি করে রেখেছেন। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছেন না কেন এখন, সেটা বুঝতে পারছেন না। লতিফের বউ কি সরিয়ে ফেলল কিনা! উনি ঘরের এদিক-সেদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত লতিফ জানাল যে, পিঠার পাতিল, ট্রেনের টিকিট সব ঠিকঠাক আছে, আহসানকেও জানানো হয়েছে। ভয় পাওয়ার কারণ নেই। এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে বলে। কিন্তু গোলাপজান এ ব্যাপারে একটা দ্বিধায় থেকে যায়। লতিফ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কিন্তু পর্দার ওপাশে দাঁড়ানো তার স্ত্রীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে পর্দার ওপাশে দাঁড়ানো দুটো ছায়ামূর্তিকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত দেখে গোলাপজান, আসলে তারা খুবই চিন্তিত উনার শরীরের অবস্থা এত খারাপ দেখে। সব ভাইবোনদের আসার জন্য খবর দেওয়ার কথা চিন্তা করছে এই মুহূর্তে। লতিফ প্রতিদিন সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়ে, মায়ের ঘরে গিয়ে দেখা করে কিছুক্ষণ কথা বলে, এর পর চা খেয়ে আবার ব্যবসার কাজে বেরিয়ে পড়ে। তার অনেকগুলো ব্যবসার ভিতর একটা অ্যান্টিকের ব্যবসা। প্রচুর লাভ থাকে। বিভিন্ন জায়গায়, বাড়িতে সে যায়। যারা পুরাতন সব পালংক, ড্রেসিং টেবিল থেকে শুরু করে নানা আসবাবপত্র, তামা, পিতল, কাঁসা লোহার পুরাতন জিনিসপত্র অল্প দামে ছেড়ে দেয়। হয়তো কেউ কিছুটা আর্থিক সংকটে পড়ে, যা তার বাবা-দাদার আমলে ছিল, এখন আর সেই জৌলুস নেই। আবার কেউ হয়তো এসব জিনিস সরিয়ে আধুনিক সবকিছু দিয়ে ঘর সাজাতে ব্যস্ত। লতিফ এগুলো যে দামে কিনে আনে, তার তিন-চার-পাঁচ গুণ দামে বিক্রি করে। তার অ্যান্টিকের ব্যবসা শুধু এভাবেই থেমে নেই, সে ভারত থেকেও বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তিসহ অনেক কারুকাজ করা জিনিস, বাসনকোসন নিয়ে আসে, যা বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। এগুলোকেও সে অ্যান্টিক বলে চালিয়ে দেয়। তার কিছু দক্ষ কারিগর আছে কাঠের কাজ করার, তারা হুবহু অ্যান্টিকের আদলে বানিয়ে দেয়। তার ঢাকার ক্লায়েন্ট বেশি। তারা এত বোঝে না, ধরতেও পারে না। তারা নামে ‘অ্যান্টিক’ পেলেই খুশি। অনেক উঠতি ধনী লোক এসব ঘরে রেখে জাতে উঠতে চায়। বাসায় যারা আসে, সবাইকে বলে তাদের দাদা ব্রিটিশ পিরিয়ডে এটা বানিয়েছিলেন, এখন এই কাজ পাওয়া যায় না বা এই বাসন তার দাদির, নানির ব্যবহার করা পাকিস্তান আমলের। আসলে এগুলো খুব চড়ামূল্যে কেনা। ক্লায়েন্টও খুশি, লতিফও খুশি। একবার এক কষ্টিপাথরের মূর্তি নিয়ে সে পড়ে বিপদে। কোনো এক প্রত্নত্বত্ত্ব এলাকা খোঁড়ার সময় এই মূর্তি চুরি করে একজন এসে তার কাছে বিক্রি করে। সে আর ক্রয় রসিদ না রেখেই মূর্তি নিজের কাছেই রেখে দেয়। সেই লোক পুলিশের কাছে ধরা পড়ে লতিফের নাম বলে দেয়। এর পর তাকে বহু থানা পুলিশের হ্যাপা পোহাতে হয়েছে। গোলাপজান এসবের কিছুই জানেন না। উনি এই মুহূর্তে হাকিমের চিন্তায় ব্যস্ত। উনার প্রথম জীবনের প্রেমিক। কিন্তু বাপজান জানা মাত্রই উনার জন্য তড়িঘড়ি করে সম্বন্ধ ঠিক করে বিয়ে দিয়ে দিলেন। হাকিম বড় ভালো মানুষ ছিল, অল্প বয়সে বাবা মারা গেল। পড়ালেখা বেশি দূর আর এগোতে পারল না। একটা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করল, সেটাও খুব একটা সুবিধা করতে পারল না। উনার বিয়ের পর এতই কষ্ট পেল যে, সব ছেড়েছুড়ে শহরে চলে গেল। যে বড় হওয়ার জেদ নিয়ে ঢাকায় পা বাড়িয়েছিল, বাস্তবতায় কিছুদিনের ভিতর তা মিইয়ে গেল অফিস কেরানির চাকরিতে। পুরুষ মানুষ কতদিন আর এভাবে থাকবে? একসময় বিয়ে করল, ছেলেপুলে হলো। উনি সব খবর পেতেন। দূর থেকে চাইতেন হাকিম ভালো থাকুক, ছেলেপুলে নিয়ে সুখে থাকুক। কিন্তু সব চাওয়া কি আর পূরণ হয়। হাকিমের বউটা ভালো হয়নি, ছেলেমেয়েগুলো মানুষ হয়নি। এতগুলো মানুষের সবকিছু জোগান দিয়ে হাকিম শেষপর্যন্ত অল্পকটা পেনশনের টাকাও ধরে রাখতে পারেনি। সর্বস্বান্ত, পক্ষাঘাত হয়ে আবার সেই গ্রামে ফিরে এসেছে, উনি সেই সুন্দর চেহারার হাকিমকে দেখে চিনতে পারেননি প্রথমে। নাহ, উনার স্বামীকে বলতে হবে হাকিমের একটা ব্যবস্থা করে দিতে। একটা মানুষ সেই ছোট থেকেই এত কষ্ট করে যাবে আর উনার মতো আপনজন থাকতে তাও আবার, এটা কোনো কথা? উনার বাপজানের চেয়ে স্বামীর মন অনেক বড়। উনি হাকিমের ব্যাপারেও জানেন। একটা ভালো ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে দেবেন। দেখি কালই বলতে হবে সকালে যে সময় উনাকে উনার পছন্দের জাফরান, ঘি দেওয়া হালুয়া খেতে দেওয়া হয়। গোলাপজানের জীবনের যত চাওয়া-পাওয়া এ সময়ই পূরণ হয়েছে বছরের পর বছর। কিন্তু উনার স্বামীকেই তো উনি কোথাও দেখছেন না আজকে।
উনি লতিফকে ইশারায় ডাকেন আবার। উনার পরনে এই সাদামাটা শাড়ি কেন? এর জন্যও অবশ্যই লতিফ আর তার বউ দায়ী। উনার পরনে তো থাকবে এই মুহূর্তে সবুজ রঙা কাঞ্চিভরম। উনি স্বামীর সঙ্গে যাবেন ছবি দেখতে। নতুন ছবি এসেছে। এ সময় উনি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নেন না। আর উনার কাজের মেয়ে কুসুম-ই বা কোথায়? উনার সঙ্গে সেই বিয়ের পর থেকেই আছে, বাপজান সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিল। আহা, কুসুম তেল দিয়ে উনার মাথা বেঁধে দেবে। উনার স্বামী রুপোর কাটা খুব পছন্দ করেন চুলে। আহা, সিনেমা হলের শো তো শুরু হয়ে যাবে। প্রয়োজনের সময় কাউকেই তো পাচ্ছেন না।
উনি ঠোঁট নাড়েন, অস্পষ্ট ভাষায় পড়েন- ‘পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইলো। কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিলো।। রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে। শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।।’ উনি একা একাই হাসেন, কারণ এতক্ষণ পরে উনার স্বামীকে দেখতে পাচ্ছেন, উনি এসে হাতটা ধরলেন। গোলাপজানকে বললেন, ছেলেমেয়েদের ওপর বিশেষ করে লতিফের ওপর যেন এত রাগ পুষে না রাখে। উনি স্বামীর কথায় কিশোরী মেয়েদের মতো মাথা নাড়লেন। উনি দেখলেন হাকিমও উনার পায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে দিব্বি হেঁটে, পক্ষাঘাত মনেই হচ্ছে না। উনি স্বামীকে ইশারায় বললেন হাকিমের একটা ব্যবস্থা করে দিতে। কুসুমকে এতক্ষণ পরে আসতে দেখা গেল কাঁসার বাটিতে জবাকুসুম তেল নিয়ে আসতে। উনি একটা ঝাড়ি দিতে গিয়েও পারলেন না।
পরদিন সকালে আবারও সূর্যের আলো এসে লাল, নীল, হলুদ নকশা করা জানালায় খেলা শুরু করে। বাইরের রৌদ্রে জ্বলজ্বল করা শুভ্র কামিনী ফুল আর ঘরে পালঙ্কের শুভ্র চাদরের ওপর গোলাপজান। উনি শিশুর মতো তার পালংকে ঘুমিয়ে থাকেন। বাইরে থেকে দেখে কেউ বোঝার উপায় নেই উনাকে আর সিনেমার পর্দায় দেখা হবে না অন্য সব চরিত্রের সঙ্গে। কেউ বুঝবে না গত দশ বছর ধরে স্মৃতিভোলা ডিমেনশিয়া রোগে ভোগা গোলাপজান প্রতিদিন তার ছোটছেলের কাছে যেতে চেয়েছেন পছন্দের পিঠা, খাবার নিয়ে, তার আত্মসম্মানবোধ তাকে দিনশেষে নিয়ে যেত কিন্তু সকালেই উনি ভুলে যেতেন। সন্ধ্যায় আবার অস্থির হতেন। খুঁজতেন উনত্রিশ বছর আগে গত হওয়া উনার স্বামীকে, তারও দুই বছর আগে গত হওয়া উনার বিয়ের আগের গরিব কেরানি প্রেমিক হাকিমকে, সাত বছর আগে গত হওয়া কাজের ঝি কুসুমকে। উনার পালঙ্কের চারপাশে সবাই কাঁদছে, পাশে গোলটেবিলে উনার একগাদা ওষুধ কিন্তু উনি তখন ভীষণ ব্যস্ত তৈরি হওয়াতে আরেক জগতের ম্যাটিনি শো দেখার জন্য। অনেক বছর পর এবার সত্যি সত্যিই উনি উনার স্বামীর সঙ্গে আবার সেই বিয়ের পরের মতোই হাত ধরে শো দেখবেন। এবারের শোতেও উনি সবসময়ের মতো ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিচ্ছেন না।