গত সংখ্যার পর
তুমি জানবে হয়তো, ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরুর পর পাকিস্তান রেডিওর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসের কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তা একটি গোপন বেতার কেন্দ্র চালু করেন। কেন্দ্রটির নাম দেন তারা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। এক কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন বেতার ভবনটি পাকিস্তান বাহিনী ধ্বংস করে দিলে প্রবল নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন তারা। এরপর কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ও ট্রান্সমিটার নিয়ে আগরতলায় চলে আসেন। রাজ্য সরকারের সুপারিশ ও কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতায় আগরতলার শালবাগানে নতুন করে চালু করা হয় কেন্দ্রটি। পরের দিকে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়ে পুরোদমে সম্প্রচার শুরু না করা পর্যন্ত বেতার কেন্দ্রটি আগরতলা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার কাজ চালিয়ে গেছে।
তোমাকে আরও একটি ঘটনার কথা বলি।
সম্ভবত ২৭ মার্চ ১৯৭১। পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুনীর আহমদ নামের একজন ছাত্র বর্ডার পাড়ি দিয়ে সর্বপ্রথম আগরতলায় পৌঁছে। ওর সঙ্গী কলকাতার দুজন সাংবাদিক- দীপক ব্যানার্জি ও সুরজিৎ ঘোষাল। কোনোরকম বিপদের কথা না ভেবে পরিস্থিতি দেখার আগ্রহে ওই দুই ভারতীয় সাংবাদিক, এক অর্থে, জীবনবাজি রেখেই পূর্ববঙ্গে ঢুকে পড়ে। সোনামুড়া দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে আটক হয় ওরা। প্রাইমারি ইন্টারগেশনের পর ওদের আগরতলায় আনা হয় এবং একপর্যায়ে সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের নাম বলায় পরিস্থিতি অনুকূলে আসে। ত্রিপুরা বিএসএফের আইজি ছিলেন তখন মি. ভি কে কালিয়া। আমকে ও অনিল বাবুকে- দুজনকেই মি. কালিয়া চিনতেন। মূলত অনিলই বিএসএফ-কে বুঝিয়ে ওদের ছাড়াবার ব্যবস্থা করে এবং সরাসরি ওর মেলারমাঠের বাড়িতে নিয়ে তোলে। বুঝলে, সরকারি এই বাড়িটা ঠিক অনিলের নয়, বরাদ্দ ছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ দপ্তরের কর্মচারী, মানে ওর স্ত্রী সুনন্দার নামে। এই বাড়িটিই শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে আগরতলা-কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের বড় ঠিকানা হয়ে ওঠে। আগে বলেছি কি না মনে পড়ে না, সুনন্দা আমার স্ত্রীর বিভাগেই চাকরি করত, একই হাসপাতালে। যাই হোক, খবরটা জানতে পেরে আমি দ্রুত মেলারমাঠে পৌঁছি। ওদের কাছেই সর্বপ্রথম পাকিস্তান সৈন্যদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ পাই।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে কলকাতার দুজন সাংবাদকর্মী বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং নিহত হন, মল্লিকা ব্যাপারটা জানে। কলকাতা প্রেস ক্লাবে ওদের নাম-পরিচয়ও আছে। কিন্তু অনিল ভট্টাচার্যির বাড়িতে সার্জন দত্ত তাদের দেখেছেন, এটি জেনে মল্লিকার আগ্রহ বেড়ে যায়।
বলেন- স্যার, যতটা শুনেছি পরের দিকে ওরা পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে এবং নিহত হয়।
হ্যাঁ, ওরা দুজনেই নিহত হয়। অনিল ভট্টাচার্যের বাড়িতে কাপড়চোপড় রেখে, সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবারও ঢুকে পড়ে ওরা পূর্ববঙ্গে। আরও কিছু খবর ও ছবি সংগ্রহ করবে। কুমিল্লা কিংবা কাছাকাছি কোনো জায়গায় গিয়ে হঠাৎই সৈন্যদের একটি টহল টিমের সামনে পড়ে যায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রথমে ওদের নামপরিচয় জানতে চায়। ওরা কেউ মিথ্যে বলেনি। একদিকে হিন্দু এবং ভারতীয়, অতএব সৈন্যরা সঙ্গে সঙ্গে দুজনকে গুলি করে হত্যা করে। বুঝলে, এখনো খুব মনে পড়ে, বেশি কিছু বয়স নয়, টকবগে তরুণ। ওই দুজনকে আজও ভুলতে পারিনি আমি। ওদের ব্যাগ, জামাকাপড়, বছরের পর বছর পড়েছিল সুনন্দা-অনিলের মেলারমাঠের বাড়িতে।
এরই মধ্যে আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা সীমান্ত অতিক্রম করলেন। এপ্রিলের ২ তারিখে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে নিজের গাড়ি করে আগরতলায় প্রবেশ করলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল, নুরুল হক এবং খুলনার মহসিন সাহেব। অনিলের বাড়িতেই ওদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। এর পর থেকেই শুরু হয় বিপুল হারে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আগমন। রামগড় হয়ে চলে আসেন চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান, আবদুল হান্নান, এম আর সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ-আল-হারুন ও মোশাররফ হোসেন। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে আরও অনেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় পৌঁছলেন। আওয়ামী লীগের অন্য কেন্দ্রীয় নেতারা যার যার সুবিধাজনক পথে হয় পশ্চিমবঙ্গ, নয় মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশ করলেন।
ত্রিপুরা তখন ইউনিয়ন টেরিটরি- পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়নি। শচীন্দ্র লাল সিংহের কংগ্রেস ক্ষমতায়। নৃপেন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে প্রধান বিরোধী দল মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি- সিপিএম। যার যার রাজনৈতিক অবস্থান রক্ষা করেও সবাই সর্বশক্তি দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়াল। একদিকে সরকার, রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ লাখ লাখ শরণার্থীকে আগলে রাখে, অন্যদিকে বাংলাদেশের সমর্থনে গণসমর্থন সৃষ্টি করে। ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরুর কয়েক দিনের মাথায় আগতলার সাংবাদিক-লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা মাঠে নামেন। ঢাকার হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে ১ এপ্রিল ১৯৭১ লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা আগরতলার পোস্ট অফিস চৌমুহনী থেকে মিছিল বের করেন। ৩ এপ্রিল ১২ ঘণ্টার ‘ত্রিপুরা বন্ধ’ পালিত হয় ছাত্র যুবক শ্রমিক সংগঠনগুলোর ডাকে।
ঢাকায় ২৫ মার্চের সামরিক আগ্রাসন এবং গণহত্যার খবর পত্রপত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায়। ভূপেন দত্ত ভৌমিকের দৈনিক সংবাদ কার্যত বাংলাদেশের পত্রিকা হয়ে যায়। দৈনিক দেশের কথা, জাগরণ ও সাপ্তাহিক সমাচার পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকে জয় বাংলার খবর। এ পরিস্থিতিতে রাজ্যের সবকটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিধানসভায় আলোচনার দাবি তোলে। ২৯ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ বিধানসভায় বাংলাদেশের সমর্থনে সর্বপ্রথম বিবৃতি দেন। সরকার ও বিরোধীদলের মোট ১৫ জন বিধায়ক আলোচনায় অংশ নেন, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন, শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবি জানান।
গণসমর্থন সেখানেই থেমে থাকে না। ঢাকার মাটিতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ছয় দিনের মাথায় ৩১ মার্চ ১৯৭১ রাজ্য আইনসভা সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাস করে। সে প্রস্তাবে পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানো হয়, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তি দাবি করা হয় এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সহমর্মিতা জানানো হয়। একই সঙ্গে ত্রিপুরা বিধানসভা সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের কাছে দাবি জানায়।
কিন্তু এরপরও পরিস্থিতির অবনতি ঠেকানো যায় না। গোটা পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসরদের নিষ্ঠুরতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফলে প্রতিদিন বর্ডার পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করতে থাকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ। এরা সব ধর্মের, সব পেশার; শহরের, বন্দরের, গ্রামের। বিদ্যমান শরণার্থী সংকট মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি শরণার্থীদের জন্য আশু সাহায্যের আবেদন জানিয়ে কেন্দ্রের কাছে জরুরি বার্তা পাঠান। শরণার্থী সমস্যাকে ‘জাতীয় সমস্যা’ হিসেবে বিবেচনা করতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জোর সুপারিশ তোলেন।
চলবে...