ঢাকা ২৫ ভাদ্র ১৪৩১, সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৪, ০২:১৫ পিএম
আপডেট: ০২ আগস্ট ২০২৪, ০৩:৩৮ পিএম
ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা
আঁকা: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

গত সংখ্যার পর

তুমি জানবে হয়তো, ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরুর পর পাকিস্তান রেডিওর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসের কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তা একটি গোপন বেতার কেন্দ্র চালু করেন। কেন্দ্রটির নাম দেন তারা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। এক কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন বেতার ভবনটি পাকিস্তান বাহিনী ধ্বংস করে দিলে প্রবল নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন তারা। এরপর কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ও ট্রান্সমিটার নিয়ে আগরতলায় চলে আসেন। রাজ্য সরকারের সুপারিশ ও কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতায় আগরতলার শালবাগানে নতুন করে চালু করা হয় কেন্দ্রটি। পরের দিকে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়ে পুরোদমে সম্প্রচার শুরু না করা পর্যন্ত বেতার কেন্দ্রটি আগরতলা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার কাজ চালিয়ে গেছে। 

তোমাকে আরও একটি ঘটনার কথা বলি। 

সম্ভবত ২৭ মার্চ ১৯৭১। পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুনীর আহমদ নামের একজন ছাত্র বর্ডার পাড়ি দিয়ে সর্বপ্রথম আগরতলায় পৌঁছে। ওর সঙ্গী কলকাতার দুজন সাংবাদিক- দীপক ব্যানার্জি ও সুরজিৎ ঘোষাল। কোনোরকম বিপদের কথা না ভেবে পরিস্থিতি দেখার আগ্রহে ওই দুই ভারতীয় সাংবাদিক, এক অর্থে, জীবনবাজি রেখেই পূর্ববঙ্গে ঢুকে পড়ে। সোনামুড়া দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে আটক হয় ওরা। প্রাইমারি ইন্টারগেশনের পর ওদের আগরতলায় আনা হয় এবং একপর্যায়ে সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের নাম বলায় পরিস্থিতি অনুকূলে আসে। ত্রিপুরা বিএসএফের আইজি ছিলেন তখন মি. ভি কে কালিয়া। আমকে ও অনিল বাবুকে- দুজনকেই মি. কালিয়া চিনতেন। মূলত অনিলই বিএসএফ-কে বুঝিয়ে ওদের ছাড়াবার ব্যবস্থা করে এবং সরাসরি ওর মেলারমাঠের বাড়িতে নিয়ে তোলে। বুঝলে, সরকারি এই বাড়িটা ঠিক অনিলের নয়, বরাদ্দ ছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ দপ্তরের কর্মচারী, মানে ওর স্ত্রী সুনন্দার নামে। এই বাড়িটিই শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে আগরতলা-কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের বড় ঠিকানা হয়ে ওঠে। আগে বলেছি কি না মনে পড়ে না, সুনন্দা আমার স্ত্রীর বিভাগেই চাকরি করত, একই হাসপাতালে। যাই হোক, খবরটা জানতে পেরে আমি দ্রুত মেলারমাঠে পৌঁছি। ওদের কাছেই সর্বপ্রথম পাকিস্তান সৈন্যদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ পাই। 

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে কলকাতার দুজন সাংবাদকর্মী বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং নিহত হন, মল্লিকা ব্যাপারটা জানে। কলকাতা প্রেস ক্লাবে ওদের নাম-পরিচয়ও আছে। কিন্তু অনিল ভট্টাচার্যির বাড়িতে সার্জন দত্ত তাদের দেখেছেন, এটি জেনে মল্লিকার আগ্রহ বেড়ে যায়। 

বলেন- স্যার, যতটা শুনেছি পরের দিকে ওরা পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে এবং নিহত হয়। 

হ্যাঁ, ওরা দুজনেই নিহত হয়। অনিল ভট্টাচার্যের বাড়িতে কাপড়চোপড় রেখে, সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবারও ঢুকে পড়ে ওরা পূর্ববঙ্গে। আরও কিছু খবর ও ছবি সংগ্রহ করবে। কুমিল্লা কিংবা কাছাকাছি কোনো জায়গায় গিয়ে হঠাৎই সৈন্যদের একটি টহল টিমের সামনে পড়ে যায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রথমে ওদের নামপরিচয় জানতে চায়। ওরা কেউ মিথ্যে বলেনি। একদিকে হিন্দু এবং ভারতীয়, অতএব সৈন্যরা সঙ্গে সঙ্গে দুজনকে গুলি করে হত্যা করে। বুঝলে, এখনো খুব মনে পড়ে, বেশি কিছু বয়স নয়, টকবগে তরুণ। ওই দুজনকে আজও ভুলতে পারিনি আমি। ওদের ব্যাগ, জামাকাপড়, বছরের পর বছর পড়েছিল সুনন্দা-অনিলের মেলারমাঠের বাড়িতে। 

এরই মধ্যে আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা সীমান্ত অতিক্রম করলেন। এপ্রিলের ২ তারিখে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে নিজের গাড়ি করে আগরতলায় প্রবেশ করলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল, নুরুল হক এবং খুলনার মহসিন সাহেব। অনিলের বাড়িতেই ওদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। এর পর থেকেই শুরু হয় বিপুল হারে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আগমন। রামগড় হয়ে চলে আসেন চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান, আবদুল হান্নান, এম আর সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ-আল-হারুন ও মোশাররফ হোসেন। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে আরও অনেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় পৌঁছলেন। আওয়ামী লীগের অন্য কেন্দ্রীয় নেতারা যার যার সুবিধাজনক পথে হয় পশ্চিমবঙ্গ, নয় মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশ করলেন। 

ত্রিপুরা তখন ইউনিয়ন টেরিটরি- পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়নি। শচীন্দ্র লাল সিংহের কংগ্রেস ক্ষমতায়। নৃপেন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে প্রধান বিরোধী দল মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি- সিপিএম। যার যার রাজনৈতিক অবস্থান রক্ষা করেও সবাই সর্বশক্তি দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়াল। একদিকে সরকার, রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ লাখ লাখ শরণার্থীকে আগলে রাখে, অন্যদিকে বাংলাদেশের সমর্থনে গণসমর্থন সৃষ্টি করে। ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরুর কয়েক দিনের মাথায় আগতলার সাংবাদিক-লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা মাঠে নামেন। ঢাকার হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে ১ এপ্রিল ১৯৭১ লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা আগরতলার পোস্ট অফিস চৌমুহনী থেকে মিছিল বের করেন। ৩ এপ্রিল ১২ ঘণ্টার ‘ত্রিপুরা বন্ধ’ পালিত হয় ছাত্র যুবক শ্রমিক সংগঠনগুলোর ডাকে। 

ঢাকায় ২৫ মার্চের সামরিক আগ্রাসন এবং গণহত্যার খবর পত্রপত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায়। ভূপেন দত্ত ভৌমিকের দৈনিক সংবাদ কার্যত বাংলাদেশের পত্রিকা হয়ে যায়। দৈনিক দেশের কথা, জাগরণ ও সাপ্তাহিক সমাচার পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকে জয় বাংলার খবর। এ পরিস্থিতিতে রাজ্যের সবকটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিধানসভায় আলোচনার দাবি তোলে। ২৯ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ বিধানসভায় বাংলাদেশের সমর্থনে সর্বপ্রথম বিবৃতি দেন। সরকার ও বিরোধীদলের মোট ১৫ জন বিধায়ক আলোচনায় অংশ নেন, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন, শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবি জানান। 

গণসমর্থন সেখানেই থেমে থাকে না। ঢাকার মাটিতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ছয় দিনের মাথায় ৩১ মার্চ ১৯৭১ রাজ্য আইনসভা সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাস করে। সে প্রস্তাবে পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানো হয়, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তি দাবি করা হয় এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সহমর্মিতা জানানো হয়। একই সঙ্গে ত্রিপুরা বিধানসভা সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের কাছে দাবি জানায়। 

কিন্তু এরপরও পরিস্থিতির অবনতি ঠেকানো যায় না। গোটা পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসরদের নিষ্ঠুরতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফলে প্রতিদিন বর্ডার পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করতে থাকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ। এরা সব ধর্মের, সব পেশার; শহরের, বন্দরের, গ্রামের। বিদ্যমান শরণার্থী সংকট মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি শরণার্থীদের জন্য আশু সাহায্যের আবেদন জানিয়ে কেন্দ্রের কাছে জরুরি বার্তা পাঠান। শরণার্থী সমস্যাকে ‘জাতীয় সমস্যা’ হিসেবে বিবেচনা করতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জোর সুপারিশ তোলেন।

চলবে...

১ম পর্ব

২য় পর্ব

৩য় পর্ব

৪র্থ পর্ব

৫ম পর্ব

৬ষ্ঠ পর্ব

৭ম পর্ব

৮ম পর্ব

৯ম পর্ব

১০ম পর্ব

১১তম পর্ব

তোমাকেও ছোঁবে

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
তোমাকেও ছোঁবে

ভেবো না, তোমাকেও ছোঁবে হিমেল বাতাস
আঁচড়ে দেবে
জীবনের বেলাভূমি
স্বপ্নগুলো উড়ে যাবে বৈশাখী বাতাসে
তোমার বাড়ি তার ভেতরের ঘর
প্রিয় সংগ্রহগুলো
থাকবে না কিছুই-

ভেঙে পড়বে চৈতন্যের কাঠামো
দড়ি বর্গা খড়খড়ি দরজা ধানের মটকা
স্মৃতিময় মুখগুলো হারিয়ে যাবে
ছোঁবে, তোমাকে ছুঁয়ে যাবে
হিমেল বাতাস
থেমে যাবে স্পন্দন
ধূসর প্রদেশে হবে শেষ গন্তব্য তোমার
ফিরবে না আর আলোকিত
নাগরিক কোলাহলে
ভেবো না, ছোঁবে
তোমাকেও-

নষ্টনীড় কাঁধ

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৬ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
নষ্টনীড় কাঁধ

আঁজলায় জমানো ছিল ভোরের কাজল, হৃদি কল্লোল,
দিঘিজল ছোঁয়া ধূলিওড়া লাবণ্য মেঠোপথ।
থাকেনি সেইসব ঐশ্বর্য অপার। তার পর কে যেন কবে
বলেছিল, ‘দাঁড়াও সুপান্থ, পশ্চাতে নদী, এনে দেব
দু’হাতে তোমার, বিহঙ্গ জোয়ার।
কবে কোন দেবদারু রাতে ডেকেছিল রোদরাঙা চাঁদ
                     পেতেছিল শুদ্ধ জলের ছায়ায় শয্যা শোয়ার।
আহা, কার যেন রিনিঝিনি হাত ছুঁয়েছিল নষ্ট নীড় কাঁধ।
তার পর সেই আঁজলা, নদী, চাঁদ, সেই রিনিঝিনি হাত
ঝুলে আছে দ্যাখো, দ্যাখো, একলা হাওয়ায়।

ইচ্ছেধারী পা

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
ইচ্ছেধারী পা

প্রখর তাপে ঝলসে যাচ্ছে দিনলিপির শরীর 
গর্জে উঠছে না শব্দেরা, হাতচিঠা এসে জমতে চায় 
প্রাচীন শিকারের মতো। মেঘের আঁচল প্রসারিত 
দেখি ছায়াঘর, স্বল্প ঘুমের দেশে সে এক পর্দানশীন  
কোনো লাইনই তাকে রাঙাতে পারে না
আমি নিজের মধ্যেই সমাহিত করি এক অলিখিত চুক্তি 
মধ্যবিত্তের হিসেব। একবার প্রতিলিপি তৈরি হয়ে গেলে  
বিলিয়ে দেবার প্রশ্রয়ও আসে না
একটা বিষণ্ণতার অভাব, নিদেনপক্ষে কিছু বিষাদ  
কেউ কি ফিরে এসে দ্যাখে 
               এই অভিপ্রেত শরীর বেঁচে আছে কিনা?  
এই যে মাঝ নদী, এই যে নৌকাবিহার
এই যে আমাদের ইচ্ছেধারী পা  
একে অপরের দিকে প্যাডেল করে অন্বয় হচ্ছে 
সেসব ত্যাগ করে কেন আমি ডুবে যাব!

ভেতো হাসির গল্প

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০১ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০১ পিএম
ভেতো হাসির গল্প
আঁকা: নিয়াক চৌধুরী তুলি

কেরামত আলীর হাসি আর থামে না।
বড্ড সহজ-সরল নির্বিবাদী মানুষ সে। সারা দিন সারাবেলা হাসিখুশি থাকে। দুঃখ-দৈন্য কখনো তাকে স্পর্শ করে না। পেটপুরে ভাত খাওয়া তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের কাজ। এ আনন্দের সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনাই হয় না। খেতে বসে পেট না ভরলে তার মন ব্যাজার হয়, মাথায় ঠিকমতো কাজ করে না। এমন অঘটন কখনো ঘটলে আমার মায়ের চোখে ব্যাপারটা ঠিকই ধরা পড়ে, কেরামতের মুখের দিকে তাকিয়ে মা তখন বলে, আর দুটো ভাত নিবি কেরু?

কেরু মানে কেরামত আলী মুখ ফুটে কিছুই বলে না, এ প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ অথবা না কোনোটিই পষ্টাপষ্টি জানায় না, কেবল সাদা ফকফকে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হেসে ওঠে। ওই হাসিতেই উত্তর বুঝে নেয় আমার মা। গামলা ভর্তি বাড়তি ভাত এনে কেরুর সামনে বাড়িয়ে ধরে। তরিতরকারি নিয়ে কেরুর বিশেষ ভাবনা নেই। এক বাটি ডালের সঙ্গে গোটা দুই কাঁচা মরিচ হলেই তার পূর্ণ তৃপ্তি। আহার শেষে থালাবাটি ধুয়ে কাঁধের গামছায় হাত-মুখ মোছা হলে তখন শ্বেতপদ্ম ফুটে ওঠে তার মুখের হাসিতে। কালো মানুষের মুখে সাদা দাঁতের কার্পাসফাটা হাসি দেখে আমার মায়েরও মন ভরে যায় তৃপ্তিতে, নিজেও হাসিমুখে ঘোষণা দেয়- এইবার খুশি আমার কেরু পাগল। এইবার যা ইচ্ছে তাই হুকুম করো, কেরুর মুখে আর রা নেই।

কেরামত আলীকে গ্রামের সবাই ডাকে কেরু বলে, কেবল আমার মাকেই দেখেছি তার নামের সঙ্গে পাগলটুকু জুড়ে দিয়ে সস্নেহ আশকারা দিতে। নিজের পেটের তিন পুত্রের মাঝখানে অলক্ষ্যে কোথায় যেন একটুখানি আলগা জায়গা ছেড়ে দেয় মা। সেই জায়গাটুকু সর্বসমক্ষে দৃশ্যমান না হলেও আমি বেশ ধরতে পারি। আমার বড় ভাই এবং মেজো ভাইকে তো আশৈশব তুই-তোকারিই করতে দেখেছি, কেবল আমিই সেটা পারিনি। বাড়ির রাখাল থেকে কৃষাণ হয়েছে কেরু আমাদের চোখের সামনেই, তার সঙ্গে তুই-তোকারিই তো স্বাভাবিকভাবে প্রচলিত এবং বিধিসম্মত। তবু আমি তাকে কেরুভাই বলে সম্মোধন করে এসেছি। আমার চেয়ে শুধু বয়সে বড় নয়, শরীর-স্বাস্থ্যেও কেরামত আলী আমার দ্বিগুণ। এই শরীরেরও তো একটা সম্ভ্রম আছে! বুদ্ধিতে হয়তো কিছুটা পিছিয়ে থাকতে পারে। তা-ই বা নিঃসংশয়ে বলি কী করে! ওই মোটা বুদ্ধি নিয়েই তো দিব্যি সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। নিজে কুচকুচে কালো হয়েও কপালগুণে ফরসা ধবধবে একটা বউ পেয়েছে, তারই পেটে দু-দুটো হৃষ্টপুষ্ট সন্তান পেয়েছে, এসব নিয়ে তার সংসার। আমার বাবা যথার্থই নিজে হাতে গড়েপিটে তাকে সংসারী করে গেছেন। বিয়ের সময় পাত্রের গাত্রবর্ণ নিয়ে একটুখানি খুঁতখুঁতানি উঠলে পাত্রীপক্ষকে গভীর আস্থার সঙ্গে আশ্বস্ত করেছেন- গায়ে-গতরে খেটে কেরু ঠিকই পেটের ভাত জোগাড় করে নেবে। দেখে নিও সবাই, কেরুর কোনোদিন ভাতের অভাব হবে না।

বিয়ের পর আমাদের ভিটে-জমির পুবের কোনায় কেরুর জন্য নতুন ঘর তুলে দেওয়া হয়। সেই ঘরেই তার সংসার-পত্তনি। আমাদের পিতৃ-বিয়োগের পর বিষয়-সম্পত্তি ভাইয়ে-ভাইয়ে ভাগাভাগি হলেও কেরুর ঘরবাড়ি নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি। আমাদের সঙ্গে থেকে শুধু জমিজায়গা নয়, যথার্থই আমাদের সবাইকে আগলেও রাখে সে। দূরবর্তী স্থানে বিবাহিত আমাদের দুই বোনের সঙ্গে যোগাযোগও রাখে সে। তবু কারও কাছে কোনো দাবি নেই। তার চাহিদা খুবই সামান্য এবং সেটুকু নির্দ্বিধায় জানায় আমার মায়ের কাছে। আর কিছু নয়, সে খাবার সময় পেটভরা ভাত চায়। তাহলেই সব বোঝা টানতে পারে, সব হুকুম পালন করতে পারে হাসিমুখে। আসলে সে-ই সার্থক করেছে প্রবাদবাক্য- পেটে খেলে পিঠে সয়, গাধাও তখন বোঝা বয়।

পেটের খাদ্য বলতে কেরু শুধু ভাতই বোঝে। ভাত ছাড়াও আরও কত রকম খাদ্য যে এ দুনিয়ায় আছে, আছে শতেক রকম পিঠেপুলি, সে যে তার খবর রাখে না, তা নয়। কিন্তু তার সব চেয়ে প্রিয় খাবার ভাত। গরম ভাত, পান্তাভাত, কড়কড়ে ভাত, খিচুড়ি ভাত- যেমনই হোক, ভাত হলেই হলো। তার যুক্তি খুবই সোজা- খালা বলো ফুপু বলো মায়ের সমান কে, মাকে পেলে আমি তো আর কিছু  চাইনে। কথায় কথায় এমনি ধারা কাব্যি গাওয়া স্বভাব তার। পেটের ভেতরে কথা জমানোই থাকে, কথার পিঠে কথা বলতে গিয়ে এই সব কাব্যি উগরে দেয় মুখে মুখে। ভাতের কেচ্ছা বলতে বলতে অতি শৈশবে শোনা তার বাপের খিদের গল্পও সে গড়গড় করে বলে যায়। কবে নাকি রাতের আঁধারে কার হেঁসেলে ঢুকে হাপুসহুপুস করে পান্তাভাত খাবার সময় তার বাপ ধরা পড়েছিল একটা কাঁচা মরিচের জন্য। মায়ের কাছে শুনেছে সেই আকালের বছরে ভাত চুরির অপরাধে বেচারা খুব পিটুনি খেয়েছিল। শুধু পিটুনি নয়, আরও নির্মম শাস্তিও সে ভোগ করে। পিঠমোড়া করে দুহাত বেঁধে লাল পিঁপড়ের চাকের ওপরে তাকে ফেলে রাখে। ভাতের জন্য মানুষের এমন শাস্তির কথা শুনে আমরা অনেকেই শিউরে উঠি, কিন্তু ভাতের প্রতি ভক্তি জানাতে কেরামত কাব্যি গেয়ে শোনায়- ভাতই আমার আল্লা রসুল ভাতই ভগবান, ভাতই আমার মানসম্মান ভাতেই অপমান।

ভাতপাগল এই মানুষটি সেদিন হাসপাতালে যাওয়ার পর ডাক্তারের মুখে যে-কথা শুনে আসে, তাতে তার মাথায় বাজ পড়ে। কিন্তু বজ্রপাতের আঘাতে স্তব্ধ মানুষ কখনো হা হা করে উদ্দাম স্রোতের মতো হাসতে পারে! আমাদের কেরামত আলী ওরফে কেরু ভাই হাসে, বাঁধভাঙা হাসির স্রোতে ভাসিয়ে দেয় চারদিক। এমন হাসির উচ্ছ্বাস আগে কখনো দেখিনি।

আমিই তাকে জোর করে ঠেলে পাঠিয়েছিলাম উপজেলা হাসপাতালে, আমার এক ডাক্তার বন্ধুর নামে চিঠি লিখে সেটাও ধরিয়ে দিয়েছিলাম তার হাতে। মাঠেঘাটে কখন অসাবধানে কাঁটাখোঁচের ধাক্কায় তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল কেটে রক্তাত হয়েছে, মাসখানেকের মধ্যে সেই ঘা আর শুকায় না। গ্রাম্য ডাক্তারিতে কাজ না হলে আমি একরকম জোর করেই তাকে হাসপাতালে পাঠাই। আমার বন্ধু ডাক্তার জাহিদ ক্ষতস্থান ধুয়ে মুছে যত্ন করে চিকিৎসা ঠিকই দিয়েছে, কিন্তু রক্ত পরীক্ষার পর তার কানের কাছে ভয়াবহ বোমা ফাটিয়েছে- কেরামত আলীর ডায়াবেটিস না কমলে ঘা শুকোবে না।

ডায়াবেটিস!

কেরামত আলী চমকে উঠলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। এ রোগের নাম তার অজানা নয়। নানান আজগুবি কথা শুনেছে এই রোগ নিয়ে। তবু সাহস করে সে বলে- 

তা হলি সেই রোগেরই ওষুধ দেন আমাকে।

প্রয়োজনীয় ওষুধপত্তর ঠিকই দিয়েছে ডাক্তার, সেই সঙ্গে এক গাদা লেকচার শুনিয়েছে ডায়াবেটিস রোগীর করণীয় সম্পর্কে। সেসব ঠিকই আছে, অসুখ হলে তো ডাক্তারের কথা শুনতেই হয়, তাই বলে ভাতকে বিষ বললে তাও মানতে হবে!

কেরুর তো তখন বুকে খিল লাগার দশা।

ভাত-রুটি-চিঁড়া-মুড়ি- এসবই নাকি ডায়াবেটিস রোগীর জন্য বিষের মতো। ডাক্তার চিনিকে বলে হোয়াইট পয়জন। তাহলে মানুষ বাঁচবে কী খেয়ে? ডাক্তার সে তালিকাও শুনিয়েছে ধৈর্যসহকারে। শুনতে ভালো লাগেনি বলে সে ঠিকমতো মনোযোগ দেয়নি। বরং বিদায় নেওয়ার সময় ভাতের প্রসঙ্গ পুনরায় তুলেছে- ভাত না খালি মানুষ বাঁচে স্যার?

অবশেষে দয়াপরবশ হয়ে ডাক্তার ভাতের বরাদ্দ অনুমোদন করেছে যৎসামান্য। সেই ভাতের পরিমাণ শুনে কেরুর ব্রহ্মচাঁদি ধাঁ করে জ্বলে ওঠে, সহসা আকাশসমান ক্ষুধায় সারা শরীর কাঁপতে থাকে; তখন সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয়।

বাড়ি পৌঁছেই মন ভালো হয়ে যায় কেরামত আলীর। সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা স্ত্রী তার সামনে গামলা ভর্তি ভাত এগিয়ে দেয়। বেগুন ভাজা, কচু শাকের ঘণ্ট, মসুরের ডাল সঙ্গে কাগজি লেবুর ফালি। আহা, নাক ডুবিয়ে খাওয়া যাকে বলে আর কী। এ জন্য কেউ কেউ তাকে মোষের সঙ্গেও তুলনা করে। মোষ তো দাঁত মেলে হাসতে পারে না, কেরু শোনে আর হাসে। তার স্ত্রী মাথায় ঘোমটা টেনে মধুর কটাক্ষ করে- হাসতি নজ্জাও করে না তুমার!

কেরু হাসপাতালের চিকিৎসা-বৃত্তান্ত আমার কাছে শোনাতে আসে সন্ধ্যাবেলায়। বিস্তারিত সব কথা খুলে বলতে চায়, কিন্তু বলা হয় না। হুড়মুড় করে এগিয়ে আসে ভাতের কথা। ভাপ ওঠা ভাত হোক কিংবা বাসি-পচা পান্তাই হোক, পেট পুরে ভাত না খেলে মানুষ বাঁচবে কেমন করে, তাই নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তা তার। সেই দুর্ভাবনার কথাটা ব্যক্ত করতে গিয়েই কেরু ভাইয়ের বুক ঠেলে হাসির গমক উঠে আসে। বাপরে, সে কী বিরামবিহীন হা হা হাসি! সে হাসি থামতেই চায় না। মুখ হা হয়ে চোয়াল আটকে থাকে। হা-ও বন্ধ হয় না, হাসিও থামে না কিছুতেই। এমন বিদঘুটে হাসি হাসতে দেখে আমার একটু একটু ভয় করে, আন্তরিক গলায় আমি তার নাম ধরে ডাকি- কেরু ভাই! শোনো কেরু ভাই!

না, সে আমার ডাক যেন শুনতেই পায় না। ধবধবে সাদা দুপাটি দাঁতের ফাঁকে হা করে সে হাসতেই থাকে, হাসতেই থাকে। আমি ভয়ার্ত হাতে হাস্যোজ্জ্বল মুখটা জড়িয়ে ধরতেই টের পাই তার দুচোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে তপ্ত অশ্রুধারা। এইবার আমি উদ্বেগে শিউরে উঠি- হাসি নয়, কেরামত আলী কি এতক্ষণ তবে কাঁদছে! মানুষের ভেতো হাসি কি এভাবে কান্নার হ্রদে নেমে আসতে পারে!

কেরামত আলীর হাসি অথবা কান্নার ধ্বনি শুনে তার স্ত্রী আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে আসে এবং পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে স্বামীর মুখ।

বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৭ পিএম
বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

‘মানুষ কি চায়- উন্নতি, না আনন্দ? উন্নতি করিয়া কি হইবে যদি তাহাতে আনন্দ না থাকে? আমি এমন কত লোকের কথা জানি, যাহারা জীবনে উন্নতি করিয়াছে বটে, কিন্তু আনন্দকে হারাইয়াছে।... জীবন তাহাদের নিকট একঘেয়ে, একরঙা, অর্থহীন। মন শান-বাঁধানো- রস ঢুকিতে পায় না।’...

বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের হৃদয়ে কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, দিনলিপি ইত্যাদি। জন্ম ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। পৈতৃক নিবাস যশোর জেলায়। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত ও মাতা মৃণালিনী দেবী। সাহিত্যিক-সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯) লেখাটি পছন্দ করে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশ করলে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘অপরাজিত’ (১৯৩২)... এবং গল্পসংকলন ‘মেঘমল্লার’ (১৯৩১)...। মৃত্যু ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র পুরস্কারে’ (১৯৫১) ভূষিত হন।