শিল্পী এস এম সুলতান লোককথার এক নায়ক। একজন প্রকৃত জীবনশিল্পী, একজন সাধক। যার স্বপ্ন ছিল জীবনে শিল্পের প্রতিফলন ঘটানো। সুলতানের ভালোবাসা ছিল মানুষের প্রতি, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ ও কৃষকের প্রতি। বাংলার গ্রাম্য সমাজের প্রতি। বাংলাদেশের কৃষকায় নিরন্ন কৃষককে তিনি ক্যানভাসে তুলে এনেছেন অমিত শক্তিধর, বলশালী মানুষ হিসেবে। সুলতান ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমিক- এ দেশের আবহমান সবুজ-সতেজ প্রকৃতি তার তুলিতে উদ্ভাসিত হয়েছে। তেমনি তিনি ছিলেন প্রাণিপ্রেমিক। পশুপাখির সঙ্গে কথা বলতেন, বুঝতেন তিনি বৃক্ষের ভাষাও।
আর ছিলেন শিশুদের অকৃত্রিম সহজাত বন্ধু।…
নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট শিল্পী এস এম সুলতানের জন্ম এবং ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন শিল্পের এই মহাপুরুষ। তার পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান, ডাক নাম লাল মিয়া। দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয়েছিল তার। পিতা ছিলেন রাজমিস্ত্রি। দারিদ্র্য তার চলার পথে অন্তরায় হতে পারেনি। কলকাতা আর্ট স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। সান্নিধ্য পেয়েছেন শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর মতো বরেণ্য শিল্পসমালোচকদের। কোথাও স্থিত হওয়া, শিকড় গেঁথে বসা এসবে ছিল শিল্পীর অনীহা। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন ছন্নছাড়া ভবঘুরে, দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ানোতে ছিল তার আনন্দ।
সুলতান ১৯২৮ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে মাত্র পাঁচ বছর শিক্ষা গ্রহণের পর স্কুল ছেড়ে বাবার সঙ্গে জোগালির কাজ শুরু করেন। শৈশব থেকেই শিল্পীর মনে আঁকিবুকির নেশা। স্বভাবশিল্পীর চোখে ধরা দেয় গ্রামবাংলার নিসর্গ দৃশ্য আর মানুষের মুখ। স্বভাবশিল্পীকে হাতছানি দেয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা। ঘর ছাড়েন তিনি। চলে যান কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার আশায়। ১৯৪১ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েও এন্ট্রেস পাস না হওয়ায় আর্ট স্কুল কর্তৃপক্ষ নারাজ ছিলেন ভর্তি নিতে। পরে শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সহায়তায় শিক্ষালাভের সুযোগ হয়। এখানে তিন বছর শিক্ষা গ্রহণের পর সুলতান আর্ট স্কুল ত্যাগ করেন।
আর্ট স্কুলের নিয়মমাফিক পাঠ্যক্রম শেষ না হতেই ১৯৪৪ সালে সুলতান বেরিয়ে পড়লেন ভারতভ্রমণে। কিছুদিন ভূস্বর্গ কাশ্মীরে কাটিয়েছিলেন। এখানে বছর দুই থাকার পর গেলেন নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের করাচি। তখন শিল্পীর বয়স উনিশ বা কুড়ি। করাচিতে ধনবান শিল্পরসিক পার্সি সমাজের বাস। ব্যক্তিগত সম্পর্কে দু-একজনের প্রতিকৃতি ছাড়া সুলতান বড় বড় ছবি আঁকলেন অনাড়ম্বর স্বল্পাহার-অনাহারক্লিষ্ট শরণার্থী মোহাজেরদের নিয়ে। ছিন্নমূল পরিবারগুলোর আর্তচেহারা ও কাফেলার আখ্যান হয়ে দাঁড়াল তার জলচিত্র, তেলচিত্র ও রেখাচিত্রের প্রধান বিষয়। পঞ্চাশের গোড়ার দিকে যখন তার বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ, লাহোর-করাচিতে সুলতান তখন রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী তরুণ শিল্পী। ভ্যানগগের অংকনশৈলী পদ্ধতিতে তিনি তেলরঙের আকর্ষণীয় ল্যান্ডস্কেপ আঁকতেন গ্রামবাংলার।
সুলতান ১৯৫১ সালের দিকে আমেরিকা যান, সুযোগ ঘটে ইউরোপ ভ্রমণেরও। প্রবাসজীবনে তিনি ছবি এঁকেছেন, প্রদর্শনীও করেছেন। সে সময় লন্ডনে একটি প্রদর্শনীতে শিল্পী সুলতানের ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল পিকাসো, পল ক্লিদের সঙ্গে। ১৯৫৩-তে ত্রিশোর্ধ শিল্পী ফিরে আসেন স্বদেশে, তার জন্মস্থান নড়াইলে। এখানে এসে শিশুদের সুকুমার শিল্পের স্পর্শ দিতে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নন্দনকানন’ বিদ্যালয়। এর পর তিনি আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণায় আত্মনিয়োগ করেন। এরকম চলল ১৯৬৮ পর্যন্ত। তার পর ফিরে আসেন ছবির জগতে, নড়াইলে ‘ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে খুলনা ক্লাবে প্রদর্শনীও করেছিলেন। আশির দশক থেকে তিনি নড়াইলে সংসারী জীবনযাপন শুরু করেন। চিরকুমার সুলতানের সংসার বলতে তার প্রিয় কিছু পশুপাখি এবং শিশুরা। পরবর্তীতে শিশুদের জন্য গড়েছিলেন শিশুস্বর্গ, পশুপাখির জন্য অভয়াশ্রম।
১৯৭৬ সালে এস এম সুলতান ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমির পৃষ্ঠপোষকতায় চিত্র প্রদর্শনী করে সুধী ও সাধারণ শিল্পোৎসাহীদের আলোচ্য হয়ে ওঠেন। শিল্পবোদ্ধাদের অনেকে তার ভক্ত ও নিত্যসহচর হয়ে পড়েন। পরবর্তী তিন দশকে সুলতানের আঁকা বৈশিষ্ট্যগুলো তেমনভাবে পরিবর্তিত হয়নি বরং আরও জোরালো হয়েছে। কর্মী মানুষ, উৎপাদনকারী মানুষ, অর্থনৈতিক ভিত্তির মূল স্থপতি যে মানুষ, এরাই সুলতানের চিত্রকলার মূল নায়ক-নায়িকা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মানুষ যে কৃষক ও কৃষক-পরিবার, এই বিষয়টি অতি স্বচ্ছ সুলতানের কাছে। বাংলার কৃষক ও অর্থনীতি যে এখনো মূলত প্রকৃতিনির্ভর, এই সত্যও সুলতানের কাছে অত্যন্ত পরিষ্কার।
সুলতানের চিত্রকলার বক্তব্য বা বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিক ও কলাকৌশল উভয়ই তার ব্যক্তিত্বের মতো আকর্ষণীয়। স্পষ্টতই সুলতানের মুখ্য বিষয় মানুষ ও প্রকৃতি। তার মানুষ সাধারণ অর্থের মানুষ, আবার বিশেষ অর্থে বাংলার মানুষ, আরও বিশেষত শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ, খেতখামার, গ্রামবাংলার মানুষ। তিনি এঁকেছেন মাঠেঘাটে কর্মরত কৃষককে। নদীতে, জলাশয়ে মাছ ধরতে ব্যস্ত যে মানুষ তাকে। গৃহকর্মে লিপ্ত গৃহবধূকে। গ্রামবাংলার সমাজে কলহে বা সংঘাতে লিপ্ত মানুষকে। আবার প্রেমিক মানুষকে।
সুলতানের ছবির একটি বৈশিষ্ট্য বাংলার কৃষকের শরীরকে পেশিবহুল বিশাল ও শক্তিশালী করে দেখানো। অথচ বাঙালি কৃষকের মতো শীর্ণ, দুর্বল দেহ পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। এই দুর্বলদেহ চাষি সুলতানের কাছে অসীম শক্তির অধিকারী। সুলতানের ক্যানভাসে বাঙালি পুরুষের চেহারা শক্তিশালী ও পৌরষদীপ্ত, মহিলারা সুগঠিত অথচ কমনীয়।
মানুষ ছাড়াও ‘প্রকৃতি’ ছিল সুলতানের এক প্রিয় বিষয়বস্তু। মানুষ তার কাছে যেমন সংগ্রামশীল, প্রকৃতি তেমনি সৌন্দর্যমণ্ডিত ও শান্তির আশ্রয়স্থল।