আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক স্তম্ভপ্রতিম কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। ‘কল্লোল’-এর ধারাবাহিকতা তার ভিতরে প্রবাহিত। জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি এই লেখক অগ্রজদের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করেছেন, এগিয়ে গেছেন অনেক দূর অবধি। সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যিকদের মধ্যেও যে তার উৎসারিত জনধারা প্রবহমাণ, এও তার সৃজনী সচলতার এক সাক্ষ্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মীর মশাররফ হোসেন থেকে যে বাংলা কথাসাহিত্যের ধারা উৎসারিত হয়েছে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তার উত্তরসূরি কথাসাহিত্যিক। কথাসাহিত্যিক হিসেবে, নতুন রীতির নাট্যকার ও গল্পকার হিসেবেও তার অবস্থান বাংলা সাহিত্যে অমোঘ।...
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ছিলেন আগাগোড়া আধুনিক মানুষ। যেমন বিশ্বাসে তেমনি জীবনাচারণে। পারিবারিক পরিমণ্ডলের শিক্ষা, সংস্কৃতি, আধুনিকতা এবং মুক্তচিন্তার যথাযথ প্রতিফলন ঘটেছে তার সাহিত্যে ও কর্মে। জন্ম চট্টগ্রামে, ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট। পিতা সৈয়দ আহমদউল্লাহ এবং মাতা নাসিম আরা খাতুন। আট বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন। তার বড় মামি উর্দু ভাষার লেখিকা এবং রবীন্দ্রনাথের গল্প-নাটকের উর্দু অনুবাদক। শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে নান্দনিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ১৯৩১ সালে কুড়িগ্রাম হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা, পরবর্তীতে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং ১৯৪৩ সালে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে ডিসটিংশনসহ বিএ পাস করেন। এর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন, পরে তা পরিত্যাগও করেন। পিতার প্রশাসনিক চাকরির বদলি প্রবণতার কারণে একদিকে যেমন তার বাইরের জনসাধারণের সঙ্গে মেলামেশা নিষিদ্ধ ছিল, অন্যদিকে তেমনি বারবার স্থান পরিবর্তনের কারণে জীবনকে তিনি মোহমুক্ত দৃষ্টিতে দেখার শক্তি অর্জন করেছিলেন। সাধারণত এ ধরনের মানুষ খুব একটা জনপ্রিয় ও সামাজিক হন না। কিন্তু ঘরে-বাইরে এই নিঃসঙ্গতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে করে তুলেছিল জ্ঞানানুসন্ধানী, আন্তর্চারী, বহির্বিমুখ, লাজুক, সংকোচনপ্রবণ এবং সীমাবদ্ধ বন্ধুবৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ।
১৯৪৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নয়নচারা’। পিতার মৃত্যুর কারণে তিনি এমএ পড়া ছেড়ে দিয়ে ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় চাকরি নেন। তিনি পত্রিকার সহসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত পার্ক সার্কাস এলাকায় বসবাস করতেন। সাংবাদিক ও লেখক সৈয়দ নাজিমুদ্দীন হাসেম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র প্রথম দর্শনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে আধুনিক সুরুচিসম্পন্ন কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের বুদ্ধিমান মানুষের চিত্রই সামনে ভেসে আসে। তিনি লিখেছেন, ‘কড়া নাড়ালাম পার্ক সার্কাসের একটি বাড়ির দরজায়। বেরিয়ে এলেন সৌম্যমুর্তি সুদর্শন দীর্ঘাঙ্গ এক যুবক, গৌরবর্ণের সঙ্গে চোখের বুদ্ধিদীপ্ত শাণিত দৃষ্টি চোখে পড়ার মতো। মনে পড়ে তার হলদে ফ্রেমের চশমা, হাতে ধূমায়িত চায়ের কাপ। পরনে কলকি বা পেইস্লি নকশা আঁকা বিদেশী রাত্রিবাসের ওপর বার্গানিড সুবার ঘন লাল রং-এর ড্রেসিং গাউন, একটা স্থির চিত্রের মতো বহুদিন মনে ফ্রেমে বাঁধাই করা ছিল।’
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র আত্মমগ্ন, বুদ্ধিমান নির্জনতাপ্রিয় স্বভাবের কারণে তাকে অনেকে দাম্ভিক, অসামাজিক বলে ব্যাখা করে থাকেন। কিন্তু শৈশবে মাতৃহীন একটি ছেলের এরকম বহির্বিমুখ শিল্পমগ্ন হওয়া দোষের কিছু নয়। ফরাসি দার্শনিক নাট্যকার উপন্যাসিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে তো শৈশবে পিতৃহীন হয়ে আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক নির্জনতাপ্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। কলকাতায় থাকার সময়ে তিনি ‘সওগাত’, ‘মোহাম্মদী’, ‘বুলবুল’ পত্রিকা এবং ‘পূর্বাশা’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘পরিচয়’ পত্রিকা এই দুই ধারার পত্রিকার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।
সমালোচক ‘আবু সায়ীদ আইয়ুব’, দার্শনিক প্রাবন্ধিক ‘কাজী আবদুল ওদুদ’, কবি ও সমালোচক ‘মোহিতলাল মজুমদার’, শিল্পাচার্য ‘জয়নুল আবেদীন’, কবি ও সমালোচক ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’, ‘শাহেদ সোহরাওয়ার্দী’, ‘আবুল হোসেন’, ‘সৈয়দ আলী আহসান’ প্রমুখ কবি পণ্ডিত ও বিদ্বগ্ধজনের সংস্পর্শে আসেন। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে তিনিই প্রথম চিত্রসমালোচক। নিজেও ছবি আঁকতেন। এই সূত্রে জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে। বড় মামা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কমরেড প্রকাশনা সংস্থা’। এই প্রকাশনায় প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘লালসালু’ (১৯৪৮)।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর ‘স্টেটসম্যান’-এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক হিসেবে নতুন চাকরি নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। এর পর ১৯৪৮ সালে করাচি কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক হয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর চাকরির মেয়াদের শেষান্তে পাকিস্তান সরকার ইসলামাবাদ বদলির প্রস্তাব দিলে তিনি অস্বীকার করার কারণে চাকরি শেষে কোনো আর্থিক সুবিধা পাননি। পরবর্তীতে তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ী হন। জীবনের শেষ সময়ে তাকে অনেক অর্থকষ্টে ও মানসিক যন্ত্রণায় কাটাতে হয়েছে। মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর, ফ্রান্সের প্যারিসে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য সাধনায় তিনটি উপন্যাস, দুটি গল্পগ্রন্থ, কিছু অগ্রন্থিত গল্প, তিনটি নাটক এবং বিক্ষিপ্ত কিছু ইংরেজি-বাংলা প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সময়কাল হিসেবে দীর্ঘ সময়ে তার রচিত সৃষ্টি একেবারেই কম মনে হবে। তা সত্ত্বেও তিনি আমাদের কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য তো বটেই, অদ্যাবধি সর্বাধুনিক লেখকদের মধ্যেও অন্যতম। সাহিত্যকর্মের পুরস্কারস্বরূপ পেয়েছেন ‘বনিপীর’ নাটকে ‘পিইএন পুরস্কার’ (১৯৫৫), ‘লালসালু’ উপন্যাসে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ (১৯৬১), ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’ গল্পগ্রন্থে ‘আদমজী পুরস্কার’ (১৯৬৫), সাহিত্যে ‘একুশে পদক’ (১৯৮৩) এবং শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ (২০০১) অর্জন করেন।