ঢাকা ২৫ ভাদ্র ১৪৩১, সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জীবনমুখী কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:৫৭ পিএম
আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:৫৮ পিএম
জীবনমুখী কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক স্তম্ভপ্রতিম কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। ‘কল্লোল’-এর ধারাবাহিকতা তার ভিতরে প্রবাহিত। জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি এই লেখক অগ্রজদের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করেছেন, এগিয়ে গেছেন অনেক দূর অবধি। সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যিকদের মধ্যেও যে তার উৎসারিত জনধারা প্রবহমাণ, এও তার সৃজনী সচলতার এক সাক্ষ্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মীর মশাররফ হোসেন থেকে যে বাংলা কথাসাহিত্যের ধারা উৎসারিত হয়েছে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌ তার উত্তরসূরি কথাসাহিত্যিক। কথাসাহিত্যিক হিসেবে, নতুন রীতির নাট্যকার ও গল্পকার হিসেবেও তার অবস্থান বাংলা সাহিত্যে অমোঘ।...

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ছিলেন আগাগোড়া আধুনিক মানুষ। যেমন বিশ্বাসে তেমনি জীবনাচারণে। পারিবারিক পরিমণ্ডলের শিক্ষা, সংস্কৃতি, আধুনিকতা এবং মুক্তচিন্তার যথাযথ প্রতিফলন ঘটেছে তার সাহিত্যে ও কর্মে। জন্ম চট্টগ্রামে, ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট। পিতা সৈয়দ আহমদউল্লাহ এবং মাতা নাসিম আরা খাতুন। আট বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন। তার বড় মামি উর্দু ভাষার লেখিকা এবং রবীন্দ্রনাথের গল্প-নাটকের উর্দু অনুবাদক। শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে নান্দনিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ১৯৩১ সালে কুড়িগ্রাম হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা, পরবর্তীতে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং ১৯৪৩ সালে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে ডিসটিংশনসহ বিএ পাস করেন। এর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন, পরে তা পরিত্যাগও করেন। পিতার প্রশাসনিক চাকরির বদলি প্রবণতার কারণে একদিকে যেমন তার বাইরের জনসাধারণের সঙ্গে মেলামেশা নিষিদ্ধ ছিল, অন্যদিকে তেমনি বারবার স্থান পরিবর্তনের কারণে জীবনকে তিনি মোহমুক্ত দৃষ্টিতে দেখার শক্তি অর্জন করেছিলেন। সাধারণত এ ধরনের মানুষ খুব একটা জনপ্রিয় ও সামাজিক হন না। কিন্তু ঘরে-বাইরে এই নিঃসঙ্গতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে করে তুলেছিল জ্ঞানানুসন্ধানী, আন্তর্চারী, বহির্বিমুখ, লাজুক, সংকোচনপ্রবণ এবং সীমাবদ্ধ বন্ধুবৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ।

১৯৪৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নয়নচারা’। পিতার মৃত্যুর কারণে তিনি এমএ পড়া ছেড়ে দিয়ে ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় চাকরি নেন। তিনি পত্রিকার সহসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত পার্ক সার্কাস এলাকায় বসবাস করতেন। সাংবাদিক ও লেখক সৈয়দ নাজিমুদ্দীন হাসেম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র প্রথম দর্শনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে আধুনিক সুরুচিসম্পন্ন কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের বুদ্ধিমান মানুষের চিত্রই সামনে ভেসে আসে। তিনি লিখেছেন, ‘কড়া নাড়ালাম পার্ক সার্কাসের একটি বাড়ির দরজায়। বেরিয়ে এলেন সৌম্যমুর্তি সুদর্শন দীর্ঘাঙ্গ এক যুবক, গৌরবর্ণের সঙ্গে চোখের বুদ্ধিদীপ্ত শাণিত দৃষ্টি চোখে পড়ার মতো। মনে পড়ে তার হলদে ফ্রেমের চশমা, হাতে ধূমায়িত চায়ের কাপ। পরনে কলকি বা পেইস্‌লি নকশা আঁকা বিদেশী রাত্রিবাসের ওপর বার্গানিড সুবার ঘন লাল রং-এর ড্রেসিং গাউন, একটা স্থির চিত্রের মতো বহুদিন মনে ফ্রেমে বাঁধাই করা ছিল।’

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র আত্মমগ্ন, বুদ্ধিমান নির্জনতাপ্রিয় স্বভাবের কারণে তাকে অনেকে দাম্ভিক, অসামাজিক বলে ব্যাখা করে থাকেন। কিন্তু শৈশবে মাতৃহীন একটি ছেলের এরকম বহির্বিমুখ শিল্পমগ্ন হওয়া দোষের কিছু নয়। ফরাসি দার্শনিক নাট্যকার উপন্যাসিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে তো শৈশবে পিতৃহীন হয়ে আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক নির্জনতাপ্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। কলকাতায় থাকার সময়ে তিনি ‘সওগাত’, ‘মোহাম্মদী’, ‘বুলবুল’ পত্রিকা এবং ‘পূর্বাশা’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘পরিচয়’ পত্রিকা এই দুই ধারার পত্রিকার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। 

সমালোচক ‘আবু সায়ীদ আইয়ুব’, দার্শনিক প্রাবন্ধিক ‘কাজী আবদুল ওদুদ’, কবি ও সমালোচক ‘মোহিতলাল মজুমদার’, শিল্পাচার্য ‘জয়নুল আবেদীন’, কবি ও সমালোচক ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’, ‘শাহেদ সোহরাওয়ার্দী’, ‘আবুল হোসেন’, ‘সৈয়দ আলী আহসান’ প্রমুখ কবি পণ্ডিত ও বিদ্বগ্ধজনের সংস্পর্শে আসেন। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে তিনিই প্রথম চিত্রসমালোচক। নিজেও ছবি আঁকতেন। এই সূত্রে জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে। বড় মামা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কমরেড প্রকাশনা সংস্থা’। এই প্রকাশনায় প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘লালসালু’ (১৯৪৮)।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর ‘স্টেটসম্যান’-এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক হিসেবে নতুন চাকরি নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। এর পর ১৯৪৮ সালে করাচি কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক হয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর চাকরির মেয়াদের শেষান্তে পাকিস্তান সরকার ইসলামাবাদ বদলির প্রস্তাব দিলে তিনি অস্বীকার করার কারণে চাকরি শেষে কোনো আর্থিক সুবিধা পাননি। পরবর্তীতে তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ী হন। জীবনের শেষ সময়ে তাকে অনেক অর্থকষ্টে ও মানসিক যন্ত্রণায় কাটাতে হয়েছে। মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর, ফ্রান্সের প্যারিসে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য সাধনায় তিনটি উপন্যাস, দুটি গল্পগ্রন্থ, কিছু অগ্রন্থিত গল্প, তিনটি নাটক এবং বিক্ষিপ্ত কিছু ইংরেজি-বাংলা প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সময়কাল হিসেবে দীর্ঘ সময়ে তার রচিত সৃষ্টি একেবারেই কম মনে হবে। তা সত্ত্বেও তিনি আমাদের কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য তো বটেই, অদ্যাবধি সর্বাধুনিক লেখকদের মধ্যেও অন্যতম। সাহিত্যকর্মের পুরস্কারস্বরূপ পেয়েছেন ‘বনিপীর’ নাটকে ‘পিইএন পুরস্কার’ (১৯৫৫), ‘লালসালু’ উপন্যাসে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ (১৯৬১), ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’ গল্পগ্রন্থে ‘আদমজী পুরস্কার’ (১৯৬৫), সাহিত্যে ‘একুশে পদক’ (১৯৮৩) এবং শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ (২০০১) অর্জন করেন।

তোমাকেও ছোঁবে

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
তোমাকেও ছোঁবে

ভেবো না, তোমাকেও ছোঁবে হিমেল বাতাস
আঁচড়ে দেবে
জীবনের বেলাভূমি
স্বপ্নগুলো উড়ে যাবে বৈশাখী বাতাসে
তোমার বাড়ি তার ভেতরের ঘর
প্রিয় সংগ্রহগুলো
থাকবে না কিছুই-

ভেঙে পড়বে চৈতন্যের কাঠামো
দড়ি বর্গা খড়খড়ি দরজা ধানের মটকা
স্মৃতিময় মুখগুলো হারিয়ে যাবে
ছোঁবে, তোমাকে ছুঁয়ে যাবে
হিমেল বাতাস
থেমে যাবে স্পন্দন
ধূসর প্রদেশে হবে শেষ গন্তব্য তোমার
ফিরবে না আর আলোকিত
নাগরিক কোলাহলে
ভেবো না, ছোঁবে
তোমাকেও-

নষ্টনীড় কাঁধ

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৬ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
নষ্টনীড় কাঁধ

আঁজলায় জমানো ছিল ভোরের কাজল, হৃদি কল্লোল,
দিঘিজল ছোঁয়া ধূলিওড়া লাবণ্য মেঠোপথ।
থাকেনি সেইসব ঐশ্বর্য অপার। তার পর কে যেন কবে
বলেছিল, ‘দাঁড়াও সুপান্থ, পশ্চাতে নদী, এনে দেব
দু’হাতে তোমার, বিহঙ্গ জোয়ার।
কবে কোন দেবদারু রাতে ডেকেছিল রোদরাঙা চাঁদ
                     পেতেছিল শুদ্ধ জলের ছায়ায় শয্যা শোয়ার।
আহা, কার যেন রিনিঝিনি হাত ছুঁয়েছিল নষ্ট নীড় কাঁধ।
তার পর সেই আঁজলা, নদী, চাঁদ, সেই রিনিঝিনি হাত
ঝুলে আছে দ্যাখো, দ্যাখো, একলা হাওয়ায়।

ইচ্ছেধারী পা

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
ইচ্ছেধারী পা

প্রখর তাপে ঝলসে যাচ্ছে দিনলিপির শরীর 
গর্জে উঠছে না শব্দেরা, হাতচিঠা এসে জমতে চায় 
প্রাচীন শিকারের মতো। মেঘের আঁচল প্রসারিত 
দেখি ছায়াঘর, স্বল্প ঘুমের দেশে সে এক পর্দানশীন  
কোনো লাইনই তাকে রাঙাতে পারে না
আমি নিজের মধ্যেই সমাহিত করি এক অলিখিত চুক্তি 
মধ্যবিত্তের হিসেব। একবার প্রতিলিপি তৈরি হয়ে গেলে  
বিলিয়ে দেবার প্রশ্রয়ও আসে না
একটা বিষণ্ণতার অভাব, নিদেনপক্ষে কিছু বিষাদ  
কেউ কি ফিরে এসে দ্যাখে 
               এই অভিপ্রেত শরীর বেঁচে আছে কিনা?  
এই যে মাঝ নদী, এই যে নৌকাবিহার
এই যে আমাদের ইচ্ছেধারী পা  
একে অপরের দিকে প্যাডেল করে অন্বয় হচ্ছে 
সেসব ত্যাগ করে কেন আমি ডুবে যাব!

ভেতো হাসির গল্প

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০১ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০১ পিএম
ভেতো হাসির গল্প
আঁকা: নিয়াক চৌধুরী তুলি

কেরামত আলীর হাসি আর থামে না।
বড্ড সহজ-সরল নির্বিবাদী মানুষ সে। সারা দিন সারাবেলা হাসিখুশি থাকে। দুঃখ-দৈন্য কখনো তাকে স্পর্শ করে না। পেটপুরে ভাত খাওয়া তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের কাজ। এ আনন্দের সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনাই হয় না। খেতে বসে পেট না ভরলে তার মন ব্যাজার হয়, মাথায় ঠিকমতো কাজ করে না। এমন অঘটন কখনো ঘটলে আমার মায়ের চোখে ব্যাপারটা ঠিকই ধরা পড়ে, কেরামতের মুখের দিকে তাকিয়ে মা তখন বলে, আর দুটো ভাত নিবি কেরু?

কেরু মানে কেরামত আলী মুখ ফুটে কিছুই বলে না, এ প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ অথবা না কোনোটিই পষ্টাপষ্টি জানায় না, কেবল সাদা ফকফকে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হেসে ওঠে। ওই হাসিতেই উত্তর বুঝে নেয় আমার মা। গামলা ভর্তি বাড়তি ভাত এনে কেরুর সামনে বাড়িয়ে ধরে। তরিতরকারি নিয়ে কেরুর বিশেষ ভাবনা নেই। এক বাটি ডালের সঙ্গে গোটা দুই কাঁচা মরিচ হলেই তার পূর্ণ তৃপ্তি। আহার শেষে থালাবাটি ধুয়ে কাঁধের গামছায় হাত-মুখ মোছা হলে তখন শ্বেতপদ্ম ফুটে ওঠে তার মুখের হাসিতে। কালো মানুষের মুখে সাদা দাঁতের কার্পাসফাটা হাসি দেখে আমার মায়েরও মন ভরে যায় তৃপ্তিতে, নিজেও হাসিমুখে ঘোষণা দেয়- এইবার খুশি আমার কেরু পাগল। এইবার যা ইচ্ছে তাই হুকুম করো, কেরুর মুখে আর রা নেই।

কেরামত আলীকে গ্রামের সবাই ডাকে কেরু বলে, কেবল আমার মাকেই দেখেছি তার নামের সঙ্গে পাগলটুকু জুড়ে দিয়ে সস্নেহ আশকারা দিতে। নিজের পেটের তিন পুত্রের মাঝখানে অলক্ষ্যে কোথায় যেন একটুখানি আলগা জায়গা ছেড়ে দেয় মা। সেই জায়গাটুকু সর্বসমক্ষে দৃশ্যমান না হলেও আমি বেশ ধরতে পারি। আমার বড় ভাই এবং মেজো ভাইকে তো আশৈশব তুই-তোকারিই করতে দেখেছি, কেবল আমিই সেটা পারিনি। বাড়ির রাখাল থেকে কৃষাণ হয়েছে কেরু আমাদের চোখের সামনেই, তার সঙ্গে তুই-তোকারিই তো স্বাভাবিকভাবে প্রচলিত এবং বিধিসম্মত। তবু আমি তাকে কেরুভাই বলে সম্মোধন করে এসেছি। আমার চেয়ে শুধু বয়সে বড় নয়, শরীর-স্বাস্থ্যেও কেরামত আলী আমার দ্বিগুণ। এই শরীরেরও তো একটা সম্ভ্রম আছে! বুদ্ধিতে হয়তো কিছুটা পিছিয়ে থাকতে পারে। তা-ই বা নিঃসংশয়ে বলি কী করে! ওই মোটা বুদ্ধি নিয়েই তো দিব্যি সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। নিজে কুচকুচে কালো হয়েও কপালগুণে ফরসা ধবধবে একটা বউ পেয়েছে, তারই পেটে দু-দুটো হৃষ্টপুষ্ট সন্তান পেয়েছে, এসব নিয়ে তার সংসার। আমার বাবা যথার্থই নিজে হাতে গড়েপিটে তাকে সংসারী করে গেছেন। বিয়ের সময় পাত্রের গাত্রবর্ণ নিয়ে একটুখানি খুঁতখুঁতানি উঠলে পাত্রীপক্ষকে গভীর আস্থার সঙ্গে আশ্বস্ত করেছেন- গায়ে-গতরে খেটে কেরু ঠিকই পেটের ভাত জোগাড় করে নেবে। দেখে নিও সবাই, কেরুর কোনোদিন ভাতের অভাব হবে না।

বিয়ের পর আমাদের ভিটে-জমির পুবের কোনায় কেরুর জন্য নতুন ঘর তুলে দেওয়া হয়। সেই ঘরেই তার সংসার-পত্তনি। আমাদের পিতৃ-বিয়োগের পর বিষয়-সম্পত্তি ভাইয়ে-ভাইয়ে ভাগাভাগি হলেও কেরুর ঘরবাড়ি নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি। আমাদের সঙ্গে থেকে শুধু জমিজায়গা নয়, যথার্থই আমাদের সবাইকে আগলেও রাখে সে। দূরবর্তী স্থানে বিবাহিত আমাদের দুই বোনের সঙ্গে যোগাযোগও রাখে সে। তবু কারও কাছে কোনো দাবি নেই। তার চাহিদা খুবই সামান্য এবং সেটুকু নির্দ্বিধায় জানায় আমার মায়ের কাছে। আর কিছু নয়, সে খাবার সময় পেটভরা ভাত চায়। তাহলেই সব বোঝা টানতে পারে, সব হুকুম পালন করতে পারে হাসিমুখে। আসলে সে-ই সার্থক করেছে প্রবাদবাক্য- পেটে খেলে পিঠে সয়, গাধাও তখন বোঝা বয়।

পেটের খাদ্য বলতে কেরু শুধু ভাতই বোঝে। ভাত ছাড়াও আরও কত রকম খাদ্য যে এ দুনিয়ায় আছে, আছে শতেক রকম পিঠেপুলি, সে যে তার খবর রাখে না, তা নয়। কিন্তু তার সব চেয়ে প্রিয় খাবার ভাত। গরম ভাত, পান্তাভাত, কড়কড়ে ভাত, খিচুড়ি ভাত- যেমনই হোক, ভাত হলেই হলো। তার যুক্তি খুবই সোজা- খালা বলো ফুপু বলো মায়ের সমান কে, মাকে পেলে আমি তো আর কিছু  চাইনে। কথায় কথায় এমনি ধারা কাব্যি গাওয়া স্বভাব তার। পেটের ভেতরে কথা জমানোই থাকে, কথার পিঠে কথা বলতে গিয়ে এই সব কাব্যি উগরে দেয় মুখে মুখে। ভাতের কেচ্ছা বলতে বলতে অতি শৈশবে শোনা তার বাপের খিদের গল্পও সে গড়গড় করে বলে যায়। কবে নাকি রাতের আঁধারে কার হেঁসেলে ঢুকে হাপুসহুপুস করে পান্তাভাত খাবার সময় তার বাপ ধরা পড়েছিল একটা কাঁচা মরিচের জন্য। মায়ের কাছে শুনেছে সেই আকালের বছরে ভাত চুরির অপরাধে বেচারা খুব পিটুনি খেয়েছিল। শুধু পিটুনি নয়, আরও নির্মম শাস্তিও সে ভোগ করে। পিঠমোড়া করে দুহাত বেঁধে লাল পিঁপড়ের চাকের ওপরে তাকে ফেলে রাখে। ভাতের জন্য মানুষের এমন শাস্তির কথা শুনে আমরা অনেকেই শিউরে উঠি, কিন্তু ভাতের প্রতি ভক্তি জানাতে কেরামত কাব্যি গেয়ে শোনায়- ভাতই আমার আল্লা রসুল ভাতই ভগবান, ভাতই আমার মানসম্মান ভাতেই অপমান।

ভাতপাগল এই মানুষটি সেদিন হাসপাতালে যাওয়ার পর ডাক্তারের মুখে যে-কথা শুনে আসে, তাতে তার মাথায় বাজ পড়ে। কিন্তু বজ্রপাতের আঘাতে স্তব্ধ মানুষ কখনো হা হা করে উদ্দাম স্রোতের মতো হাসতে পারে! আমাদের কেরামত আলী ওরফে কেরু ভাই হাসে, বাঁধভাঙা হাসির স্রোতে ভাসিয়ে দেয় চারদিক। এমন হাসির উচ্ছ্বাস আগে কখনো দেখিনি।

আমিই তাকে জোর করে ঠেলে পাঠিয়েছিলাম উপজেলা হাসপাতালে, আমার এক ডাক্তার বন্ধুর নামে চিঠি লিখে সেটাও ধরিয়ে দিয়েছিলাম তার হাতে। মাঠেঘাটে কখন অসাবধানে কাঁটাখোঁচের ধাক্কায় তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল কেটে রক্তাত হয়েছে, মাসখানেকের মধ্যে সেই ঘা আর শুকায় না। গ্রাম্য ডাক্তারিতে কাজ না হলে আমি একরকম জোর করেই তাকে হাসপাতালে পাঠাই। আমার বন্ধু ডাক্তার জাহিদ ক্ষতস্থান ধুয়ে মুছে যত্ন করে চিকিৎসা ঠিকই দিয়েছে, কিন্তু রক্ত পরীক্ষার পর তার কানের কাছে ভয়াবহ বোমা ফাটিয়েছে- কেরামত আলীর ডায়াবেটিস না কমলে ঘা শুকোবে না।

ডায়াবেটিস!

কেরামত আলী চমকে উঠলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। এ রোগের নাম তার অজানা নয়। নানান আজগুবি কথা শুনেছে এই রোগ নিয়ে। তবু সাহস করে সে বলে- 

তা হলি সেই রোগেরই ওষুধ দেন আমাকে।

প্রয়োজনীয় ওষুধপত্তর ঠিকই দিয়েছে ডাক্তার, সেই সঙ্গে এক গাদা লেকচার শুনিয়েছে ডায়াবেটিস রোগীর করণীয় সম্পর্কে। সেসব ঠিকই আছে, অসুখ হলে তো ডাক্তারের কথা শুনতেই হয়, তাই বলে ভাতকে বিষ বললে তাও মানতে হবে!

কেরুর তো তখন বুকে খিল লাগার দশা।

ভাত-রুটি-চিঁড়া-মুড়ি- এসবই নাকি ডায়াবেটিস রোগীর জন্য বিষের মতো। ডাক্তার চিনিকে বলে হোয়াইট পয়জন। তাহলে মানুষ বাঁচবে কী খেয়ে? ডাক্তার সে তালিকাও শুনিয়েছে ধৈর্যসহকারে। শুনতে ভালো লাগেনি বলে সে ঠিকমতো মনোযোগ দেয়নি। বরং বিদায় নেওয়ার সময় ভাতের প্রসঙ্গ পুনরায় তুলেছে- ভাত না খালি মানুষ বাঁচে স্যার?

অবশেষে দয়াপরবশ হয়ে ডাক্তার ভাতের বরাদ্দ অনুমোদন করেছে যৎসামান্য। সেই ভাতের পরিমাণ শুনে কেরুর ব্রহ্মচাঁদি ধাঁ করে জ্বলে ওঠে, সহসা আকাশসমান ক্ষুধায় সারা শরীর কাঁপতে থাকে; তখন সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয়।

বাড়ি পৌঁছেই মন ভালো হয়ে যায় কেরামত আলীর। সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা স্ত্রী তার সামনে গামলা ভর্তি ভাত এগিয়ে দেয়। বেগুন ভাজা, কচু শাকের ঘণ্ট, মসুরের ডাল সঙ্গে কাগজি লেবুর ফালি। আহা, নাক ডুবিয়ে খাওয়া যাকে বলে আর কী। এ জন্য কেউ কেউ তাকে মোষের সঙ্গেও তুলনা করে। মোষ তো দাঁত মেলে হাসতে পারে না, কেরু শোনে আর হাসে। তার স্ত্রী মাথায় ঘোমটা টেনে মধুর কটাক্ষ করে- হাসতি নজ্জাও করে না তুমার!

কেরু হাসপাতালের চিকিৎসা-বৃত্তান্ত আমার কাছে শোনাতে আসে সন্ধ্যাবেলায়। বিস্তারিত সব কথা খুলে বলতে চায়, কিন্তু বলা হয় না। হুড়মুড় করে এগিয়ে আসে ভাতের কথা। ভাপ ওঠা ভাত হোক কিংবা বাসি-পচা পান্তাই হোক, পেট পুরে ভাত না খেলে মানুষ বাঁচবে কেমন করে, তাই নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তা তার। সেই দুর্ভাবনার কথাটা ব্যক্ত করতে গিয়েই কেরু ভাইয়ের বুক ঠেলে হাসির গমক উঠে আসে। বাপরে, সে কী বিরামবিহীন হা হা হাসি! সে হাসি থামতেই চায় না। মুখ হা হয়ে চোয়াল আটকে থাকে। হা-ও বন্ধ হয় না, হাসিও থামে না কিছুতেই। এমন বিদঘুটে হাসি হাসতে দেখে আমার একটু একটু ভয় করে, আন্তরিক গলায় আমি তার নাম ধরে ডাকি- কেরু ভাই! শোনো কেরু ভাই!

না, সে আমার ডাক যেন শুনতেই পায় না। ধবধবে সাদা দুপাটি দাঁতের ফাঁকে হা করে সে হাসতেই থাকে, হাসতেই থাকে। আমি ভয়ার্ত হাতে হাস্যোজ্জ্বল মুখটা জড়িয়ে ধরতেই টের পাই তার দুচোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে তপ্ত অশ্রুধারা। এইবার আমি উদ্বেগে শিউরে উঠি- হাসি নয়, কেরামত আলী কি এতক্ষণ তবে কাঁদছে! মানুষের ভেতো হাসি কি এভাবে কান্নার হ্রদে নেমে আসতে পারে!

কেরামত আলীর হাসি অথবা কান্নার ধ্বনি শুনে তার স্ত্রী আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে আসে এবং পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে স্বামীর মুখ।

বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৭ পিএম
বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

‘মানুষ কি চায়- উন্নতি, না আনন্দ? উন্নতি করিয়া কি হইবে যদি তাহাতে আনন্দ না থাকে? আমি এমন কত লোকের কথা জানি, যাহারা জীবনে উন্নতি করিয়াছে বটে, কিন্তু আনন্দকে হারাইয়াছে।... জীবন তাহাদের নিকট একঘেয়ে, একরঙা, অর্থহীন। মন শান-বাঁধানো- রস ঢুকিতে পায় না।’...

বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের হৃদয়ে কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, দিনলিপি ইত্যাদি। জন্ম ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। পৈতৃক নিবাস যশোর জেলায়। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত ও মাতা মৃণালিনী দেবী। সাহিত্যিক-সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯) লেখাটি পছন্দ করে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশ করলে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘অপরাজিত’ (১৯৩২)... এবং গল্পসংকলন ‘মেঘমল্লার’ (১৯৩১)...। মৃত্যু ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র পুরস্কারে’ (১৯৫১) ভূষিত হন।