গত সংখ্যার পর
আগরতলায় স্বাধীন বাংলা সরকার গঠনের খবরটি শুধু ভারতের সংবাদপত্রে নয়, সারা বিশ্বেই প্রচারিত হয়। আগতলার দৈনিক সংবাদ-এর ১৩ এপ্রিলের ব্যানার হেডলাইনটি ছিল কী রকম- ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে রক্ত ও অগ্নিশুদ্ধ স্বাধীন বাংলা সরকার ঘোষিত-।’ রথীন বাবুর আজও মনে আছে, ‘সাব-হেডলাইন’ ছিল এ রকম : ‘তাজউদ্দিন আহমদের প্রধানমন্ত্রিত্বে স্বাধীন বাংলার মন্ত্রিসভা: যুগ্ম-যৌথ নেতৃত্ব। কুষ্টিয়ায় সদর দপ্তর স্থাপন: স্বাধীন বাংলা বেতারের ঘোষণা: বিশ্বে নজিরবিহীন ইতিহাস রচনা।’
এ পর্যন্ত বলেই সার্জন রথীন দত্ত কাশতে শুরু করলেন। চেয়ার থেকে উঠে কিছুক্ষণ পায়চারী করলেন। দুই ঠোক পানি গিললেন। প্রস্তুতি দেখে বোঝা গেল তিনি এবার দোতলায় যাবেন। সত্যি সত্যি সিঁড়িতে পা রাখলেন তিনি। যাওয়ার সময় বলে গেলেন- আজ না হয় এ পর্যন্তই থাক, কী বল? তবে তোমরা যদি চাও তা হলে অপেক্ষা করতে পার। আমাকে এখন স্নান সারতে হবে, ওষুধ-পথ্য নিতে হবে। বয়স হয়েছে তো।
বয়সের হেরফের থাকলেও মল্লিকা ও ক্যামেরাম্যান গৌরব ঘোষ নতুন প্রজন্মের মানুষ। মল্লিকার আটাশ, গৌরবের পঁয়ত্রিশ। একাধিক টিভি চ্যানেল কলকাতায়- কম্পিটিশনের শেষ নেই। ওদের আসল আগ্রহ একটা ভালো ইন্টারভিও নেওয়া, যাতে একটা ভালো রিপোর্ট বেরিয়ে আসে। অবশ্য বাংলাদেশ নিয়ে মল্লিকার এক ধরনের বাড়তি আগ্রহ থাকলেও গৌরবের তেমন কিছু নেই।
সার্জন দত্ত দোতলায় উঠে গেলে ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকে। মল্লিকা বলে- গৌরব দা, দেখ, সব মিলিয়ে দুবার আমি বাংলাদেশে গেছি, ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার পরেই কেমন যেন লাগে! এক মানুষ, এক ভাষা, এক সংস্কৃতি, এক বাংলা, অথচ দুই দেশ! তিন পুরুষ আগে পদ্মা-ধলেশ্বরীর পাড়ে মুন্সীগঞ্জের কোনো গ্রাম থেকে আমার পূর্ব পুরুষ নদীয়ায় চলে আসে। বড় কষ্টের স্মৃতি তাদের। আর কখনো যায়নি ওরা ঘরবাড়ি দেখতে। হয়তো সুযোগ বা সাহস কোনোটাই হয়নি। ঠাম্মা-ঠাকুরদা চলে যাওয়ার পর বাবারও আগ্রহ কমে যায়। শরীরও খারাপ হতে থাকে। কিন্তু আমি মনে মনে একটা ইচ্ছে পুষে রেখেছিলাম, একবার অন্তত যাব, পিতৃপুরুষের ঘরবাড়ি খুঁজে বার করব। কিন্তু বাংলাদেশ গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম পদ্মা আমাদের বাড়িভিটে, এমনকি গ্রামটিও গিলে ফেলেছে- কোনো চিহ্ন নেই ! দেখ, আমি তৃতীয় প্রজন্মের মানুষ। আমার তেমন ইমোশন থাকার কথা নয়, তারপরও...।
ক্যামেরাম্যান গৌরব ঘোষের এরই মধ্যে নামডাক হয়েছে। বছরখানেক হলো নতুন চ্যানেলে যোগ দিয়েছে। বলল, শুনেছি ব্রিটিশ আমলে আমাদের পূর্ব পুরুষ সরাইলের কালিকচ্ছ গ্রাম থেকে এসেছিল। প্রথমে আগরতলায় পরে কলকাতায়। বহুকালই কেউ নেই আমাদের ওখানে। স্বাধীনতা সংগ্রামী উল্লাস কর দত্তের নাম জানিস তো, শুনেছি, তিনিও একই গ্রামের মানুষ। সত্যি বলতে কী- তেমন একটা আবেগ নেই আমার। তবে সুযোগ হলে একবার কালিকচ্ছ গ্রামটা দেখে আসব।
এতক্ষণ ধরে দত্ত বাবুর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল মল্লিকা ও গৌরব। বিস্ময়কর দিনের বিস্ময়কর সব গল্প! একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে ঘটনাগুলো শুনতে শুনতে ওদের মধ্যে এক ধরনের অনুভূতির জন্ম হয়। ওরা ভাবতে থাকে একটি বছর কীভাবে এপার ওপারকে এক করে দিল! কীভাবে
মানুষে মানুষে, বাঙালি বাঙালিতে একাকার হয়ে গেল!
কেন, কীসের জন্য?
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীরা বৈরী প্রতিবেশী পায়নি বরং বন্ধু-সহযোগী পেয়েছিল। সে কারণে এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে অবাধে জায়গা করে নিতে পেরেছিল ভারতীয় রাজ্যগুলোতে। পরিবেশটা সুবিধেজনক ছিল আরও এ কারণে যে, কী পশ্চিমবাংলা, কী আসাম, কী মেঘালয়, কী ত্রিপুরা, সব সীমান্তেই তারা পেয়েছিল প্রায় একই ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারার মানুষ।
বাঙালিরা সাচ্চা মুসলমান নয়, হবেও না কখনো- এই অপবাদে- একটি জাতির ওপর চাপানো হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বৃহৎ এক গণহত্যা, চালানো হয়েছিল নির্বিচার নারী ধর্ষণ। ৩০ লাখ মানুষকে খুন করা হয়েছে, প্রায় ৪ লাখ নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, এক কোটি মানুষকে দেশছাড়া করা হয়েছে। ওরা চেয়েছিল মাটি- মানুষ নয়। আরও চেয়েছিল ধর্ষণে ধর্ষণে বেয়াড়া বাঙালি জাতির রক্ত পরিবর্তন করতে! আর সবই করেছে ওরা ধর্ম রক্ষার নামে! কিন্তু ইতিহাসের গতিধারা কখনো ঘাতক-নিপীড়কদের সমর্থন করে না। করেনি উনিশ শ একাত্তর।
ডাক্তার রথীন দত্তের সঙ্গে সাক্ষাৎকারটির আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন কিছু জানা ছিল না রিপোর্টার মল্লিকা সেনগুপ্তের। গৌরব ঘোষের তো নয়ই। কিন্তু আজ মনে হলো বাঙালির ইতিহাসের সুবিশাল এই মাইলফলক নিয়ে জানা প্রয়োজন বৈকি।
মল্লিকা তাই গৌরবের দিকে তাকিয়ে বলল- বুঝলে গৌরব দা, বেশ লাভ হলো ইন্টারভিউটা নিয়ে। বলতে গেলে এক অর্থে মূর্খই ছিলাম। এতকিছু জানা ছিল না।
গৌরব ঘোষ নিজেও যে কিছুটা আগ্রহী হয়ে উঠেছে তা বোঝা গেল ওর কথায়। বলল, একটা অ্যাসাইন্টমেনট নিয়ে চল একবার বাংলাদেশ ঘুরে আসি। অ্যাসাইন্টমেন্ট না পেলেই বা কি, ডাইরেক্ট ট্রেন আছে, সরাসরি বাস চলে, ত্রিপুরাতেও যায়। কয়েক ঘণ্টার তো জার্নি মাত্র। ভাবছি একবার ঘুরে আসব।
মল্লিকা সেনগুগুপ্ত এ সময় একটা অদ্ভুত কথা বলে ওঠে। বলে- গৌরব দা, একটা সত্যি কথা বলি তোকে। ধর, আমি যদি তখন থাকতাম, মানে এই বয়সের থাকতাম, পশ্চিমবঙ্গে থাকতাম, তাহলে নির্ঘাৎ আমি জয়বাংলার যুদ্ধে নামতাম।
গৌরব ঘোষ: তুই তো ভারতীয়, কী করে পারতি?
মল্লিকা সেনগুপ্ত: ভারতীয় অনস্বীকার্য, কিন্তু আমার বাঙালি পরিচয় তো আদি ও অকৃত্রিম। সে পরিচয়েই ট্রেনিং ক্যাম্পে ঢুকে যেতাম। বেশি কিছু না জানলেও মল্লিকা শুনেছে কলকাতার পাশে গোদরাতে বাংলাদেশের একটি নারী বাহিনী গড়ে তুলতে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়েছিল। বহু নারী অস্ত্র ট্রেনিংও পেয়েছিল।
বাংলাদেশ নির্মাণের সশস্ত্র যুদ্ধে ত্রিপুরা রাজ্য কতটা জড়িয়ে ছিল তার একটি চিত্র অনুমান করা যাবে একটা হিসাবের দিকে তাকালে। এই রাজ্যঘেঁষে বাংলাদেশের মোট ১১টি যুদ্ধ সেক্টরের ৫টি সেক্টর গড়ে ওঠে। ১ নম্বর সেক্টরের সীমানা ছিল বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী জেলার কিছু অংশ নিয়ে। এর অধিনায়ক ছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ছিল ৫টি। এখানে নিয়মিত বাহিনীর মোট সংখ্যা ছিল ২১০০, যার মধ্যে ১৫০০ ইপিআর, ২০০ পুলিশ, ৩০০ সেনা সদস্য, ১০০ নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য। ছাত্র ও সাধারণ যুবতারুণ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা গেরিলা সদস্যের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার।
চলবে...