একটু একটু করে অন্ধকার চুঁইয়ে পড়ছে শহরের বুকে। আঁধারের ডানার নিচে মুখ লুকোচ্ছে শেষ বিকেলের ম্লান অবয়ব। পুরান ঢাকার এইসব গলিঘুঁজি আমার আধচেনা। কোন ছোট বেলায় মকবুলের সঙ্গী হয়ে এ এলাকায় আসা। উঁচু খিলান দেওয়া অন্ধকার বাড়িগুলো তখন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকত।
ঢাকা তখনো একটা প্রাদেশিক রাজধানী। গুলশান-বারিধারার কৃষকদের কাছে ফসলের মাঠ মগ্ন ইঙ্গিতে বলে মরশুম এবার ভালো যাবে তো। সেগুনবাগিচা থেকে হেঁটে অথবা সাইকেলে বকশিবাজার নবকুমার ইনস্টিটিউট। তার পর মকবুলের হাত ধরে বাখরখানি আর সুতা কাবাবের সন্ধানে অনির্দিষ্ট যাত্রা।
সেই মকবুলের কণ্ঠস্বর এত বছর পর আমার টেলিফোনের দরজায় কড়া নাড়ে। আজকাল আমার বিস্মৃতির পালা চলছে। যদিও এই বিজ্ঞানের যুগে এখনই আমার বুড়িয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমার চেনাজানা অনেক লেখক বন্ধু এখনো সদ্য তরুণীর বাহুলগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যবসায়ী দোস্ত সালামকে এখনো চল্লিশ বছরের ছোকরা বলে মনে হয়। কিন্তু আমি নিষ্ঠাবান সরকারি আমলার পুত্র, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী, আমার পক্ষে যৌবনের স্বপ্ন দেখাও পাপ। আমার চোখের সামনে সর্বদা ঘুর ঘুর করে সাদা চুলে মেহেদী দেওয়া প্রৌঢ়া স্ত্রী, ডাক্তারি পাস ছেলে। আমার তো এখন ভুলে যাওয়ারই দিন। এই সেগুনবাগিচা যে সেই সেগুনবাগিচা, সে কথাই মাঝে মাঝে ভুলে যাই। বিকেল বেলা লেকের সামনে হাঁটতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই লেকটাকে কিছুতেই খুঁজে পাই না। কাজী সাহেবের বাড়ির আঙিনায় বহুতল ভবন দেখে চমকে উঠে ভাবি এটা কোন জায়গা।
মকুবলের কণ্ঠস্বরকেই বরং আমার চিনতে ভুল হয় না। অনেক বছর ওর সঙ্গে দেখা না হতে পারে কিন্তু ও তো সেই মকবুল, যার সঙ্গে হোসেনী দালানে মহররমের তাজিয়া দেখতে গেছি, তন্ময় হয়ে শুনেছি মুনীর স্যারের ক্লাস, আসাদ আর মতিউরের দেহ থেকে ঝরে পড়া রক্তের শিল্পকর্ম দেখেছি। এতকাল পর মকবুলের কণ্ঠস্বর যেন বিস্মৃতির বন্ধ দুর্গের সিংহদ্বারে দামামা বাজায়, স্মৃতির বন্ধ দরজা জানালাগুলো উন্মুক্ত হয় একের পর এক। মকবুলের দেওয়া ঠিকানায় মানচিত্র ধরে আমি যাত্রা করি।
এসব সর্পিল রাস্তা আর গলিপথের ওপর সূর্য তার কর্কশ থাবা বাড়াতে পারেনি। এই শ্যাওলা ঢাকা দেয়ালগুলো যখন গড়ে উঠেছিল তখনো সুতানটি কলকাতা হয়ে ওঠেনি। লালবাগ দুর্গের বাগানে তখন পরীবিবির কলধ্বনি ঝংকার তুলত। ঢাকা তখন সুবেবাংলার রাজধানী। টাকায় আট মণ চালের দিন তখন।
রিকশার ঠুন ঠুন শব্দে মনে হয় একটা রিকশায় চড়ে বসাই হয়তো সংগত। কিন্তু আমার হাঁটতে ভালো লাগে। শেষ বিকেলের নরম আলোতে অবগাহন করতে করতে আমি মকবুলের বাড়ির খোঁজ করি। মকবুলের হাত ধরে ধীরে ধীরে আমার স্মৃতির আঙিনায় ঢুকে পড়ে আরও কিছু মানুষ, কয়েকটি নাম, কিছুটা সময়।
মকবুলরা থাকত বনগ্রাম লেনে। ওর বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। পশার খুব বেশি ছিল না বলে ঠাঠারী বাজারের একটা দোকানে হিসাব লেখার কাজও করতেন। বনগ্রামে ওদের সেমি দোতলা বাড়ি। নিচ তলায় ছোট ছোট অন্ধকার চার পাঁচটি ঘর, ছাদে মাত্র দুটি। চুন-সুরকির মোটা দেয়াল, শ্যাওলা পড়া পাকা উঠান। জলের কলের পাশেই উঠানের এক কোণে একটা বড়সড় চৌবাচ্চা, যাকে ওরা বলত হাউস। পানিভরা চৌবাচ্চায় উঁকি দিলে দেখা যায় তলায় চিরস্থায়ী শ্যাওলা।
মকবুলরা অনেক ভাইবোন। সবগুলো নিজস্ব নয়- চাচাতো-মামাতোও ছিল। ছাদে ছেলেদের রাজত্ব। দুই ঘরে বড় বড় চৌকি পেতে ঘুমাত। পড়ালেখাও ওই চৌকিতে বসেই। ছাদে রেলিংয়ের বালাই নেই। তবে চওড়া কার্নিশ আছে। সেই কার্নিশে বসে ছুটির দিনে দুপুরে চলত মাখনা, পানিফল আর কদবেলের সদ্ব্যবহার।
মকবুলের মা চিররোগী। হাঁপানির টান উঠত যখন তখন। সংসার দেখত ওর সেজো বোন বিলকিস বেগম। বড় দুই বুবুর বিয়ে হয়ে গেছে আগেই। বিলকিস বুবুরও বিয়ের কথা চলছে নানান জায়গায়। বাড়িতে মোতাশা মানে মেয়ে ঘটকের আনাগোনা আছে। ছাদ থেকে প্রায়ই দেখতাম আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা কোনো মহিলা ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেল পেছনের দরজা দিয়ে। বিলকিস বুবু ছাদে আচার রোদে দিত। আমাদের দায়িত্ব ছিল কাক তাড়ানো। অবশ্য আমরা দুজন থাকতে কাকের বেটার সাধ্য কী আচারে মুখ দেয়।
সেগুনবাগিচায় আমাদের সাজানো গোছানো বাড়ি। বাড়ির সামনে বাগান। ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য নেট টাঙানো লন। গেটে দারোয়ান। দেশ বিভাগের সুবাদে কলকাতা থেকে বদলি হয়ে আসা বাবা সেক্রেটারিয়েটের বড় চাকরে। উচ্চ-মধ্যবিত্ত আমাদের বাড়িতে ইংরেজিতে কথাবার্তা, কায়দা-কানুন কোনো কিছুরই অভাব নেই।
মকবুলদের বাড়ির সঙ্গে আকাশ-পাতাল তফাৎ। তবু ওদের বাড়িই আমার ভালো লাগে। শ্যাওলা ঢাকা এ বাড়িটা যেন অনেক বেশি ছায়াময়। আমি আর মকবুল যখন স্কুল পেরিয়ে ঢাকা কলেজে পা রেখেছি বিলকিস বুবুর তখন বিয়ে হয়ে গেল নারিন্দায়। সংসারের ভার পড়ল মকবুলের পিঠাপিঠি বোন পারভীনের ওপর। মকবুল কলেজে পড়ছে, ঢাকাইয়া ছেলের পক্ষে বিরল ঘটনা। নাজির আহমেদ, সাইদ আহমেদের মতো হাতেগোনা দু-চারটি পরিবার ছাড়া ঢাকাইয়া বাড়ির ছেলেরা স্কুলের গণ্ডি পেরোতে খুব বেশি উৎসাহ পেত না। অনেক বাবা তো বলেই দিত পড়ালিখা কইরা পোলায় কি চাকরি নিব নিহি? ফাইব পাস দিছে বহুত দিছে। তবে মকবুলরা হাফ ঢাকাইয়া। মকবুলের বাবা সদ্য গ্রাম থেকে এসে ওর নানার বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসেবে বহাল হয়েছিলেন। তার পর যা হয়ে থাকে। রাজকন্যা- সেই সঙ্গে বনগ্রাম লেনের শ্যাওলা ধরা রাজত্ব।
বিলকিস বুবু জেসমিন বুবুর মতো, পারভীন অত লাজুক নয়। ছাদের ঘরে এসে আমাদের সঙ্গে দিব্বি আড্ডা জমাত। ভাবে বুঝতাম চাচাতো ভাই মাহাবুবের সঙ্গে ওর বিশেষ কোনো সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। পারভীনের সঙ্গেই কোনো কোনো দিন ছাদের ঘরে উঁকি দিত চিত্রা সেনের মুখ।
আমাদের চোখজুড়ে তখন সুচিত্রা সেনের স্বপ্ন। মানসী, লায়ন, রূপ মহল যে হলেই উত্তম-সুচিত্রার ছবি আসুক না কেন দেখতে যাওয়া চাই। শুধু একবার নয়, অন্তত তিন-চারবার। ইডেন কলেজের অনেক মেয়ে তখন সুচিত্রার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে গাঢ় স্বরে কথা বলে তার পর মাথা ঝাঁকিয়ে সোজা হেঁটে যায়। হাটখোলার সেন্ট্রাল উইমেন্সেও মেয়েরা পড়ে বটে কিন্তু বেগজাদীর কড়া শাসনে ছেলে-ছোকরার দিকে তাকানোর সাহস নেই তাদের।
ইডেনের ছাত্রী চিত্রা অবশ্যই মিসেস সেনের মতো সুন্দরী নয়। তবে সংস্কৃতিস্নিগ্ধ মুখ। পারভীনের বান্ধবী হলেও ওর মতো নিরেট নয় চেহারা। মকবুলদের পাশের বাড়িতেই চিত্রাদের আবাস।
আইয়ুব খানের আমল। ’৫০-এর দাঙ্গার পর থেকেই বনগ্রাম, ঠাঠারী বাজারের হিন্দুরা সংকুচিত হতে শুরু করেছে। তবু পুরান ঢাকার এ-বাড়ি ও-বাড়িতে খিড়কি দরজা দিয়ে মেয়েদের চলাচল হিন্দু মুসলমানের বেড়া মানে না। মকবুলের বাবার সঙ্গেও নারায়ণ সেনের হোমিওপ্যাথি নিয়ে তর্কবিতর্ক থামে না। আর কোনো শাস্ত্রের দোহাই পেড়েই তরকারির বাটির চলাচলকে রোখা যায় না।
চিত্রা সেন এ বাড়িতে আসে। মকবুলের কাছ থেকে নীহাররঞ্জনের বই ধার নেয়। আমি ওকে সুচিত্রা সেন ডেকে রাগানোর চেষ্টা করি। ও রাগ করে। কিন্তু যেদিন রাগাতে ভুলে যাই সেদিন বিষণ্নতার ছায়া চোখে নেমে আসে। নারায়ণ সেন মাঝেমধ্যেই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা এর ওর সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু ঠাঠারী বাজারের রমরমা মিষ্টির দোকানের ব্যবসা ছেড়ে নতুন করে আবার কোন বিদেশে যাবেন তা ভেবে পান না। বড় ছেলে জয়ন্ত সেন কমিউনিস্ট। সে বোঝায় এই দেশই আমাদের দেশ। লড়াইটা দেশের বিরুদ্ধে নয়, শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে। কিন্তু নারায়ণ সেন কোনো শ্রেণির চোখেই তার জন্য কোনো সহানুভূতি দেখতে পান না। বরং দেখেন লোভ। বনগ্রাম লেনের তার ভিটেবাড়ি দখল করে নেওয়ার তীব্র লোভ প্রতিবেশীদের চোখে ঝলক দিয়ে ওঠে।
সময়ের মতো সময় গড়িয়ে যেতে দ্বিধা করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পা রাখি আমরা। দেশ বিভাগের মূল্যে কেনা বহু সাধের পাকিস্তানের স্বপ্নের বুঁদবুঁদগুলো ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে। রাজনীতি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। আরও বেশি ভালো লাগে চিত্রা সেনের চোখের গভীরে হারিয়ে যেতে। কোনোদিন বিউটি বোর্ডিং আবার কোনোদিন স্টার কাবাবের টেবিলে শিক কাবাবের প্লেট বা চায়ের কাপ সামনে রেখে বন্ধুদের আড্ডা জমে ওঠে। জমজমাট আড্ডার মধ্য থেকে হঠাৎ উঠে আসি আমি। ১১৩ নম্বর বনগ্রাম লেনের দিকে হাঁটতে শুরু করি।
চিত্রা অপেক্ষা করে থাকে ওদের দোতলার বারান্দায়। আমাকে মকবুলদের ছাদে দেখলেই ও চলে আসে এ বাড়িতে। আমাদের দুজনের মধ্যে যে উত্তাল মেঘনা বহমান তা মকবুল বোঝে। কখনো কিছুই বলে না। কিন্তু ওর চেহারার নীরব সমর্থন স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। পারভীনের ঠোঁটের কোণেও প্রশ্রয়ের মৃদু হাসি খেলা করে।
ছাত্রজীবনে কংগ্রেসের রাজনীতি করা আমার আমলা বাবা এখন মুসলিম লীগের সমর্থক হতে চান। কিন্তু চারদিকে পাঞ্জাবিদের দাপট দেখে নোঙরের ঠিকানা খুঁজে পান না। পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক শিক্ষা তার ছিল। কিন্তু চিত্রা সেনকে পরিবারের একজন করে নেওয়ার মতো যথেষ্ট উদারতা তিনি দেখাতে পারতেন কি না সে সন্দেহ আজও আমার মন থেকে যায়নি।
সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে নেমে এসেছে। আকাশে মাঝবয়েসী চাঁদ। বনগ্রামে হেঁটে যেতে এত সময় লাগছে কেন বুঝতে পারছি না। সেগুনবাগিচা থেকে গুলিস্তান। তার পর নবাবপুর, ঠাঠারী বাজার হয়ে বনগ্রামের রাস্তা। কতটুকুই বা পথ। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন অনন্তকালের যাত্রা। আমার সমস্ত জীবন পাড়ি দিয়ে মকবুলের কাছে পৌঁছাতে হবে না কি!
বনগ্রাম লেনে রাস্তায় বাতি নেই। পথচলতি রিকশার শব্দ মনে করিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীতে আমি, মকবুল, চিত্রা সেন ছাড়াও আরও অনেকে আছে, আছে সময়ের নির্মম জঠরে মুখ লুকানো আমাদের বিগত জীবন।
সদর দরজায় কলিং বেল নেই। আগের মতোই কড়া নাড়ার আওয়াজে দরজা খুলে দিল মকবুল। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, বলল কেমন আছিস। শ্যাওলাধরা উঠানের পাশে কাঠের রেলিং দেওয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই ছাদের ঘরে। দেখি অন্ধকার ছাদের কার্নিশে আগের মতোই আমার প্রতীক্ষায় চুপ করে বসে আছে চিত্রা। তারার আলো তার কালো চুলে অদ্ভুত খেলা জমিয়েছে। উঠানের টব থেকে ভেসে আসছে পারভীনের হাতে লাগানো হাসনা হেনার সুতীব্র ঘ্রাণ...
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর একবার এ বাড়িতে এসেছিলাম মকবুলের খোঁজে। বাড়িটাকে দেখেছিলাম পোড়া ধ্বংসস্তূপের অবয়বে। অন্য বন্ধুদের মুখে শুনেছিলাম মুক্তিযোদ্ধা মকবুল বীরের মতোই যুদ্ধ করে কুষ্টিয়ায় শহীদ হয়েছে। তবে সঠিক খবর বলতে পারেনি কেউ। যেমন সঠিক কেউই বলতে পারেনি ’৬৪-এর দাঙ্গায় দেশ ছেড়ে যাওয়া চিত্রা সেন কোথায় কেমন আছে।