ঢাকা ২৫ ভাদ্র ১৪৩১, সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

১১৩ বনগ্রাম লেন

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ০১:৩১ পিএম
আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ০১:৩১ পিএম
১১৩ বনগ্রাম লেন
আঁকা: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

একটু একটু করে অন্ধকার চুঁইয়ে পড়ছে শহরের বুকে। আঁধারের ডানার নিচে মুখ লুকোচ্ছে শেষ বিকেলের ম্লান অবয়ব। পুরান ঢাকার এইসব গলিঘুঁজি আমার আধচেনা। কোন ছোট বেলায় মকবুলের সঙ্গী হয়ে এ এলাকায় আসা। উঁচু খিলান দেওয়া অন্ধকার বাড়িগুলো তখন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকত। 

ঢাকা তখনো একটা প্রাদেশিক রাজধানী। গুলশান-বারিধারার কৃষকদের কাছে ফসলের মাঠ মগ্ন ইঙ্গিতে বলে মরশুম এবার ভালো যাবে তো। সেগুনবাগিচা থেকে হেঁটে অথবা সাইকেলে বকশিবাজার নবকুমার ইনস্টিটিউট। তার পর মকবুলের হাত ধরে বাখরখানি আর সুতা কাবাবের সন্ধানে অনির্দিষ্ট যাত্রা। 

সেই মকবুলের কণ্ঠস্বর এত বছর পর আমার টেলিফোনের দরজায় কড়া নাড়ে। আজকাল আমার বিস্মৃতির পালা চলছে। যদিও এই বিজ্ঞানের যুগে এখনই আমার বুড়িয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমার চেনাজানা অনেক লেখক বন্ধু এখনো সদ্য তরুণীর বাহুলগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যবসায়ী দোস্ত সালামকে এখনো চল্লিশ বছরের ছোকরা বলে মনে হয়। কিন্তু আমি নিষ্ঠাবান সরকারি আমলার পুত্র, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী, আমার পক্ষে যৌবনের স্বপ্ন দেখাও পাপ। আমার চোখের সামনে সর্বদা ঘুর ঘুর করে সাদা চুলে মেহেদী দেওয়া প্রৌঢ়া স্ত্রী, ডাক্তারি পাস ছেলে। আমার তো এখন ভুলে যাওয়ারই দিন। এই সেগুনবাগিচা যে সেই সেগুনবাগিচা, সে কথাই মাঝে মাঝে ভুলে যাই। বিকেল বেলা লেকের সামনে হাঁটতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই লেকটাকে কিছুতেই খুঁজে পাই না। কাজী সাহেবের বাড়ির আঙিনায় বহুতল ভবন দেখে চমকে উঠে ভাবি এটা কোন জায়গা। 

মকুবলের কণ্ঠস্বরকেই বরং আমার চিনতে ভুল হয় না। অনেক বছর ওর সঙ্গে দেখা না হতে পারে কিন্তু ও তো সেই মকবুল, যার সঙ্গে হোসেনী দালানে মহররমের তাজিয়া দেখতে গেছি, তন্ময় হয়ে শুনেছি মুনীর স্যারের ক্লাস, আসাদ আর মতিউরের দেহ থেকে ঝরে পড়া রক্তের শিল্পকর্ম দেখেছি। এতকাল পর মকবুলের কণ্ঠস্বর যেন বিস্মৃতির বন্ধ দুর্গের সিংহদ্বারে দামামা বাজায়, স্মৃতির বন্ধ দরজা জানালাগুলো উন্মুক্ত হয় একের পর এক। মকবুলের দেওয়া ঠিকানায় মানচিত্র ধরে আমি যাত্রা করি। 

এসব সর্পিল রাস্তা আর গলিপথের ওপর সূর্য তার কর্কশ থাবা বাড়াতে পারেনি। এই শ্যাওলা ঢাকা দেয়ালগুলো যখন গড়ে উঠেছিল তখনো সুতানটি কলকাতা হয়ে ওঠেনি। লালবাগ দুর্গের বাগানে তখন পরীবিবির কলধ্বনি ঝংকার তুলত। ঢাকা তখন সুবেবাংলার রাজধানী। টাকায় আট মণ চালের দিন তখন। 

রিকশার ঠুন ঠুন শব্দে মনে হয় একটা রিকশায় চড়ে বসাই হয়তো সংগত। কিন্তু আমার হাঁটতে ভালো লাগে। শেষ বিকেলের নরম আলোতে অবগাহন করতে করতে আমি মকবুলের বাড়ির খোঁজ করি। মকবুলের হাত ধরে ধীরে ধীরে আমার স্মৃতির আঙিনায় ঢুকে পড়ে আরও কিছু মানুষ, কয়েকটি নাম, কিছুটা সময়।

মকবুলরা থাকত বনগ্রাম লেনে। ওর বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। পশার খুব বেশি ছিল না বলে ঠাঠারী বাজারের একটা দোকানে হিসাব লেখার কাজও করতেন। বনগ্রামে ওদের সেমি দোতলা বাড়ি। নিচ তলায় ছোট ছোট অন্ধকার চার পাঁচটি ঘর, ছাদে মাত্র দুটি। চুন-সুরকির মোটা দেয়াল, শ্যাওলা পড়া পাকা উঠান। জলের কলের পাশেই উঠানের এক কোণে একটা বড়সড় চৌবাচ্চা, যাকে ওরা বলত হাউস। পানিভরা চৌবাচ্চায় উঁকি দিলে দেখা যায় তলায় চিরস্থায়ী শ্যাওলা।
 
মকবুলরা অনেক ভাইবোন। সবগুলো নিজস্ব নয়- চাচাতো-মামাতোও ছিল। ছাদে ছেলেদের রাজত্ব। দুই ঘরে বড় বড় চৌকি পেতে ঘুমাত। পড়ালেখাও ওই চৌকিতে বসেই। ছাদে রেলিংয়ের বালাই নেই। তবে চওড়া কার্নিশ আছে। সেই কার্নিশে বসে ছুটির দিনে দুপুরে চলত মাখনা, পানিফল আর কদবেলের সদ্ব্যবহার। 

মকবুলের মা চিররোগী। হাঁপানির টান উঠত যখন তখন। সংসার দেখত ওর সেজো বোন বিলকিস বেগম। বড় দুই বুবুর বিয়ে হয়ে গেছে আগেই। বিলকিস বুবুরও বিয়ের কথা চলছে নানান জায়গায়। বাড়িতে মোতাশা মানে মেয়ে ঘটকের আনাগোনা আছে। ছাদ থেকে প্রায়ই দেখতাম আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা কোনো মহিলা ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেল পেছনের দরজা দিয়ে। বিলকিস বুবু ছাদে আচার রোদে দিত। আমাদের দায়িত্ব ছিল কাক তাড়ানো। অবশ্য আমরা দুজন থাকতে কাকের বেটার সাধ্য কী আচারে মুখ দেয়। 

সেগুনবাগিচায় আমাদের সাজানো গোছানো বাড়ি। বাড়ির সামনে বাগান। ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য নেট টাঙানো লন। গেটে দারোয়ান। দেশ বিভাগের সুবাদে কলকাতা থেকে বদলি হয়ে আসা বাবা সেক্রেটারিয়েটের বড় চাকরে। উচ্চ-মধ্যবিত্ত আমাদের বাড়িতে ইংরেজিতে কথাবার্তা, কায়দা-কানুন কোনো কিছুরই অভাব নেই। 

মকবুলদের বাড়ির সঙ্গে আকাশ-পাতাল তফাৎ। তবু ওদের বাড়িই আমার ভালো লাগে। শ্যাওলা ঢাকা এ বাড়িটা যেন অনেক বেশি ছায়াময়। আমি আর মকবুল যখন স্কুল পেরিয়ে ঢাকা কলেজে পা রেখেছি বিলকিস বুবুর তখন বিয়ে হয়ে গেল নারিন্দায়। সংসারের ভার পড়ল মকবুলের পিঠাপিঠি বোন পারভীনের ওপর। মকবুল কলেজে পড়ছে, ঢাকাইয়া ছেলের পক্ষে বিরল ঘটনা। নাজির আহমেদ, সাইদ আহমেদের মতো হাতেগোনা দু-চারটি পরিবার ছাড়া ঢাকাইয়া বাড়ির ছেলেরা স্কুলের গণ্ডি পেরোতে খুব বেশি উৎসাহ পেত না। অনেক বাবা তো বলেই দিত পড়ালিখা কইরা পোলায় কি চাকরি নিব নিহি? ফাইব পাস দিছে বহুত দিছে। তবে মকবুলরা হাফ ঢাকাইয়া। মকবুলের বাবা সদ্য গ্রাম থেকে এসে ওর নানার বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসেবে বহাল হয়েছিলেন। তার পর যা হয়ে থাকে। রাজকন্যা- সেই সঙ্গে বনগ্রাম লেনের শ্যাওলা ধরা রাজত্ব।

বিলকিস বুবু জেসমিন বুবুর মতো, পারভীন অত লাজুক নয়। ছাদের ঘরে এসে আমাদের সঙ্গে দিব্বি আড্ডা জমাত। ভাবে বুঝতাম চাচাতো ভাই মাহাবুবের সঙ্গে ওর বিশেষ কোনো সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। পারভীনের সঙ্গেই কোনো কোনো দিন ছাদের ঘরে উঁকি দিত চিত্রা সেনের মুখ। 

আমাদের চোখজুড়ে তখন সুচিত্রা সেনের স্বপ্ন। মানসী, লায়ন, রূপ মহল যে হলেই উত্তম-সুচিত্রার ছবি আসুক না কেন দেখতে যাওয়া চাই। শুধু একবার নয়, অন্তত তিন-চারবার। ইডেন কলেজের অনেক মেয়ে তখন সুচিত্রার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে গাঢ় স্বরে কথা বলে তার পর মাথা ঝাঁকিয়ে সোজা হেঁটে যায়। হাটখোলার সেন্ট্রাল উইমেন্সেও মেয়েরা পড়ে বটে কিন্তু বেগজাদীর কড়া শাসনে ছেলে-ছোকরার দিকে তাকানোর সাহস নেই তাদের।

ইডেনের ছাত্রী চিত্রা অবশ্যই মিসেস সেনের মতো সুন্দরী নয়। তবে সংস্কৃতিস্নিগ্ধ মুখ। পারভীনের বান্ধবী হলেও ওর মতো নিরেট নয় চেহারা। মকবুলদের পাশের বাড়িতেই চিত্রাদের আবাস। 

আইয়ুব খানের আমল। ’৫০-এর দাঙ্গার পর থেকেই বনগ্রাম, ঠাঠারী বাজারের হিন্দুরা সংকুচিত হতে শুরু করেছে। তবু পুরান ঢাকার এ-বাড়ি ও-বাড়িতে খিড়কি দরজা দিয়ে মেয়েদের চলাচল হিন্দু মুসলমানের বেড়া মানে না। মকবুলের বাবার সঙ্গেও নারায়ণ সেনের হোমিওপ্যাথি নিয়ে তর্কবিতর্ক থামে না। আর কোনো শাস্ত্রের দোহাই পেড়েই তরকারির বাটির চলাচলকে রোখা যায় না।

চিত্রা সেন এ বাড়িতে আসে। মকবুলের কাছ থেকে নীহাররঞ্জনের বই ধার নেয়। আমি ওকে সুচিত্রা সেন ডেকে রাগানোর চেষ্টা করি। ও রাগ করে। কিন্তু যেদিন রাগাতে ভুলে যাই সেদিন বিষণ্নতার ছায়া চোখে নেমে আসে। নারায়ণ সেন মাঝেমধ্যেই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা এর ওর সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু ঠাঠারী বাজারের রমরমা মিষ্টির দোকানের ব্যবসা ছেড়ে নতুন করে আবার কোন বিদেশে যাবেন তা ভেবে পান না। বড় ছেলে জয়ন্ত সেন কমিউনিস্ট। সে বোঝায় এই দেশই আমাদের দেশ। লড়াইটা দেশের বিরুদ্ধে নয়, শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে। কিন্তু নারায়ণ সেন কোনো শ্রেণির চোখেই তার জন্য কোনো সহানুভূতি দেখতে পান না। বরং দেখেন লোভ। বনগ্রাম লেনের তার ভিটেবাড়ি দখল করে নেওয়ার তীব্র লোভ প্রতিবেশীদের চোখে ঝলক দিয়ে ওঠে।

সময়ের মতো সময় গড়িয়ে যেতে দ্বিধা করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পা রাখি আমরা। দেশ বিভাগের মূল্যে কেনা বহু সাধের পাকিস্তানের স্বপ্নের বুঁদবুঁদগুলো ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে। রাজনীতি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। আরও বেশি ভালো লাগে চিত্রা সেনের চোখের গভীরে হারিয়ে যেতে। কোনোদিন বিউটি বোর্ডিং আবার কোনোদিন স্টার কাবাবের টেবিলে শিক কাবাবের প্লেট বা চায়ের কাপ সামনে রেখে বন্ধুদের আড্ডা জমে ওঠে। জমজমাট আড্ডার মধ্য থেকে হঠাৎ উঠে আসি আমি। ১১৩ নম্বর বনগ্রাম লেনের দিকে হাঁটতে শুরু করি।

চিত্রা অপেক্ষা করে থাকে ওদের দোতলার বারান্দায়। আমাকে মকবুলদের ছাদে দেখলেই ও চলে আসে এ বাড়িতে। আমাদের দুজনের মধ্যে যে উত্তাল মেঘনা বহমান তা মকবুল বোঝে। কখনো কিছুই বলে না। কিন্তু ওর চেহারার নীরব সমর্থন স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। পারভীনের ঠোঁটের কোণেও প্রশ্রয়ের মৃদু হাসি খেলা করে।

ছাত্রজীবনে কংগ্রেসের রাজনীতি করা আমার আমলা বাবা এখন মুসলিম লীগের সমর্থক হতে চান। কিন্তু চারদিকে পাঞ্জাবিদের দাপট দেখে নোঙরের ঠিকানা খুঁজে পান না। পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক শিক্ষা তার ছিল। কিন্তু চিত্রা সেনকে পরিবারের একজন করে নেওয়ার মতো যথেষ্ট উদারতা তিনি দেখাতে পারতেন কি না সে সন্দেহ আজও আমার মন থেকে যায়নি।

সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে নেমে এসেছে। আকাশে মাঝবয়েসী চাঁদ। বনগ্রামে হেঁটে যেতে এত সময় লাগছে কেন বুঝতে পারছি না। সেগুনবাগিচা থেকে গুলিস্তান। তার পর নবাবপুর, ঠাঠারী বাজার হয়ে বনগ্রামের রাস্তা। কতটুকুই বা পথ। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন অনন্তকালের যাত্রা। আমার সমস্ত জীবন পাড়ি দিয়ে মকবুলের কাছে পৌঁছাতে হবে না কি! 

বনগ্রাম লেনে রাস্তায় বাতি নেই। পথচলতি রিকশার শব্দ মনে করিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীতে আমি, মকবুল, চিত্রা সেন ছাড়াও আরও অনেকে আছে, আছে সময়ের নির্মম জঠরে মুখ লুকানো আমাদের বিগত জীবন। 

সদর দরজায় কলিং বেল নেই। আগের মতোই কড়া নাড়ার আওয়াজে দরজা খুলে দিল মকবুল। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, বলল কেমন আছিস। শ্যাওলাধরা উঠানের পাশে কাঠের রেলিং দেওয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই ছাদের ঘরে। দেখি অন্ধকার ছাদের কার্নিশে আগের মতোই আমার প্রতীক্ষায় চুপ করে বসে আছে চিত্রা। তারার আলো তার কালো চুলে অদ্ভুত খেলা জমিয়েছে। উঠানের টব থেকে ভেসে আসছে পারভীনের হাতে লাগানো হাসনা হেনার সুতীব্র ঘ্রাণ...

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর একবার এ বাড়িতে এসেছিলাম মকবুলের খোঁজে। বাড়িটাকে দেখেছিলাম পোড়া ধ্বংসস্তূপের অবয়বে। অন্য বন্ধুদের মুখে শুনেছিলাম মুক্তিযোদ্ধা মকবুল বীরের মতোই যুদ্ধ করে কুষ্টিয়ায় শহীদ হয়েছে। তবে সঠিক খবর বলতে পারেনি কেউ। যেমন সঠিক কেউই বলতে পারেনি ’৬৪-এর দাঙ্গায় দেশ ছেড়ে যাওয়া চিত্রা সেন কোথায় কেমন আছে।

তোমাকেও ছোঁবে

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
তোমাকেও ছোঁবে

ভেবো না, তোমাকেও ছোঁবে হিমেল বাতাস
আঁচড়ে দেবে
জীবনের বেলাভূমি
স্বপ্নগুলো উড়ে যাবে বৈশাখী বাতাসে
তোমার বাড়ি তার ভেতরের ঘর
প্রিয় সংগ্রহগুলো
থাকবে না কিছুই-

ভেঙে পড়বে চৈতন্যের কাঠামো
দড়ি বর্গা খড়খড়ি দরজা ধানের মটকা
স্মৃতিময় মুখগুলো হারিয়ে যাবে
ছোঁবে, তোমাকে ছুঁয়ে যাবে
হিমেল বাতাস
থেমে যাবে স্পন্দন
ধূসর প্রদেশে হবে শেষ গন্তব্য তোমার
ফিরবে না আর আলোকিত
নাগরিক কোলাহলে
ভেবো না, ছোঁবে
তোমাকেও-

নষ্টনীড় কাঁধ

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৬ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
নষ্টনীড় কাঁধ

আঁজলায় জমানো ছিল ভোরের কাজল, হৃদি কল্লোল,
দিঘিজল ছোঁয়া ধূলিওড়া লাবণ্য মেঠোপথ।
থাকেনি সেইসব ঐশ্বর্য অপার। তার পর কে যেন কবে
বলেছিল, ‘দাঁড়াও সুপান্থ, পশ্চাতে নদী, এনে দেব
দু’হাতে তোমার, বিহঙ্গ জোয়ার।
কবে কোন দেবদারু রাতে ডেকেছিল রোদরাঙা চাঁদ
                     পেতেছিল শুদ্ধ জলের ছায়ায় শয্যা শোয়ার।
আহা, কার যেন রিনিঝিনি হাত ছুঁয়েছিল নষ্ট নীড় কাঁধ।
তার পর সেই আঁজলা, নদী, চাঁদ, সেই রিনিঝিনি হাত
ঝুলে আছে দ্যাখো, দ্যাখো, একলা হাওয়ায়।

ইচ্ছেধারী পা

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম
ইচ্ছেধারী পা

প্রখর তাপে ঝলসে যাচ্ছে দিনলিপির শরীর 
গর্জে উঠছে না শব্দেরা, হাতচিঠা এসে জমতে চায় 
প্রাচীন শিকারের মতো। মেঘের আঁচল প্রসারিত 
দেখি ছায়াঘর, স্বল্প ঘুমের দেশে সে এক পর্দানশীন  
কোনো লাইনই তাকে রাঙাতে পারে না
আমি নিজের মধ্যেই সমাহিত করি এক অলিখিত চুক্তি 
মধ্যবিত্তের হিসেব। একবার প্রতিলিপি তৈরি হয়ে গেলে  
বিলিয়ে দেবার প্রশ্রয়ও আসে না
একটা বিষণ্ণতার অভাব, নিদেনপক্ষে কিছু বিষাদ  
কেউ কি ফিরে এসে দ্যাখে 
               এই অভিপ্রেত শরীর বেঁচে আছে কিনা?  
এই যে মাঝ নদী, এই যে নৌকাবিহার
এই যে আমাদের ইচ্ছেধারী পা  
একে অপরের দিকে প্যাডেল করে অন্বয় হচ্ছে 
সেসব ত্যাগ করে কেন আমি ডুবে যাব!

ভেতো হাসির গল্প

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০১ পিএম
আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০১ পিএম
ভেতো হাসির গল্প
আঁকা: নিয়াক চৌধুরী তুলি

কেরামত আলীর হাসি আর থামে না।
বড্ড সহজ-সরল নির্বিবাদী মানুষ সে। সারা দিন সারাবেলা হাসিখুশি থাকে। দুঃখ-দৈন্য কখনো তাকে স্পর্শ করে না। পেটপুরে ভাত খাওয়া তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের কাজ। এ আনন্দের সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনাই হয় না। খেতে বসে পেট না ভরলে তার মন ব্যাজার হয়, মাথায় ঠিকমতো কাজ করে না। এমন অঘটন কখনো ঘটলে আমার মায়ের চোখে ব্যাপারটা ঠিকই ধরা পড়ে, কেরামতের মুখের দিকে তাকিয়ে মা তখন বলে, আর দুটো ভাত নিবি কেরু?

কেরু মানে কেরামত আলী মুখ ফুটে কিছুই বলে না, এ প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ অথবা না কোনোটিই পষ্টাপষ্টি জানায় না, কেবল সাদা ফকফকে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হেসে ওঠে। ওই হাসিতেই উত্তর বুঝে নেয় আমার মা। গামলা ভর্তি বাড়তি ভাত এনে কেরুর সামনে বাড়িয়ে ধরে। তরিতরকারি নিয়ে কেরুর বিশেষ ভাবনা নেই। এক বাটি ডালের সঙ্গে গোটা দুই কাঁচা মরিচ হলেই তার পূর্ণ তৃপ্তি। আহার শেষে থালাবাটি ধুয়ে কাঁধের গামছায় হাত-মুখ মোছা হলে তখন শ্বেতপদ্ম ফুটে ওঠে তার মুখের হাসিতে। কালো মানুষের মুখে সাদা দাঁতের কার্পাসফাটা হাসি দেখে আমার মায়েরও মন ভরে যায় তৃপ্তিতে, নিজেও হাসিমুখে ঘোষণা দেয়- এইবার খুশি আমার কেরু পাগল। এইবার যা ইচ্ছে তাই হুকুম করো, কেরুর মুখে আর রা নেই।

কেরামত আলীকে গ্রামের সবাই ডাকে কেরু বলে, কেবল আমার মাকেই দেখেছি তার নামের সঙ্গে পাগলটুকু জুড়ে দিয়ে সস্নেহ আশকারা দিতে। নিজের পেটের তিন পুত্রের মাঝখানে অলক্ষ্যে কোথায় যেন একটুখানি আলগা জায়গা ছেড়ে দেয় মা। সেই জায়গাটুকু সর্বসমক্ষে দৃশ্যমান না হলেও আমি বেশ ধরতে পারি। আমার বড় ভাই এবং মেজো ভাইকে তো আশৈশব তুই-তোকারিই করতে দেখেছি, কেবল আমিই সেটা পারিনি। বাড়ির রাখাল থেকে কৃষাণ হয়েছে কেরু আমাদের চোখের সামনেই, তার সঙ্গে তুই-তোকারিই তো স্বাভাবিকভাবে প্রচলিত এবং বিধিসম্মত। তবু আমি তাকে কেরুভাই বলে সম্মোধন করে এসেছি। আমার চেয়ে শুধু বয়সে বড় নয়, শরীর-স্বাস্থ্যেও কেরামত আলী আমার দ্বিগুণ। এই শরীরেরও তো একটা সম্ভ্রম আছে! বুদ্ধিতে হয়তো কিছুটা পিছিয়ে থাকতে পারে। তা-ই বা নিঃসংশয়ে বলি কী করে! ওই মোটা বুদ্ধি নিয়েই তো দিব্যি সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। নিজে কুচকুচে কালো হয়েও কপালগুণে ফরসা ধবধবে একটা বউ পেয়েছে, তারই পেটে দু-দুটো হৃষ্টপুষ্ট সন্তান পেয়েছে, এসব নিয়ে তার সংসার। আমার বাবা যথার্থই নিজে হাতে গড়েপিটে তাকে সংসারী করে গেছেন। বিয়ের সময় পাত্রের গাত্রবর্ণ নিয়ে একটুখানি খুঁতখুঁতানি উঠলে পাত্রীপক্ষকে গভীর আস্থার সঙ্গে আশ্বস্ত করেছেন- গায়ে-গতরে খেটে কেরু ঠিকই পেটের ভাত জোগাড় করে নেবে। দেখে নিও সবাই, কেরুর কোনোদিন ভাতের অভাব হবে না।

বিয়ের পর আমাদের ভিটে-জমির পুবের কোনায় কেরুর জন্য নতুন ঘর তুলে দেওয়া হয়। সেই ঘরেই তার সংসার-পত্তনি। আমাদের পিতৃ-বিয়োগের পর বিষয়-সম্পত্তি ভাইয়ে-ভাইয়ে ভাগাভাগি হলেও কেরুর ঘরবাড়ি নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি। আমাদের সঙ্গে থেকে শুধু জমিজায়গা নয়, যথার্থই আমাদের সবাইকে আগলেও রাখে সে। দূরবর্তী স্থানে বিবাহিত আমাদের দুই বোনের সঙ্গে যোগাযোগও রাখে সে। তবু কারও কাছে কোনো দাবি নেই। তার চাহিদা খুবই সামান্য এবং সেটুকু নির্দ্বিধায় জানায় আমার মায়ের কাছে। আর কিছু নয়, সে খাবার সময় পেটভরা ভাত চায়। তাহলেই সব বোঝা টানতে পারে, সব হুকুম পালন করতে পারে হাসিমুখে। আসলে সে-ই সার্থক করেছে প্রবাদবাক্য- পেটে খেলে পিঠে সয়, গাধাও তখন বোঝা বয়।

পেটের খাদ্য বলতে কেরু শুধু ভাতই বোঝে। ভাত ছাড়াও আরও কত রকম খাদ্য যে এ দুনিয়ায় আছে, আছে শতেক রকম পিঠেপুলি, সে যে তার খবর রাখে না, তা নয়। কিন্তু তার সব চেয়ে প্রিয় খাবার ভাত। গরম ভাত, পান্তাভাত, কড়কড়ে ভাত, খিচুড়ি ভাত- যেমনই হোক, ভাত হলেই হলো। তার যুক্তি খুবই সোজা- খালা বলো ফুপু বলো মায়ের সমান কে, মাকে পেলে আমি তো আর কিছু  চাইনে। কথায় কথায় এমনি ধারা কাব্যি গাওয়া স্বভাব তার। পেটের ভেতরে কথা জমানোই থাকে, কথার পিঠে কথা বলতে গিয়ে এই সব কাব্যি উগরে দেয় মুখে মুখে। ভাতের কেচ্ছা বলতে বলতে অতি শৈশবে শোনা তার বাপের খিদের গল্পও সে গড়গড় করে বলে যায়। কবে নাকি রাতের আঁধারে কার হেঁসেলে ঢুকে হাপুসহুপুস করে পান্তাভাত খাবার সময় তার বাপ ধরা পড়েছিল একটা কাঁচা মরিচের জন্য। মায়ের কাছে শুনেছে সেই আকালের বছরে ভাত চুরির অপরাধে বেচারা খুব পিটুনি খেয়েছিল। শুধু পিটুনি নয়, আরও নির্মম শাস্তিও সে ভোগ করে। পিঠমোড়া করে দুহাত বেঁধে লাল পিঁপড়ের চাকের ওপরে তাকে ফেলে রাখে। ভাতের জন্য মানুষের এমন শাস্তির কথা শুনে আমরা অনেকেই শিউরে উঠি, কিন্তু ভাতের প্রতি ভক্তি জানাতে কেরামত কাব্যি গেয়ে শোনায়- ভাতই আমার আল্লা রসুল ভাতই ভগবান, ভাতই আমার মানসম্মান ভাতেই অপমান।

ভাতপাগল এই মানুষটি সেদিন হাসপাতালে যাওয়ার পর ডাক্তারের মুখে যে-কথা শুনে আসে, তাতে তার মাথায় বাজ পড়ে। কিন্তু বজ্রপাতের আঘাতে স্তব্ধ মানুষ কখনো হা হা করে উদ্দাম স্রোতের মতো হাসতে পারে! আমাদের কেরামত আলী ওরফে কেরু ভাই হাসে, বাঁধভাঙা হাসির স্রোতে ভাসিয়ে দেয় চারদিক। এমন হাসির উচ্ছ্বাস আগে কখনো দেখিনি।

আমিই তাকে জোর করে ঠেলে পাঠিয়েছিলাম উপজেলা হাসপাতালে, আমার এক ডাক্তার বন্ধুর নামে চিঠি লিখে সেটাও ধরিয়ে দিয়েছিলাম তার হাতে। মাঠেঘাটে কখন অসাবধানে কাঁটাখোঁচের ধাক্কায় তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল কেটে রক্তাত হয়েছে, মাসখানেকের মধ্যে সেই ঘা আর শুকায় না। গ্রাম্য ডাক্তারিতে কাজ না হলে আমি একরকম জোর করেই তাকে হাসপাতালে পাঠাই। আমার বন্ধু ডাক্তার জাহিদ ক্ষতস্থান ধুয়ে মুছে যত্ন করে চিকিৎসা ঠিকই দিয়েছে, কিন্তু রক্ত পরীক্ষার পর তার কানের কাছে ভয়াবহ বোমা ফাটিয়েছে- কেরামত আলীর ডায়াবেটিস না কমলে ঘা শুকোবে না।

ডায়াবেটিস!

কেরামত আলী চমকে উঠলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। এ রোগের নাম তার অজানা নয়। নানান আজগুবি কথা শুনেছে এই রোগ নিয়ে। তবু সাহস করে সে বলে- 

তা হলি সেই রোগেরই ওষুধ দেন আমাকে।

প্রয়োজনীয় ওষুধপত্তর ঠিকই দিয়েছে ডাক্তার, সেই সঙ্গে এক গাদা লেকচার শুনিয়েছে ডায়াবেটিস রোগীর করণীয় সম্পর্কে। সেসব ঠিকই আছে, অসুখ হলে তো ডাক্তারের কথা শুনতেই হয়, তাই বলে ভাতকে বিষ বললে তাও মানতে হবে!

কেরুর তো তখন বুকে খিল লাগার দশা।

ভাত-রুটি-চিঁড়া-মুড়ি- এসবই নাকি ডায়াবেটিস রোগীর জন্য বিষের মতো। ডাক্তার চিনিকে বলে হোয়াইট পয়জন। তাহলে মানুষ বাঁচবে কী খেয়ে? ডাক্তার সে তালিকাও শুনিয়েছে ধৈর্যসহকারে। শুনতে ভালো লাগেনি বলে সে ঠিকমতো মনোযোগ দেয়নি। বরং বিদায় নেওয়ার সময় ভাতের প্রসঙ্গ পুনরায় তুলেছে- ভাত না খালি মানুষ বাঁচে স্যার?

অবশেষে দয়াপরবশ হয়ে ডাক্তার ভাতের বরাদ্দ অনুমোদন করেছে যৎসামান্য। সেই ভাতের পরিমাণ শুনে কেরুর ব্রহ্মচাঁদি ধাঁ করে জ্বলে ওঠে, সহসা আকাশসমান ক্ষুধায় সারা শরীর কাঁপতে থাকে; তখন সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয়।

বাড়ি পৌঁছেই মন ভালো হয়ে যায় কেরামত আলীর। সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা স্ত্রী তার সামনে গামলা ভর্তি ভাত এগিয়ে দেয়। বেগুন ভাজা, কচু শাকের ঘণ্ট, মসুরের ডাল সঙ্গে কাগজি লেবুর ফালি। আহা, নাক ডুবিয়ে খাওয়া যাকে বলে আর কী। এ জন্য কেউ কেউ তাকে মোষের সঙ্গেও তুলনা করে। মোষ তো দাঁত মেলে হাসতে পারে না, কেরু শোনে আর হাসে। তার স্ত্রী মাথায় ঘোমটা টেনে মধুর কটাক্ষ করে- হাসতি নজ্জাও করে না তুমার!

কেরু হাসপাতালের চিকিৎসা-বৃত্তান্ত আমার কাছে শোনাতে আসে সন্ধ্যাবেলায়। বিস্তারিত সব কথা খুলে বলতে চায়, কিন্তু বলা হয় না। হুড়মুড় করে এগিয়ে আসে ভাতের কথা। ভাপ ওঠা ভাত হোক কিংবা বাসি-পচা পান্তাই হোক, পেট পুরে ভাত না খেলে মানুষ বাঁচবে কেমন করে, তাই নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তা তার। সেই দুর্ভাবনার কথাটা ব্যক্ত করতে গিয়েই কেরু ভাইয়ের বুক ঠেলে হাসির গমক উঠে আসে। বাপরে, সে কী বিরামবিহীন হা হা হাসি! সে হাসি থামতেই চায় না। মুখ হা হয়ে চোয়াল আটকে থাকে। হা-ও বন্ধ হয় না, হাসিও থামে না কিছুতেই। এমন বিদঘুটে হাসি হাসতে দেখে আমার একটু একটু ভয় করে, আন্তরিক গলায় আমি তার নাম ধরে ডাকি- কেরু ভাই! শোনো কেরু ভাই!

না, সে আমার ডাক যেন শুনতেই পায় না। ধবধবে সাদা দুপাটি দাঁতের ফাঁকে হা করে সে হাসতেই থাকে, হাসতেই থাকে। আমি ভয়ার্ত হাতে হাস্যোজ্জ্বল মুখটা জড়িয়ে ধরতেই টের পাই তার দুচোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে তপ্ত অশ্রুধারা। এইবার আমি উদ্বেগে শিউরে উঠি- হাসি নয়, কেরামত আলী কি এতক্ষণ তবে কাঁদছে! মানুষের ভেতো হাসি কি এভাবে কান্নার হ্রদে নেমে আসতে পারে!

কেরামত আলীর হাসি অথবা কান্নার ধ্বনি শুনে তার স্ত্রী আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে আসে এবং পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে স্বামীর মুখ।

বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৭ পিএম
বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

‘মানুষ কি চায়- উন্নতি, না আনন্দ? উন্নতি করিয়া কি হইবে যদি তাহাতে আনন্দ না থাকে? আমি এমন কত লোকের কথা জানি, যাহারা জীবনে উন্নতি করিয়াছে বটে, কিন্তু আনন্দকে হারাইয়াছে।... জীবন তাহাদের নিকট একঘেয়ে, একরঙা, অর্থহীন। মন শান-বাঁধানো- রস ঢুকিতে পায় না।’...

বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের হৃদয়ে কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, দিনলিপি ইত্যাদি। জন্ম ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। পৈতৃক নিবাস যশোর জেলায়। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত ও মাতা মৃণালিনী দেবী। সাহিত্যিক-সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯) লেখাটি পছন্দ করে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশ করলে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘অপরাজিত’ (১৯৩২)... এবং গল্পসংকলন ‘মেঘমল্লার’ (১৯৩১)...। মৃত্যু ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র পুরস্কারে’ (১৯৫১) ভূষিত হন।