টিভিতে খবর দেখলাম- সব থানার কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হয়েছে।
তখন আমার মনে পড়ল, একটা জিডি করা প্রয়োজন।
কয়েকদিন আগে বাসা থেকে বৈদ্যুতিক পোস্টপেইড মিটার চুরি হয়েছে। জিডি না করলে নতুন মিটার মিলবে না। অগত্যা জিডি লিখে নিয়ে স্থানীয় থানায় গেলাম।
রিসিভ কপি নেওয়ার সময় জানতে চাইলাম, ‘কত দেব?’
‘জিডি করতে টাকা লাগে না স্যার।’ দায়িত্বে থাকা পুলিশ জানাল।
মনে মনে বললাম, আমিও তাই জানতাম। কিন্তু এর আগে যতবার থানায় এসেছি, টাকা না দিলে জিডি হতোই না।
নতুন বাংলাদেশের এ এক নতুন রূপ!
বের হয়ে যাব ভাবছি, এমন সময় ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল।
বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
‘স্যার, ও স্যার। একটু শুনে যান।’
বাম পাশে হাজতখানা। তার ভেতর থেকে কে যেন ডাকছে।
‘আমাকে বলছেন?’
‘জি স্যার। একটু এদিকে আসবেন।’
এগিয়ে যেতেই দেখি, এই এলাকার প্রাক্তন এমপি। বুঝলাম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে ধরে এনেছে।
‘কিছু বলবেন?’
‘জি স্যার। আমাদের দলের জামান উকিলকে খবর দিতে পারবেন? আমার জামিনের আবেদনটা করাতাম।’
মনে পড়ল, একবার এই এমপি সাহেবের কাছে একটা প্রয়োজনে গিয়ে বলেছিলাম, ‘ভাই, আমার কাজটা যদি করে দিতেন, খুব উপকার হয়। তিনি ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ভাই কীসের, স্যার বলুন। স্যার।’
সেই তিনি এখন আমাকেই ‘স্যার’ ডাকছেন।
‘আপনি লিডার মানুষ। দলের লোকজন আপনাকে দেখতে আসবেই। তাদেরকে উকিল ডেকে দিতে বলতে পারেন।’
‘ওরা কেউ আসবে না স্যার। বিপদে পড়েছি। বিপদে পড়লে এসব মধুলোভী মৌমাছিরা কেউ পাশে থাকে না।’
‘আপনি পালিয়ে যেতে পারতেন। সবাই গা ঢাকা দিয়েছে। আপনি পারলেন না?’
‘দিয়েছিলাম স্যার। বাধ্য হয়ে ধরা দিয়েছি।’
গল্পের গন্ধ পেলাম। বাইরে আরও জোরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল।
‘কী ঘটেছিল? কীভাবে ধরা পড়েছিলেন?’ জানতে চাইলাম।
তিনি বলতে শুরু করলেন-
“আমি বা আমার দলের কেউই ভাবিনি, তিনি আমাদের অথই জলের মধ্যে এভাবে ফেলে পালিয়ে যাবেন। তার পালানোর খবর যখন পেলাম, তখন আমি মাত্র দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলাম। শহরের চারদিক থেকে মারামারির খবর আসছিল। আমার ছেলেরা ছাত্র-জনতার সঙ্গে পেরে উঠছিল না। মন মনে ক্ষীণ আশা ছিল, যেহেতু সেনাবাহিনী মাঠে আছে শেষপর্যন্ত আমরাই জিতব।
তার পালানোর খবর শুনে সবার আগে মাথায় এল আমাকেও পালাতে হবে। দুপুরের খাওয়া আর হলো না। পরিবারের সবাইকে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। টাকা-পয়সা, গহনা, সঞ্চয়পত্রসহ যা যা পারল, ওরা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
ওরা চলে যাওয়ার পর শূন্য ঘরটিতে আমি তাকালাম। স্মৃতিবিজড়িত কত কিছুই না থেকে গেল। আমার বাসাসংলগ্ন একটা ঘরে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতাম। সেই ঘরে গেলাম। আলমারিতে সাজানো থরে থরে ক্রেস্ট আর মেডেলগুলোর দিকে তাকালাম।
মনে হলো, ক্রেস্টের লেখাগুলো আমাকে উপহাস করছে। দাঁত বের করে হাসছে।
জনদরদি নেতা!
কৃষকের বন্ধু!
মহান নেতা!
গরিবের বন্ধু!
কত উপমাই না লেখা হয়েছে আমাকে ঘিরে।
মোবাইল বেজে উঠল। এসপির কল।
‘স্যার, এখনই বাসা থেকে বের হয়ে যান। পাবলিক আপনার বাসার দিকে এগিয়ে আসছে।’
চমকে উঠলাম।
বাসা থেকে বের হতে হবে। দ্রুত।
নিজেকে তাড়া দিলাম। তখনই আতঙ্ক আমাকে চেপে ধরল।
গত পনেরো বছরে সবসময় অন্যের পরামর্শে চলেছি। এখন আমার পাশে কেউ নেই। আমি কোথায় যাব? কে আমাকে সঠিক পরামর্শ দেবে।
মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল।
আবার ফোন।
‘মামা, তাড়াতাড়ি পালান।’ ভাগ্নের গলা।
পালালাম আমি চাদর মুড়ি দিয়ে বাসার পেছন দিক দিয়ে। রাস্তায় বের হওয়ার মুখে বাধা পেলাম। একের পর এক মিছিল যাচ্ছে। আবার অন্যদিক থেকেও আসছে।
সবাই আমার বিরুদ্ধে। আমি এক জায়গায় লুকিয়ে পড়লাম।
ফলে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে পারলাম। শেষে ঠিক করলাম, বর্ডার এলাকায় চলে যাব। ওখানে আমার দূর সম্পর্কের এক খালা আছে।
সবার আগে মোবাইলটা ফেলে দিলাম। ফেলে দিতে অবশ্য মায়াই লাগল। অত দামি একটা ফোন।
উপহার হিসেবে পাওয়া।
তবু জান বাঁচানো ফরজ ভেবে নিজেকে বুঝ দিলাম। সন্ধ্যার পর রওনা হলাম।
খালার বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়েছিল ওরা। আমার ডাক শুনে সবাই জেগে উঠল।
আমি বেঁচে আছি দেখে সবাই স্বস্তি প্রকাশ করল।
‘এখন কী করবেন ভাইজান?’ নাজমুল বলল। খালাতো ভাই।
‘বর্ডার পার হব। ইন্ডিয়া যেতে পারলে বেঁচে যাব।’
‘যাবেন কীভাবে ভাইজান? বর্ডারে খুব কড়াকড়ি।’
‘যেভাবে পারিস ভাই। যত টাকা লাগে দেব। তুই শুধু ম্যানেজ কর।’
অনুনয় করলাম।
‘আচ্ছা দেখছি ভাই।’ বেরিয়ে গেল নাজমুল।
ঘণ্টাখানেক পর ফিরল সে।
‘ভাই, আজ রাতে ভোরে পার হওয়া যাবে না। কাল সন্ধ্যার পর চেষ্টা করতে হবে।’
‘আজ কি কোনোভাবেই সম্ভব নয়?’
কাঁটাতারের বেড়া। সার্চলাইট। আর বিএসএফের পাহারা। সব মিলিয়ে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে ভাইজান?’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
‘আমার সঙ্গে আসেন ভাইজান।’
নাজমুল আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
‘কোথায় যাচ্ছি?’
‘আমাদের বাসায় রাখা যাবে না। তাই আপনাকে অন্য জায়গায় রেখে আসতে যাচ্ছি।’
‘কার বাসায়?’
‘কারও বাসায় না ভাইজান। সেটা রিস্ক হয়ে যাবে।’
‘তাহলে?’
‘এখানে একটা পুরোনো জমিদার বাড়ি আছে না? আজ রাতে ওখানে থাকুন। কেউ সন্দেহ করবে না।’
আবছাভাবে আমার মনে পড়ল। পুরোনো একটা জমিদার বাড়ি আছে। জঙ্গল দিয়ে ভরা।
‘ওই জঙ্গলভরা বাসায় কীভাবে থাকব?’ সংশয় প্রকাশ করলাম।
‘জঙ্গল আর নেই ভাইজান। আমরাই কেটে সাফ করেছি।’
‘কেন?’
‘ওই জমিদার বাড়িটা দেখতে অনেক দেশি-বিদেশি পর্যটক আসে। তখন স্থানীয়রা মিলে নিজেরাই পরিষ্কার করেছি।’
‘রাতে থাকার মতো ব্যবস্থা?’
‘ওখানে নেশাখোররা আস্তানা বানাতে চেয়েছিল। তাই আমরা পালা করে ওই জমিদার বাড়িতে থাকি।’
‘আজ কি আমি একাই থাকব?’
‘না ভাইজান। আমি বাইরের ঘরে আপনাকে পাহারা দেব।’
স্বস্তি পেলাম। যত দূরের সম্পর্কই হোক, ভাই তো। আজ রাতটা কোনোমতে কাটুক।
জমিদার বাড়িটা পুরোনো হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। চার্জার লাইট রেখে আমাকে আমার বিছানা দেখিয়ে নাজমুল বের হয়ে গেল।
‘ভাইজান, দরকার হলে ফোন দিয়েন।’
শুয়ে পড়লাম আমি। চারপাশে অন্ধকার। দূরে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। পাতার সর সর শব্দ। টের পেলাম দুচোখে ঘুম আসছে না।
বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো।
‘ক্যামন আছেন?’ ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল কে যেন।
হিমশীতল আতঙ্ক বয়ে গেল আমার সারা শরীরে। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হলো না। একে তো ক্ষমতা হারানোর শোক। তার ওপর রাজকীয় জীবন হঠাৎ হারিয়ে ভিখারির জীবনে প্রবেশ। আর এখন মাঝরাতে অজানা নির্জন জমিদার বাড়িতে বসে ভূতুড়ে গলার আওয়াজ আতঙ্কে ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো আমার।
‘বললেন না ক্যামন আছেন?’
‘ভা...লো...নে...ই।’
‘কেন?’
‘ক্ষ...ম...তা হারিয়েছি। ইন্ডিয়া পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম আজ রাতের মধ্যে। সীমান্তের কড়াকড়ির জন্য পারছি না।’
‘আমিও পারছি না। সেই কবে থেকে চেষ্টা করছি।’ অন্ধকার চিরে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা ভেসে এল।
‘আপনিও কি আমার মতো দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
তার জবাব শুনে ভরসা পেলাম। যাক, আমি তাহলে একা নই।
‘আপনি কী করেন?’ জানতে চাইলাম।
‘জিজ্ঞেস করুন কী করতাম না। ড্রাগস, চোরাচালান, মাদক।’
‘তাহলে তো পুলিশ আপনাকে খুঁজবেই।’
বলার পরই বুঝতে পারলাম শব্দটা পুলিশ হবে না। পুলিশও তো আমার মতো পালিয়েছে।
‘পুলিশ না। আমি পালিয়েছি জনতার ভয়ে।’
আমি কীভাবে পালিয়ে এসেছি সেটা স্মরণ করলাম।
‘কখন বের হয়েছেন বাসা থেকে?’
‘বেশ কিছুদিন হলো।’ ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলাটি বলল।
সন্দেহ হলো। সরকার পতন হলো আজ আর ব্যাটা বলে কিনা কয়েকদিন আগে পালিয়েছে।
‘এই কয়দিনে বর্ডার পার হতে পারেননি?’
‘না। দালালটা বলল আমি সন্ধ্যায় এসে আপনাকে নিয়ে যাব। পরে আর এলই না। আমার টাকা-পয়সা সব নিয়ে ভেগেছে।’
‘কত তারিখে এসেছেন আপনি?’
‘ছয় ডিসেম্বর।’
চমকে গেলাম।
আজ পাঁচ আগস্ট। আর উনি কি না বলছেন ডিসেম্বরে এসেছেন!
রেগে গেলাম। ‘কত সালে?’
‘উনিশ শ নব্বই সালে।’
উনিশ শ নব্বই সালের ছয় ডিসেম্বরে স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়েছিল। আমিও সেই আন্দোলনে শরিক হয়েছিলাম।’
কিছু একটা বলতে যাব তার আগেই প্রচণ্ড বজ্রপাত হলো।
সেই বজ্রপাতের ক্ষণিকের আলোয় দেখলাম আমার সামনে একটা কংকাল বসে আছে। যেন দাঁত বের করে হাসছে। পড়িমড়ি করে বের হয়ে এলাম। ছুটতে ছুটতে কখন যে সেনাবাহিনীর গাড়ির সামনে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছি নিজেও জানি না।’
একনাগাড়ে বলার পর থামলেন নেতা।
‘সামান্য একটা কংকাল দেখে পালিয়ে এলেন।’ হেসে জানতে চাইলাম।
‘আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার। নির্জন জমিদার বাড়িতে ভূতের হাতে অপঘাতে মরার চেয়ে জেলখানায় থাকা অনেক ভালো। একদিন না একদিন জামিন পাবই।’
হেসে ফেললাম।
‘আপনি এখন জেলেই আছেন।’
‘কে ওখানে?’ একজন কনস্টেবল এগিয়ে এল।
নিজের পরিচয় দিলাম।
‘বৃষ্টির জন্য আটকে পড়েছি।’
‘হাজাতির সঙ্গে আলাপ করা নিষেধ।’ বলল কনস্টেবল।
‘বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে দেখে ডাকলেন।’
‘নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে ভূতুড়ে জমিদার বাড়ির গল্পটা বলেছে আপনাকে?’
‘বানানো?’
‘আমাদের স্যাররা বর্ডার থেকে অনেক কষ্ট করে ধরে এনেছেন তাঁকে।’
‘উনি নাকি নিজে নিজেই ধরা দিয়েছেন।’
‘ক্ষমতা হারাইছে তো। মাথাটাথা আউলায় গেছে।’ হেসে বলল কনস্টেবল।