ঢাকা ২৫ কার্তিক ১৪৩১, রোববার, ১০ নভেম্বর ২০২৪

ক্ষমতা

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২০ পিএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২১ পিএম
ক্ষমতা
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

টিভিতে খবর দেখলাম- সব থানার কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হয়েছে। 
তখন আমার মনে পড়ল, একটা জিডি করা প্রয়োজন। 
কয়েকদিন আগে বাসা থেকে বৈদ্যুতিক পোস্টপেইড মিটার চুরি হয়েছে। জিডি না করলে নতুন মিটার মিলবে না। অগত্যা জিডি লিখে নিয়ে স্থানীয় থানায় গেলাম।

রিসিভ কপি নেওয়ার সময় জানতে চাইলাম, ‘কত দেব?’
‘জিডি করতে টাকা লাগে না স্যার।’ দায়িত্বে থাকা পুলিশ জানাল।

মনে মনে বললাম, আমিও তাই জানতাম। কিন্তু এর আগে যতবার থানায় এসেছি, টাকা না দিলে জিডি হতোই না। 
নতুন বাংলাদেশের এ এক নতুন রূপ! 
বের হয়ে যাব ভাবছি, এমন সময় ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল।

বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। 
‘স্যার, ও স্যার। একটু শুনে যান।’

বাম পাশে হাজতখানা। তার ভেতর থেকে কে যেন ডাকছে।
‘আমাকে বলছেন?’
‘জি স্যার। একটু এদিকে আসবেন।’

এগিয়ে যেতেই দেখি, এই এলাকার প্রাক্তন এমপি। বুঝলাম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে ধরে এনেছে।
‘কিছু বলবেন?’
‘জি স্যার। আমাদের দলের জামান উকিলকে খবর দিতে পারবেন? আমার জামিনের আবেদনটা করাতাম।’

মনে পড়ল, একবার এই এমপি সাহেবের কাছে একটা প্রয়োজনে গিয়ে বলেছিলাম, ‘ভাই, আমার কাজটা যদি করে দিতেন, খুব উপকার হয়। তিনি ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ভাই কীসের, স্যার বলুন। স্যার।’

সেই তিনি এখন আমাকেই ‘স্যার’ ডাকছেন।
‘আপনি লিডার মানুষ। দলের লোকজন আপনাকে দেখতে আসবেই। তাদেরকে উকিল ডেকে দিতে বলতে পারেন।’
‘ওরা কেউ আসবে না স্যার। বিপদে পড়েছি। বিপদে পড়লে এসব মধুলোভী মৌমাছিরা কেউ পাশে থাকে না।’
‘আপনি পালিয়ে যেতে পারতেন। সবাই গা ঢাকা দিয়েছে। আপনি পারলেন না?’
‘দিয়েছিলাম স্যার। বাধ্য হয়ে ধরা দিয়েছি।’

গল্পের গন্ধ পেলাম। বাইরে আরও জোরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল।
‘কী ঘটেছিল? কীভাবে ধরা পড়েছিলেন?’ জানতে চাইলাম।
তিনি বলতে শুরু করলেন-

“আমি বা আমার দলের কেউই ভাবিনি, তিনি আমাদের অথই জলের মধ্যে এভাবে ফেলে পালিয়ে যাবেন। তার পালানোর খবর যখন পেলাম, তখন আমি মাত্র দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলাম। শহরের চারদিক থেকে মারামারির খবর আসছিল। আমার ছেলেরা ছাত্র-জনতার সঙ্গে পেরে উঠছিল না। মন মনে ক্ষীণ আশা ছিল, যেহেতু সেনাবাহিনী মাঠে আছে শেষপর্যন্ত আমরাই জিতব।

তার পালানোর খবর শুনে সবার আগে মাথায় এল আমাকেও পালাতে হবে। দুপুরের খাওয়া আর হলো না। পরিবারের সবাইকে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। টাকা-পয়সা, গহনা, সঞ্চয়পত্রসহ যা যা পারল, ওরা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

ওরা চলে যাওয়ার পর শূন্য ঘরটিতে আমি তাকালাম। স্মৃতিবিজড়িত কত কিছুই না থেকে গেল। আমার বাসাসংলগ্ন একটা ঘরে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতাম। সেই ঘরে গেলাম। আলমারিতে সাজানো থরে থরে ক্রেস্ট আর মেডেলগুলোর দিকে তাকালাম।

মনে হলো, ক্রেস্টের লেখাগুলো আমাকে উপহাস করছে। দাঁত বের করে হাসছে। 
জনদরদি নেতা!
কৃষকের বন্ধু!
মহান নেতা!
গরিবের বন্ধু! 
কত উপমাই না লেখা হয়েছে আমাকে ঘিরে।

মোবাইল বেজে উঠল। এসপির কল।
‘স্যার, এখনই বাসা থেকে বের হয়ে যান। পাবলিক আপনার বাসার দিকে এগিয়ে আসছে।’
চমকে উঠলাম।
বাসা থেকে বের হতে হবে। দ্রুত।
নিজেকে তাড়া দিলাম। তখনই আতঙ্ক আমাকে চেপে ধরল। 

গত পনেরো বছরে সবসময় অন্যের পরামর্শে চলেছি। এখন আমার পাশে কেউ নেই। আমি কোথায় যাব? কে আমাকে সঠিক পরামর্শ দেবে।
মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল।
আবার ফোন।
‘মামা, তাড়াতাড়ি পালান।’ ভাগ্নের গলা। 
পালালাম আমি চাদর মুড়ি দিয়ে বাসার পেছন দিক দিয়ে। রাস্তায় বের হওয়ার মুখে বাধা পেলাম। একের পর এক মিছিল যাচ্ছে। আবার অন্যদিক থেকেও আসছে।

সবাই আমার বিরুদ্ধে। আমি এক জায়গায় লুকিয়ে পড়লাম।
ফলে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে পারলাম। শেষে ঠিক করলাম, বর্ডার এলাকায় চলে যাব। ওখানে আমার দূর সম্পর্কের এক খালা আছে।
সবার আগে মোবাইলটা ফেলে দিলাম। ফেলে দিতে অবশ্য মায়াই লাগল। অত দামি একটা ফোন। 
উপহার হিসেবে পাওয়া। 

তবু জান বাঁচানো ফরজ ভেবে নিজেকে বুঝ দিলাম। সন্ধ্যার পর রওনা হলাম।
খালার বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়েছিল ওরা। আমার ডাক শুনে সবাই জেগে উঠল।
আমি বেঁচে আছি দেখে সবাই স্বস্তি প্রকাশ করল।

‘এখন কী করবেন ভাইজান?’ নাজমুল বলল। খালাতো ভাই।
‘বর্ডার পার হব। ইন্ডিয়া যেতে পারলে বেঁচে যাব।’
‘যাবেন কীভাবে ভাইজান? বর্ডারে খুব কড়াকড়ি।’
‘যেভাবে পারিস ভাই। যত টাকা লাগে দেব। তুই শুধু ম্যানেজ কর।’
অনুনয় করলাম।

‘আচ্ছা দেখছি ভাই।’ বেরিয়ে গেল নাজমুল।
ঘণ্টাখানেক পর ফিরল সে।
‘ভাই, আজ রাতে ভোরে পার হওয়া যাবে না। কাল সন্ধ্যার পর চেষ্টা করতে হবে।’
‘আজ কি কোনোভাবেই সম্ভব নয়?’
কাঁটাতারের বেড়া। সার্চলাইট। আর বিএসএফের পাহারা। সব মিলিয়ে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে ভাইজান?’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। 

‘আমার সঙ্গে আসেন ভাইজান।’
নাজমুল আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
‘কোথায় যাচ্ছি?’
‘আমাদের বাসায় রাখা যাবে না। তাই আপনাকে অন্য জায়গায় রেখে আসতে যাচ্ছি।’
‘কার বাসায়?’
‘কারও বাসায় না ভাইজান। সেটা রিস্ক হয়ে যাবে।’
‘তাহলে?’

‘এখানে একটা পুরোনো জমিদার বাড়ি আছে না? আজ রাতে ওখানে থাকুন। কেউ সন্দেহ করবে না।’
আবছাভাবে আমার মনে পড়ল। পুরোনো একটা জমিদার বাড়ি আছে। জঙ্গল দিয়ে ভরা।
‘ওই জঙ্গলভরা বাসায় কীভাবে থাকব?’ সংশয় প্রকাশ করলাম।
‘জঙ্গল আর নেই ভাইজান। আমরাই কেটে সাফ করেছি।’
‘কেন?’

‘ওই জমিদার বাড়িটা দেখতে অনেক দেশি-বিদেশি পর্যটক আসে। তখন স্থানীয়রা মিলে নিজেরাই পরিষ্কার করেছি।’ 
‘রাতে থাকার মতো ব্যবস্থা?’
‘ওখানে নেশাখোররা আস্তানা বানাতে চেয়েছিল। তাই আমরা পালা করে ওই জমিদার বাড়িতে থাকি।’
‘আজ কি আমি একাই থাকব?’
‘না ভাইজান। আমি বাইরের ঘরে আপনাকে পাহারা দেব।’

স্বস্তি পেলাম। যত দূরের সম্পর্কই হোক, ভাই তো। আজ রাতটা কোনোমতে কাটুক।
জমিদার বাড়িটা পুরোনো হলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। চার্জার লাইট রেখে আমাকে আমার বিছানা দেখিয়ে নাজমুল বের হয়ে গেল।
‘ভাইজান, দরকার হলে ফোন দিয়েন।’

শুয়ে পড়লাম আমি। চারপাশে অন্ধকার। দূরে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। পাতার সর সর শব্দ। টের পেলাম দুচোখে ঘুম আসছে না।
বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো।

‘ক্যামন আছেন?’ ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল কে যেন।
হিমশীতল আতঙ্ক বয়ে গেল আমার সারা শরীরে। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হলো না। একে তো ক্ষমতা হারানোর শোক। তার ওপর রাজকীয় জীবন হঠাৎ হারিয়ে ভিখারির জীবনে প্রবেশ। আর এখন মাঝরাতে অজানা নির্জন জমিদার বাড়িতে বসে ভূতুড়ে গলার আওয়াজ আতঙ্কে ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো আমার।

‘বললেন না ক্যামন আছেন?’
‘ভা...লো...নে...ই।’
‘কেন?’
‘ক্ষ...ম...তা হারিয়েছি। ইন্ডিয়া পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম আজ রাতের মধ্যে। সীমান্তের কড়াকড়ির জন্য পারছি না।’
‘আমিও পারছি না। সেই কবে থেকে চেষ্টা করছি।’ অন্ধকার চিরে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা ভেসে এল।
‘আপনিও কি আমার মতো দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’

তার জবাব শুনে ভরসা পেলাম। যাক, আমি তাহলে একা নই।
‘আপনি কী করেন?’ জানতে চাইলাম।
‘জিজ্ঞেস করুন কী করতাম না। ড্রাগস, চোরাচালান, মাদক।’
‘তাহলে তো পুলিশ আপনাকে খুঁজবেই।’
বলার পরই বুঝতে পারলাম শব্দটা পুলিশ হবে না। পুলিশও তো আমার মতো পালিয়েছে।
‘পুলিশ না। আমি পালিয়েছি জনতার ভয়ে।’
আমি কীভাবে পালিয়ে এসেছি সেটা স্মরণ করলাম।

‘কখন বের হয়েছেন বাসা থেকে?’
‘বেশ কিছুদিন হলো।’ ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলাটি বলল।
সন্দেহ হলো। সরকার পতন হলো আজ আর ব্যাটা বলে কিনা কয়েকদিন আগে পালিয়েছে।
‘এই কয়দিনে বর্ডার পার হতে পারেননি?’
‘না। দালালটা বলল আমি সন্ধ্যায় এসে আপনাকে নিয়ে যাব। পরে আর এলই না। আমার টাকা-পয়সা সব নিয়ে ভেগেছে।’

‘কত তারিখে এসেছেন আপনি?’
‘ছয় ডিসেম্বর।’
চমকে গেলাম। 

আজ পাঁচ আগস্ট। আর উনি কি না বলছেন ডিসেম্বরে এসেছেন!
রেগে গেলাম। ‘কত সালে?’
‘উনিশ শ নব্বই সালে।’ 
উনিশ শ নব্বই সালের ছয় ডিসেম্বরে স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়েছিল। আমিও সেই আন্দোলনে শরিক হয়েছিলাম।’

কিছু একটা বলতে যাব তার আগেই প্রচণ্ড বজ্রপাত হলো।
সেই বজ্রপাতের ক্ষণিকের আলোয় দেখলাম আমার সামনে একটা কংকাল বসে আছে। যেন দাঁত বের করে হাসছে। পড়িমড়ি করে বের হয়ে এলাম। ছুটতে ছুটতে কখন যে সেনাবাহিনীর গাড়ির সামনে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছি নিজেও জানি না।’
একনাগাড়ে বলার পর থামলেন নেতা।

‘সামান্য একটা কংকাল দেখে পালিয়ে এলেন।’ হেসে জানতে চাইলাম।
‘আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার। নির্জন জমিদার বাড়িতে ভূতের হাতে অপঘাতে মরার চেয়ে জেলখানায় থাকা অনেক ভালো। একদিন না একদিন জামিন পাবই।’
হেসে ফেললাম। 
‘আপনি এখন জেলেই আছেন।’
‘কে ওখানে?’ একজন কনস্টেবল এগিয়ে এল।
নিজের পরিচয় দিলাম। 
‘বৃষ্টির জন্য আটকে পড়েছি।’ 

‘হাজাতির সঙ্গে আলাপ করা নিষেধ।’ বলল কনস্টেবল।
‘বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে দেখে ডাকলেন।’
‘নিশ্চয়ই বানিয়ে বানিয়ে ভূতুড়ে জমিদার বাড়ির গল্পটা বলেছে আপনাকে?’
‘বানানো?’

‘আমাদের স্যাররা বর্ডার থেকে অনেক কষ্ট করে ধরে এনেছেন তাঁকে।’
‘উনি নাকি নিজে নিজেই ধরা দিয়েছেন।’
‘ক্ষমতা হারাইছে তো। মাথাটাথা আউলায় গেছে।’ হেসে বলল কনস্টেবল।

পাখির অভিমান

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৬ পিএম
পাখির অভিমান
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

বুকের চেয়ে বড় কোনো ডাকঘর নেই, এই অধিবিদ্যার পৃথিবীতে
যেখানে দিনে-রাতে, কত চিঠি আসে আর যায়...

একই  শহরে থাকি আমি ও আমার অস্থির নীরবতা

খুঁজিনি কখনো বৃক্ষের বুকে কান রেখে আমারি নিশ্বাস। 
তবু মনের ভুবনে এই পৃথিবীর অদ্ভুত সন্ধ্যা এসে থামে; 
খোঁজ করে কোনো এক বৃক্ষের সংসারে এই আমাকে। 
আমি ব্যস্ত তখন, এক অকালপ্রয়াত বটবৃক্ষের নিহত সংসারে।

বিষণ্ন আঙিনাজুড়ে উড়ে পড়ছে একদল পাখির অভিমান। 
আজ হয়তো গাছে গাছে শুরু হবে পাখিদের শোকসভা। 
হাওয়ায় হাওয়ায় আরও মিলে যাবে বৃক্ষশ্রোতা। 
এই মহান পাখি সম্মেলনে আমিও মিলে যেতে 
চাই অন্তরের অনুলিপি হয়ে। 

দৈনিক বাতাস বিচিত্রায় আজ ছাপা হলো বৃক্ষ হত্যার প্রতিবাদ। 
সেই বৃক্ষের মৃত্যুতে গাছে গাছে ঝুলছে দেখি পাখিদের শোক প্রস্তাব।

বিজড়িত

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৫ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৬ পিএম
বিজড়িত
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

আঁধার আমার ভালো লাগে, 
তারা দিয়ে সাজিও না আমার আকাশ 
বড় প্রিয় গান 

তুমি যে সূর্যসম্ভব 

কালের নিয়মে তেজ ম্লান হয় 
লোহিত নক্ষত্রের গান 
শ্বেত বামন শুধু ম্লান হতে থাকে 

নিভে যায় সব...

গুঁড়ো গুঁড়ো ছড়িয়ে যায় 
কণিকা সম্ভার 

শূন্য জুড়ে তাই এত টান 

যাকে ‘মায়া’ বলে ডাকি।

কবিতা

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৭ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৩ পিএম
কবিতা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

এই হাত
মুজিবুল হক কবীর

এই হাত
পতন ঠেকাতে জানে,
এই হাত ইস্পাত
পুড়ে যায় যজ্ঞে-আগুনে।

এই হাত মেতে ওঠে
মিছিলে-আন্দোলনে
এই হাত প্রতিবাদী
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে।

এই হাত নিয়ে আসে স্বর্গের পারিজাত
এ হাত থামিয়ে দেয় জলের প্রপাত।

হৃদয়ের যত গ্লানি মুছে দেয় এই হাত,
কার ইশারায় চলে যায় অহল্যারও অভিসম্পাত।

দ্বন্দ্ব ও কোলাহল, যুদ্ধ-
কখনো নেয়নি মেনে নানক ও বুদ্ধ।
এ জগৎ-সংসার একটি রজ্জুতে বাঁধা
কোথায় কৃষ্ণ আর কোথায় বা রাধা।

এ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ডুবে আছে জলে,
তবু সব কিছু আজ
ঈশ্বরেরই করতলে।

প্রাচ্যের কবি মুহম্মদ ইকবাল

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১০ পিএম
প্রাচ্যের কবি মুহম্মদ ইকবাল
কবি মুহম্মদ ইকবাল

কবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ মুহম্মদ ইকবালের জন্ম অবিভক্ত ভারতবর্ষের এক মুসলিম পরিবারে ৯ নভেম্বর ১৮৭৭। মৃত্যু ২১ এপ্রিল ১৯৩৮। পিতা শেখ নূর মুহম্মদ। মুসলিম দার্শনিক চিন্তাবিদ ইকবালের কবিতাকে আধুনিক যুগের ফার্সি এবং উর্দু সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ‘পাকিস্তানের জাতীয় কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আসরার-ই-খুদি’ (১৯১৫) পারস্য ভাষায় প্রকাশিত হয়। ১৯০৭ সালে, ইকবাল পিএইচডিতে অধ্যয়ন করার জন্য জার্মানিতে চলে যান এবং ১৯০৮ সালে মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ফিলোসফি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার ডক্টরেট থিসিসটির শিরোনাম ‘দ্য ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পারসিয়া’। ১৯০৮ সালে ইকবাল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে এসে লাহোরের সরকারি কলেজে যোগ দেন। একই সঙ্গে তিনি আইন ব্যবসা ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। মূলত অর্থনৈতিক কারণেই তিনি ১৯০৯ সালে সার্বক্ষণিক আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ইকবাল কেবল একজন উঁচুমানের লেখকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যপ্রেমিক। সাহিত্যের জন্য বেশি সময় ব্যয় করতেন। উর্দু ভাষা ও কাব্যকে তিনি নতুন জীবন দান করেছিলেন। সে জন্য তাকে শায়ের এ মাশায়েও বলা হয়। তার কাব্যমুগ্ধ পাঠককূল তাকে আল্লামা উপাধি দিয়েও সম্মানিত করেন।

শ্রীধরনামা

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৯ পিএম
আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৮ পিএম
শ্রীধরনামা
আঁকা: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

শ্রীধর আমাদের বন্ধু মহলের এক চির বিস্ময়। সে-কালে, মানে যে-কালে এই শিল্পাঞ্চলে, যে শিল্পাঞ্চল ঘিরে সমরেশ বসু ‘জগদ্দল’ বা তারও আগে ‘উত্তরঙ্গ’ হয়ে ‘শ্রীমতী কাফে’ হয়ে ‘খণ্ডিতা’ পর্যন্ত এগিয়েছিলেন, ১৯৮৮ সালের মার্চের ১২ তারিখ, সেই মহাসর্বনেষে তারিখটা না এলে হয়তো বিধুভূষণ বন্দোঘঁটি, শ্রীধরের জন্মদাতা, তিনিও দোলা-শ্রীধর বা কালুর বৌয়ের সঙ্গে শ্রীধরের আশনাই বা সমরেশ বসুরই বন্ধু, ভীমরুলের নাদনি, সেই পিঁয়াজিবালা বৈষ্ণবী, দীপক সাহার চায়ের দোকানে বসে, শ্রীধরের নিচের নয়, বুকের পাকা চুল তুলে দিয়েছিল- তা নিয়ে একালে এত হট্টগোল হতো না।

হুগলীর আনাচে-কানাচে সেই নিতম্বিনী দেবীর, নিতম্বের ভারে ঝপঝপে হয়ে যাওয়া শব্দের আওয়াজ, থমথমে হয়ে যাওয়ার ঠিক প্রদোষকালে, কখনো ঠাওর করে উঠতে পেরেছিল। সমরেশ বসুর লেখা ঝেঁপে, কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠার হাউসে দিগ্বিদিক ভুলে সুরো ভটচায্যির গলিতে হাবুডুবু খাওয়া, রেখা পালের সমাজে স্বীকৃতি না পাওয়া দাদা, নিরোজ, নিরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়।

সমরেশ বসুর দৌলতে যে কলিকালের শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় হতে চেয়েছিলেন, সেই নিরোজের সঙ্গে দোলার, ‘মাস্সাই’সুলভ সম্পর্ক ঘিরে সেই দোলার পেটে জন্ম নেওয়া শিশুকে, ‘আমার বৌয়ের সন্তান’ না বলে, ‘আমার শালীর মেয়ে’ বলে চালিয়ে যাবে, চালিয়েই যাবে শ্রীধর বন্দোঘঁটি?

আচ্ছা এই যে, ‘ভীমরুলের নাদনি’ শব্দটা ব্যবহার করা হলো, এই শব্দটা আপনারা পাঠকেরা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন কী? এই যে টিপিকাল ‘ঘঁটি’ লব্জ, শাঁটুল গুপ্তের প্রজন্মের পর খাস বাগবাজারি ঘঁটিরাও কি এখন এমন শব্দের ব্যবহার ধরে রেখেছে? কিন্তু বিধুভূষণ বন্দ্যোঘঁটি, ঘঁটি বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে আমাদের শাঁটুলবাবুর থেকে এক কাটি বেশি ছিলেন বই কম ছিলেন না।

বিধুভূষণ কখনো ‘পেপার’ বলতেন না। বলতেন, ‘খবরের কাগজ’। কখনোই তিনি ভুলবশতও গোটা জীবনে ‘চুঁজরো’ বই ‘চুচুঁড়া’ উচ্চারণ করেননি। কস্মিনকালেও গনগনে গরম চাভর্তি চাপ ঠোঁটের সামনে এনে গলায় চালান করবার সময়ে ‘উঁহুউউউ’ করে আওয়াজ করেননি। 

তাই তিনি ‘নাতনি’ কে ‘নাদনি’ বলবেন- এটা কিন্তু কখনোই আশ্চর্য হওয়ার মতো কোনো বিষয় আদৌ নয়। বিধুভূষণ বাংলা খেয়ে যখন ড্রেনের ধারে গড়াগড়ি খেত, তখন ওর নাতনি, যাকে শ্রীধরের বন্ধুরা, সেই সেকালে ‘নাতনি’র দেহের ভঙ্গিমা দেখে ‘পিঁয়াজি’ বলত, সেই হাফ গেরস্তকে যখন শ্রীধর, মেয়েদের নয়, ছেলেদের তানপুরো তৈরি করে দিল কালুর বউয়ের তানপুরো ফাটানোর বিনিময়ে, তখন কি কেউ বুঝতে পেরেছিল, সে-কালের শ্রীধর আর এ-কালের শ্রীধরের মধ্যে জাপানি বন্ধুদের প্রভাবের আগে আর পরে এতটা ফারাক ঘটবে?

‘পিঁয়াজি’র দিকে শ্রীধরের বাপ, মানে শ্রীধরের বিকাশমান লালিত্যের সে-কালের উদ্ভাষক ক্ষিরুমামার একটা বিশেষ রকমের প্রভাব ছিল। প্রতিপত্তিও ছিল। আসলে ক্ষিরুর পৈতৃক সূত্রে একটা দখল করা বাড়ি ছিল সেকালের মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ায়। এখন ক্ষিরুমামার আট মাসের পোয়াতির মতো ভুঁড়ি হলেও ‘পিঁয়াজি’কে নিয়ে যখন শ্রীধর, ওয়াই কে টু-র প্রবলেম সল্ভ করতে ক্ষিরুমামার ঠাকুর্দা, মানে শ্রীধরের পরদাদা, অশ্বিনীকুমার ঘোরপাড়ুইয়ের পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে যেত, তখন রিপোজ নার্সিংহোমের সামনে রীতিমতো লোক জমে যেত পিঁয়াজিবালা বৈষ্ণবীকে দেখতে।

পিঁয়াজিবালা এখন রীতিমতো আগুনখেঁকো নেত্রী। ব্যান্ডেল চার্চপাড়ায় এককালে যিনি দাপুটে কাউন্সিলর ছিলেন, সেই মাস্টারমশাই জ্ঞানদাকে পর্যন্ত তটস্থ হয়ে থাকতে হয় পিঁয়াজিবালার আগমন এবং নিষ্ক্রমণ ঘিরে। জ্ঞানদার সঙ্গে শ্রীধরের পরিচয় নেই। পরিচয় থাকলে, শ্রীধর নিশ্চয়ই শুধাতো- দেবীর কি সে আগমন? আর নিষ্ক্রমণই বা কীসে? 

আচ্ছা  পিঁয়াজিবালার স্কুটির পেছনে শ্রীধর কখনো সাওয়ারি হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, তাহলে কি কখনো শ্রীধর তানপুরোতে তিনটে আঙুলের, কসরতে সুরলহরি তুলে ছায়াহিন্দোল গেয়েছে?

পিঁয়াজিবালা সেদিন লোটে মাছের ছালুন রেঁধেছিল বেলডাঙার মরিচ দিয়ে। ঝালের জন্য এদিকে বেলডাঙার মরিচের বেশ নামডাক আছে। সেই নুন দিয়ে নুচি খাওয়ার কালে শ্রীধর ব্যান্ননে মরিচ দেখলে তা আর মুখেই তুলত না। দীপক সাহার দোকানে পিঁয়াজিবালা প্রথম যেদিন শ্রীধরের কোলে বসে, শ্রীধরেরই বুকের পাকা চুল তুলে দিয়েছিল, সেদিনই দীপক সাহা নিজের হাতে দুটো কাঁচা মরিচ দেওয়া ডবল ডিমের ওমলেট খাইয়েছিল ছেলেটাকে।
লোটে মাছের ছালুন দিয়ে মাখা ভাতের লোকমাটা মুখে চালান করতে করতেই শ্রীধর বলে উঠল- 

বুঝলি কুমড়ি, এই লোটে মাছে প্রচুর ফসফরাস থাকে। ফসফারাসে চোখ ভালো হয়।

পিঁয়াজিবালাকে ডাক নামে ডাকতেই ভালোবাসে শ্রীধর। তবে কালুর বৌ থেকে ক্ষিরুর আপিসের সেই লাবণ্যলতা হয়ে চিনে হাঁদুর বর্তমান ভাগনেবৌ, সবাইকে অঙ্ক শেখাতে গিয়ে শ্রীধর ‘হেকেটি’ বলতে ভালোবাসে। কারণ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’তে নাকি লেখা আছে, রবীন্দ্রনাথ, তার নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীকে ‘হেকেটি’ বলে ডাকতেন।

বড় বড় জিনিস দেখে তোমার এখন চোখ বড়তেই সয়ে গেছে গো শ্রীধরদা। নতুন করে আর তোমার এখন চোখ ভালো করবার দরকার নেই। চোখের জ্যোতি তোমার কালুদা আর ভবান বৌদি, দুজনেই মেজেঘসে বেশ চকচকে করেই রেখে দিয়েছে।

পিঁয়াজিবালা নোয়াখাইল্যা হলেও সমরেশ বসুর ‘ভানুমতী’র দেশে থেকে ফরাসডাঙার ‘হ্যাঁ গো’, ‘কী গো’ বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। যদিও হাওড়ার ঘঁটি কেতা ভুলে এখন শ্রীধর হাবুডুবু খাচ্ছে কালু জানুলম্বিত ঘণ্টার তালে তালে।

শ্রীধর মাঝেমধ্যে বেশ উদাস হয়ে যায় জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাবনিকাশ কষতে গিয়ে। ছেলেটা খুব যে একটা হিসেবি, তা বলা যায় না। অন্ততপক্ষে এলাকার নেতা দুই তরফের দুই নেতা- মলয় ভট্টাচার্য আর শমিত ঘোষ, যারা দুবেলা যাদবপুর থেকে ঠেঙিয়ে নৈহাটি আসা শ্রীধরকে তাদের চর্মচক্ষু দিয়ে দেখে, তারা কখনো ছেলেটাকে তেমন একটা হিসেবি বলে না।

আসলে বলে না, নাকি বলতে চায় না- এটা নিয়ে আবার সুনীতিদাদের ঠেকে বেশ তক্কবিতক্ক আছে। ওই যে সুনীতিদের সঙ্গে ঠেক মারা রেলের রিটায়ার্ড বুকিং ক্লার্ক তপুবাবু, রাত্রিক নাট্যসংস্থায় চা, জল বয়ে এনে নিজেকে নাট্যকর্মী বলে দাবি করে শহরের বুকে নাট্যোৎসব হলে ঠিক টুক করে মন্ত্রীর পাশের সিটটা দখল করে নেয়, সেই তপুবাবু, নিজের চাকরি জীবনে যেভাবে হাতের ভাঁজে একটা পাত্তি পকেটস্থ করতেন, ঠিক সেই স্টাইলে শ্রীধরকে রোজ একটা করে গোল্ড ফ্লেক সিগারেট দেয়।

কালু সম্ভবত মহাদেবের চা-খানায় এককালে সিনেমা হলের টিকিট ব্ল্যাকার নসু ভটচায্যির নাতবৌয়ের সঙ্গে দুপুর আড়াইটের সময় শ্রীধরকে একা একা আড্ডা মারতে দেখে বাড়ি গিয়ে ভবানীকে ব্যাপারটা বলে ফেলে। আসলে সেদিন কালুরই ব্যাংকিংয়ে একটা ঝামেলা হচ্ছিল। সবিতা। কালুর ছোটভাইয়ের বৌ, হাজার পাঁচেক টাকা চেয়েছিল। পেনশনভোগী কালু মাসের যত তারিখই হোক না কেন, সবিতা টাকা চাইলে কখনো না করতে পারে না। হাসির ছলে ভেসে যাওয়া দিনের কথা মনে করে হৃদয়ের দয়ার ঘটটা কালুর ছলছলিয়ে ওঠে ছোটভাইয়ের অসহায় বৌটার জন্য। 

নিজে অনেকক্ষণ চেষ্টা করল সেদিন কালু টাকাটা পাঠাতে সবিতাকে। কিছুতেই অনলাইন ট্রানজাকশন হচ্ছে না। আবার বাড়িতে বসে বেশি সময় ধরে চেষ্টা করলে পাছে ভবানী জানতে চায়, মোবাইলে অতক্ষণ ধরে কী করছ খুটখুট করে? 

তাই পাঞ্জাবিটা চাপিয়ে ফ্ল্যাট থেকে নেমে নেদু সান্যালের বাড়িটা পেরোতেই কালুর মনে পড়ে গেল, এই রে, শ্রীধর তো আবার বলবে; আরে কালুদা, আবার ঘণ্টা নাড়তে নাড়তে এসেছেন? পুজোর তো এখন অনেক দেরি!

কালু অনেক বলবার চেষ্টা করেছে শ্রীধরকে বোঝাতে, ঘণ্টা যত নড়বে, হাওয়া তত বইবে, আলো আরও খেলবে। বলব বলব করেও অবশ্য কথাগুলো শ্রীধরকে বলে উঠতে পারেনি কালু। না বলবার কারণ হলো, পাছে শ্রীধর জেনে যায় অনুর জামাইয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব!

মহাদেবের দোকানে কালুর সমস্যা সল্ভ করে শ্রীধর, কিন্তু যেহেতু সে নসু ভটচায্যির নাতবৌয়ের সঙ্গে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত ছিল, খুব একটা পাত্তা দেয় না কালুকে। শ্রীধরের এই পাত্তা না দেওয়াটা বেশ একটু বেশি পরিমাণেই আঁতে লাগে কালুর। মটকা গরম হয়ে গেলেও মুখে কিছু না বলে মহাদেবের কাছ থেকে এক ভাঁড় চা খেয়ে আবার সুরো ভটচায্যির গলি পেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। মনে তখন কালুর একটাই তৃপ্তি, শ্রীধর খুব একা পাত্তা দিক আর না দিক, ওর দৌলতে সবিতাকে পাঁচ হাজার টাকা শেষ পর্যন্ত পাঠানো গেছে।

আজ সকালে যখন মলয় ভটচায্যি বললেন, শ্রীধরকে নিয়ে অক্ষয়কুমারী দেবী রোডের আশপাশে ঘুরতে দেখেছেন, একদম উল্টো রাজনৈতিক শিবিরের শমিত যখন এককথায় সমর্থন করল মলয়ের সেই কথা, শ্রীধর অবশ্য তখনো দাঁতের ডাক্তার রণজিৎ সরকারের বাড়িতে সে গেছিল, এই যুক্তিতেই একদম এঁটুলির মতো এঁটে রইল।

আসলে মিথ্যে কথাটা শ্রীধরের ঠিক আসে না। মিথ্যে বললেই কেমন যেন ওর মুখটা ভ্যাদাই মাছের মতো বোকা বোকা হয়ে যায়। আর তেমনটা হলেই, ডাল মে যে থোরা থোরা কালা- সেটা মালুম করে নিতে কারও খুব একটা অসুবিধা হয় না।

সাত সকালে আজ হেকেটি ফোন করেছে শ্রীধরকে। ট্রেনটা তখনো শিয়ালদা সাউথ সেকশনে ঢোকেইনি। এই সময়ে শ্রীধর সাধারণত ফোন-টোন ধরে না। সবাই জানে, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির মেইন ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরুর আগেই স্পেশাল ক্লাস নিয়ে নৈহাটিতে মহাদেবের চায়ের দোকানে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্তের কেয়ার না করে আড্ডা দিতে চলে আসে শ্রীধর। আবার বিকেলে, পাঁচটা বাইশের নৈহাটি লোকাল ধরে যাদবপুরে শেষ ক্লাসটা নিয়ে, ইউনিভার্সিটির ঘরগুলোর সব তালা ঠিকঠাক দেওয়া হয়েছে নাকি সেটা টেনেটুনে দেখে, বাপ্পার দোকানে একটু আড্ডা দিয়ে, শঙ্কুরবাড়ি পাশ কটিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে সে পৌঁছায়।

সুরঞ্জন দাশ নাকি শ্রীধরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন; তা কত ইস্তক এ কাজ কোরচেন? 

শ্রীধর জবাব দিয়েছিল; একুনে সেই ত্রিগুণা সেনের আমল থেকে।

তার পর থেকে নাকি আর কেউ যাদবপুর ইউনিভার্সিটি ঘিরে শ্রীধরকে কোনো কথা শুধোতে সাহস করেনি।

তাই এমন অসময়ে কালুদার বৌ ফোন করাতে যুগপৎ বিরক্ত আর বিস্মিত হলো শ্রীধর। তবে ছেলেটার সব থেকে বড়ো একটা গুণ হলো, রেগে গেলেও ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে কিছু ধরা যায় না, আনন্দেও নয়। তাই তো কালুর বৌ একদিন নিজের পরম তৃপ্তির পর শ্রীধরকে বেশ ন্যাকা ন্যাকা সুরেই শুধিয়েছিল; আর ইউ ওকে শ্রীধর? 

কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা কালুর ফ্ল্যাট থেকে নিচে নেমে সাইকেলের তালা খুলে সটান মহাদেবের চায়ের দোকানের পাশে মাছের আড়তের বড় বেদিটার ওপর বসে পড়ে জোরে হাঁক দিয়েছিল, সোমনাথ একটা ছোট চা।

ভবানীর গলার স্বরটা আজ আদৌ রসেবশে নেই। বেশ একটু কর্কশই। শ্রীধর একটু জোর করলে যেমন চেঁচিয়ে উঠতে অভ্যস্ত কালুর বৌ, অনেকটা তেমন। অবশ্য শ্রীধরের ধারণা, হেকেটির এই চেঁচানিটা একটু আর্টিফিসিয়াল। লোক দেখানো। আসলে নদী যখন তীরে এসে আছড়ে পড়ে, জলের ইচ্ছে না থাকলেও জলে জলে কোলাকুলিতে যেমন নদীর পাড়ে ঢেউয়ের আছড়ে পরবার একটা আওয়াজ হয়, কালুর বৌয়ের সময় বিশেষের আওয়াজটাকে অমনটাই মনে হয় শ্রীধরের। তাই ফোনের ও-প্রান্ত থেকে যখন একটু খ্যাঁককুটে গলাতেই প্রশ্ন এল- ক্লাসে? 

নিজেকে একটু সেফসাইডে রেখেই ব্যাট করতে নামল শ্রীধর। কারণ, ওর তখন মন বলছে, বলটা গুগলিই হবে। আর গুগলি বলে ভালো ব্যাট করতে কোনোদিনই শ্রীধর পারে না। এককালে ছক্কা হাঁকানো শ্রীধর, সেই পিঁয়াজিবালার শ্রীধর, বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা হয়েই ফোনের ও-প্রান্তের দিকে উত্তর পাঠাল- হ্যাঁ, বলুন বৌদি।

দুই তরফেই খানিকটা নিস্তবদ্ধতা। শ্রীধর ভাবছে, সময় সম্বন্ধে তো হেকেটির অসাধারণ মাত্রাজ্ঞান। এই সময়ে তো খুব বড় কিছু দরকার না হলে, কেবল আমড়াগাছি করতে এই সময়ে হেকেটি ফোন করে না।

হ্যাঁ বৌদি, কালুদা ঠিক আছে তো? 

ও প্রান্ত থেকে একটাই উত্তর, টুকুদির ছেলের বৌয়ের প্রেগ কালার টেস্টের রিপোর্ট আমার হাতে।

ঝপ করে ফোনটা কেটে দিল শ্রীধর।